শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউআইটিএস ভিসির কাছে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবির সত্যতা পেয়েছে পুলিশ

জামিন নিয়ে লাপাত্তা সেই শওকত

প্রকাশিতঃ ১২ জুলাই ২০২০ | ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন


ঢাকা : ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) এর ভিসিকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি চাঁদা দাবির ঘটনায় ভুঁইফোড় সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগের কথিত সভাপতি শওকত হাসান মিয়া ও তার ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ।

জানা গেছে, অভিযুক্ত শওকত হাসান মিয়া বাদী হয়ে ইউআইটিএস বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন। এই মামলার প্রেক্ষিতে ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ উভয়পক্ষের মধ্যে উদ্ভূত বিরাজমান বিরোধ সঠিক নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত শেষে অপরাধের সাথে জড়িত অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য ঢাকার সিএমএম আদালতে শওকত হাসানকে আসামি করে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন।

সিএমএম আদালত দুটি মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে ঘটনা যাচাইয়ের জন্য পিবিআইকে তদন্তপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে পিবিআই’র অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন গত ১৪ জুন বঙ্গলীগের চেয়ারম্যান শওকত হাসান মিয়ার দায়েরকৃত মামলায় বর্ণিত অভিযোগটি ভিত্তিহীন মর্মে ইউআইটিএস বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যানের পক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। অন্যদিকে শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দায়েরকৃত সিআর মামলায় বর্ণিত অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে শওকতের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন আদালতে।

এদিকে চাঁদা দাবির ঘটনায় গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় শওকতকে প্রধান আসামি করে আরেকটি মামলা করেন ইউআইটিএসের উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী মো. মোস্তফা কামাল।

চাঁদাবাজির এ মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েই লাপাত্তা শওকত হাসান। আদালত তাকে ৬ সপ্তাহের জামিন দেন; যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি।

কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি শওকত। পুলিশ বলছে, জামিন নিয়েই পালিয়েছেন শওকত। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে একই মামলার আসামি শওকতের অন্যতম ক্যাডার এসএম মাহমুদ হাসান ৬ মাসেরও বেশি সময় কারাগারে থেকে সম্প্রতি নিম্ন আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। চাঁদাবাজির ঘটনায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী স্থানীয় দুইজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য সাক্ষী ও ভুক্তভোগী ইউআইটিএসের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মানের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্য ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এসব তথ্য জানিয়েছেন, ইউআইটিএসের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া।

অন্যদিকে অ্যাসার্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও রাজধানীর বারিধারায় অবস্থিত জামালপুর টাওয়ারের মালিক শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে ‘ইউআইটিএস’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দায়েরকৃত একটি জাল-জালিয়াতির মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চার্জশিট দিয়েছে।

তবে ৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলার তদন্তে ভাটারা থানা পুলিশ গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ইউআইটিএসের উপাচার্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাটারা থানার কর্মকর্তা মো. নাজমুল হাসান কোনও মন্তব্য করতে রাজী হননি। তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন।

ভাটারা থানার ওসি মো. মোক্তারুজ্জামান বলেন, ইউআইটিএস’র উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি চাঁদা দাবির ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এই মামলায় জামিন নিয়ে পালিয়েছেন আসামি শওকত হাসান মিয়া। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তদন্তে গড়িমসির অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে দায়ের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শওকত হাসানের মালিকানাধীন গুলশানের বারিধারা এলাকায় অবস্থিত ‘জামালপুর টুইন টাওয়ার-২’ ভাড়া নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে ইউআইটিএস। এরইমধ্যে ভাটারা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ শেষ হলে ২০১৯ সালের মে মাস থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর শুরু হয়। একই সঙ্গে ইউআইটিএস’র উপাচার্যও স্থায়ী ক্যাম্পাসে অফিস শুরু করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত শওকত হাসান ও তার ক্যাডাররা উপাচার্যের কাছে বিভিন্ন সময় প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা ছাড়াও মালামাল স্থানান্তরে বাধা দেন। এ বিষয়ে ২০ নভেম্বর ২০১৯ ভাটারা থানায় একটি জিডি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সন্ধ্যায় ৫-৬ জন সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে এসে ইউআইটিএস’র উপাচার্যের গাড়ি আটকে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন শওকত হাসান। চাঁদা না পেয়ে পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি ও প্রাণনাশের ভয়ভীতিও দেখান তিনি।

শুধু এই চাঁদাবাজির ঘটনাই নয়, এর আগেও ভাড়াটিয়াকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত। প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে গত বছরের ২০ নভেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায় শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ইউআইটিএসের রেজিস্ট্রার মো. কামরুল হাসান। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গত ১৫ জানুয়ারি গুলশান এলাকা থেকে শওকত হাসানকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে সেদিন বিকালেই ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেস চৌধুরীর আদালত ৫০০ টাকা বন্ডে তার জামিন মঞ্জুর করেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন বলে জানান অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া।

চাঁদাবাজির নেপথ্য ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলশানের বারিধারা এলাকায় অবস্থিত ‘জামালপুর টুইন টাওয়ার’টি শওকত হাসান মিয়ার। ২০১০ সাল থেকে সুউচ্চ এ ভবনের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ। বাড়ি ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী এককালীন ১০ বছরের ভাড়াসহ যাবতীয় পাওনাও ভবন মালিককে পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতেই বাগড়া বাধায় ভবন কর্তৃপক্ষ। শওকত হাসানের নির্দেশে গত ৩ নভেম্বর ২০১৯ তার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা মালামাল সরানোর কাজে নিয়োজিত কর্মীদের কাজে শুধু বাধাই দেয়নি, সন্ত্রাসীরা তাদের প্রাণনাশের হুমকিও দেয়।

হামলার কারণ জানতে চেয়ে শওকত হাসান মিয়ার কাছে বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্রের অনুলিপি চেয়ে চিঠি দেয় ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শওকত হাসান পত্রের উত্তরে মূল বাড়ি ভাড়া চুক্তি গোপন করে সাক্ষীবিহীন এবং ইউআইটিএসের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে একটি জাল চুক্তি সরবরাহ করে ৫৭ কোটিরও বেশি টাকা দাবি করা হয়। এরপর মালামাল স্থানান্তরে বাধা প্রদান এবং বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকেন। এরপর ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর শওকত হাসান তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ফের একই কাজ করেন। ২০ নভেম্বর শওকত তার স্টাফ আবুল কাশেম, এসএম মাহমুদ হাসান এবং সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য পনির, জুয়েল, সোহেলসহ অচেনা আরও কয়েকজন সরাসরি ও মোবাইল ফোনে ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষের অনেককেই মালামাল স্থানান্তরে বাধা দেওয়াসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সার্বিক বিষয় জানিয়ে ওই দিনই গুলশান থানায় জিডি (নম্বর-১৪৫২) করেন ইউআইটিএসের রেজিস্ট্রার মো. কামরুল হাসান।

জিডির তদন্ত শেষে গুলশান থানার এসআই কামরুল ইসলাম গত ২৩ ডিসেম্বর আদালতে যে প্রতিবেদন দাখিল করেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেন- জামালপুর টুইন টাওয়ারের ভবন মালিক ১০ বছরের জন্য ভবনটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএসের কাছে ভাড়া দেন এবং বাড়ি ভাড়ার চুক্তির শর্তানুযায়ী এককালীন ১০ বছরের পুরো ভাড়ার টাকা গ্রহণ করেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জিডির বাদীর নিজস্ব ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ শেষ হলে ভবন মালিক বরাবর নোটিশের মাধ্যমে অবহিত করে আসবাবপত্র ও মালামাল সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ভবন মালিক মালামাল সরানোর কাজে বাধা দেয়। বিবাদী পক্ষ মো. শওকত হাসান মিয়া, এসএম মাহমুদ, মো. পনির মিয়া, মো. সোহেল মিয়া, মো. জুয়েল ও তাদের ভাড়াটিয়া লোকজনের মাধ্যমে বাদীপক্ষদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং প্রাণনাশেরও হুমকি-ধমকি দেয় বলে তদন্তে উঠে আসে। বিবাদীরা বিভিন্ন বিল বকেয়া আছে জানিয়ে ইউআইটিএস কর্তৃপক্ষকে তা পরিশোধের জন্য চাপ দিলে বিরোধের সূত্রপাত হয়। এই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকেই আদালত শওকত হাসানসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানার ভিত্তিতে গত ১৫ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন শওকত।

জানা গেছে, শওকত হাসান মিয়ার গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলাধীন কুলকান্দী ইউনিয়নে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, পেশী শক্তির বলে নিরীহ অনেকের জমি জবরদখল করাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের কয়েকটি দপ্তরে শওকত হাসান মিয়ার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগ করেছেন।

এদিকে জনৈক এক মেজরের বাসায় কর্মরত গৃহকর্মী শওকত হাসান কিভাবে এক স্বল্প সময়ে এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন, তা তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে শওকতের কাছে সম্পত্তির বিবরণাদি প্রদানের নোটিশ প্রদান করেছে দুদক।