শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা অপরাধে জেল খাটছে ওরা তিনজন

প্রকাশিতঃ ৯ মে ২০১৮ | ৮:৫৭ অপরাহ্ন

মোর্শেদ নয়ন : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় প্রবাসীর বাড়িতে ঢুকে ডাকাতি ও তিন গৃহবধূসহ চার নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় বিনা অপরাধে সাড়ে চার মাস ধরে জেল খাটছে তিন যুবক; তাঁদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করেছিল কর্ণফুলী থানা পুলিশ।

যদিও এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীসহ জড়িত অন্য চারজনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কর্ণফুলী থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ওই তিন যুবকের কেউই এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে সে সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন পিবিআই কর্মকর্তারা।

পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম এই তিন যুবক জেলে থাকায় তাদের পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মামলার খরচ চালানোর সামর্থ্যও নেই অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর।

ওই তিনজন হলেন- শাহ মীরপুর গ্রামের আহমদ মিয়ার ছেলে মো. সুমন ওরফে আবু (২৩), মৃত কামাল আহমদের ছেলে ইমতিয়াজ উদ্দিন বাপ্পী (২২) এবং শিকলবাহা গ্রামের দুলা মিয়ার ছেলে মো.মাহমুদ ফারুকী (২৫)। এদের মধ্যে আবু রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, বাপ্পী ছিলেন মোটর কার চালক।

আবু’র বাবা আহমদ মিয়া একুশে পত্রিকাকে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি পঙ্গু মানুষ। ভিক্ষা করে ছেলেকে বড় করেছি। রাজমিস্ত্রির কাজ করতো সে। কিন্তু আমার নিরপরাধ ছেলেকে একজন জনপ্রতিনিধি ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।’

‘টাকা-পয়সা না থাকায় ছেলেকে জেলে দেখতে যেতে পারছি না। ঘরভাড়া দিতে না পারায় নাতিসহ পুত্রবধূকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এ কথা বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

ইমতিয়াজ উদ্দিন বাপ্পীর মা খতিজা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে একুশে পত্রিকাকে বলেন, স্বামী মারা যাবার পর আমার ছেলে বাপ্পী গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতো। কিন্তু সে জেলে থাকায় ছোট ছেলে নিয়াজ (১৭) রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে। মামলার খরচ চালানোর মত সামর্থ্য আমাদের নেই।’

এ প্রসঙ্গে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ও কর্ণফুলী থানার এসআই মোহাম্মদ হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধির কথায় প্রভাবিত হয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের গ্রেফতার করি। এ ঘটনায় মিডিয়ার চাপ থাকায় তাদের সংশ্লিষ্টতা খুব বেশী যাচাই করার সুযোগ পাইনি।’

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর গভীর রাতে কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের শাহ মিরপুর গ্রামে একটি বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির চার নারীকে ধর্ষণ করে ডাকাতরা। চারজনের মধ্যে তিনজন প্রবাসী তিন ভাইয়ের স্ত্রী, অন্যজন তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা ননদ।

এ ঘটনায় মামলা নিতে পুলিশের বিরুদ্ধে গড়িমসি করার অভিযোগের পর ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নির্দেশে কর্ণফুলী থানা পুলিশ প্রায় পাঁচদিন পর মামলা নেয়। ওই ঘটনায় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তড়িঘড়ি করে ওই তিনজনকে গ্রেফতার করে কর্ণফুলী থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আসামি আবুকে টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড (শনাক্তকরণ) করানোর জন্য আবেদন করা হয়।

২৫ ডিসেম্বর চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার অগ্রগতি জানাতে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার পর মামলা নেওয়া ও আসামিদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কর্ণফুলী থানার আংশিক ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন নগর পুলিশের উপ কমিশনার (বন্দর) হারুন-উর-রশিদ হাযারী। মামলা নিতে গড়িমসি, আলামত নষ্ট, তদন্তে গাফিলতিসহ প্রতি পদে ব্যর্থতায় কারণে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব থেকে কর্ণফুলী থানা পুলিশকে সরিয়ে দেয়া হয়।

২৬ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ওইদিনই মিজান মাতব্বর ও আবু সামা নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পিবিআই সদস্যরা। ২৭ ডিসেম্বর হান্নান মেম্বার নামে আরেকজনকে আটক করা হয় যাকে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জানিয়েছিল পিবিআই। এরপর ৩ জানুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় জহিরুল ইসলাম হাওলাদারকে।

গ্রেফতারের পর তিনজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা যায়, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী স্থানীয় হান্নান মেম্বার। তিনিই পাঁচজনকে ডাকাতির জন্য একত্রিত করেছিলেন। তবে ঘটনার সময় তিনি আসবেন, আসবেন করে আর আসেননি। চারজন ঘরের ভেতরে ঢুকেছিল। আবু সামা বাইরে ছিল। ঘটনায় জড়িত অন্য দুই জন হলেন- রুবেল ও ইলিয়াছ। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা না পাওয়া আবুকে টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড এ হাজির করেনি পিআইবি।

কারাবন্দি নিরপরাধ ব্যক্তিদের প্রতিবেশী আইনজীবী দিদারুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পিবিআইয়ের গ্রেফতার করা তিন আসামি আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিয়েছে, সেখানে আবু, বাপ্পী ও ফারুকীর নাম নেই। তারা নিরপরাধ। আমি একবার ওদের জামিন চেয়েছিলাম। তবে আদালত জামিন মঞ্জুর করেননি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে এমন দেশ এখনো করতে পারিনি যে, সবাই দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে। সুবিচার পাওয়াটা এখন আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। এখন পিবিআই যে তিনজনকে নিরপরাধ বলছে, তাদের জামিনের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। এ ব্যাপারে আমরা কোন মন্তব্য করতে পারিনা।’

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এমএন/এসআর/একুশে