শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পথে দেশ, জামালপুরে রেকর্ড পরিমাণ পানি বৃদ্ধি

প্রকাশিতঃ ১৪ জুলাই ২০২০ | ৫:৫০ অপরাহ্ন


ঢাকা : দেশে এখন ভরা বর্ষাকাল। প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও চলছে টানা বৃষ্টি; মুষলধারায় বৃষ্টি। নদী-নালা, নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি আগেই পানিতে টইটুম্বুর হয়ে গেছে।

ওদিকে সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে চলছে টানা বৃষ্টি। গত তিন দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ি ঢল নেমে আসছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যেই দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১৫ জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।

এ অবস্থায় একে একে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা ও মেঘনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে গেছে। পদ্মার পানিও দ্রুত বাড়ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের নদ-নদীর পানি দুই কূল ছাপিয়ে উপচে পড়ার অবস্থা। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে আরও ১০টি জেলা সয়লাব হয়ে পড়তে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া আজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, উত্তরের জেলাগুলিতে ১৭ দিন ধরে বন্যা চলমান রয়েছে। এ অবস্থা জুলাই মাসজুড়ে চলতে পারে। উজানে বৃষ্টি আরো বেড়ে গেলে বাংলাদেশে বন্যার স্থায়িত্ব আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়াতে পারে। এমন আশঙ্কাই বেশি। ফলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।

কুড়িগ্রাম

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে যাচ্ছে। পরপর দুই দফা বন্যায় মানুষের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে।

আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৬টায় ধরলার পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদীর পানি বিপদসীমার ৮১ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

জেলার ৯টি উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক গ্রামের প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সদরের মধ্য কুমোরপুর হয়ে ফুলবাড়ী উপজেলা সদর যাওয়ার পাকা রাস্তা এখন পানির নিচে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বানভাসি মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে।

ধরলা নদীর পূর্ব পারের ৪টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। নৌকাই চলাচলের একমাত্র বাহন। পরিবারগুলো ঘরে চৌকি উঁচু করে, নৌকায় ও উঁচু সড়কে অবস্থা নিয়ে আছে।

সদর উপজেলার ভোগডাঙা ইউনিয়নের জগমোহন ও নানকার চরে ধরলা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে লোকজন বসতঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। সকালে দেখা যায়, আবদুল হক, আবুল কাশেম, রাজ্জাক ও আহাদ আলী নৌকায় করে বসতঘর ভূরুঙ্গামারী পাকা সড়কে নিয়ে তুলছেন। তাঁরা জানান, প্রচণ্ড স্রোতে বসতঘর ভেসে যাচ্ছিল। কোনোরকমে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পড়ছে

হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উমর ফারুক জানান, ধরলা নদীর পানির প্রবল চাপে সদর উপজেলার সারডোবে একটি বিকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সারডোব গ্রামের বাসিন্দা জহুর উদ্দিন বলেন, সোমবার সকাল ৮টার দিকে বাঁধটি ভেঙে পানি প্রবল বেগে ধেয়ে আসে। একে একে ৫টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। অনেক মালামাল ভেসে যায়। তীব্র স্রোতের কারণে নৌকা নিয়ে সেখানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাঁধটি ভাঙার কারণে হলোখানা, ভাঙামোড়, কাশিপুর, বড়ভিটা ও নেওয়াশি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম একে একে প্লাবিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে গবাদীপশু নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন। তাঁদের সরিয়ে নিতে নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। বাঁধের এই রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ফুলবাড়ী উপজেলা সদর ও কুড়িগ্রাম জেলা সদরে যাতায়াত করতেন। যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন তাঁরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, বাঁধটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। তবে বিকল্প বাঁধ রক্ষার জন্য বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছিল। কিন্তু পানির প্রবল চাপে শেষ পর্যন্ত বাঁধটি ভেঙে যায়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ময়নুল ইসলাম জানান, পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারের জন্য দুটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান, জেলায় ৪৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৪০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১১ লাখ টাকা ও ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার উপজেলা পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

জামালপুরে প্রথম দফার রেকর্ড ভেঙে পানি বেড়েছে

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিপাতে জামালপুরে যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রথম দফার রেকর্ড ভেঙে পানি বেড়েছে। দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় জামালপুরে দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জেলার সাতটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটার দিকে যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রথম দফার থেকে এখন পর্যন্ত ১০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আগাম বন্যায় ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি

অতিবৃষ্টি, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে এরই মধ্যে দেশের ১৪ জেলায় আউশ ও আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ৪৩ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৮৬ টন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর হিসেবে মওসুমের আগাম বন্যায় কৃষকের ৪৯৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ফসল কেড়ে নিয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোণা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল।