ডিসি অফিসে একপ্রহর অপেক্ষা, কিছু ভাবনা

হাসিনা আকতার নিগার : পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে উঠলে নজর কাড়ে চট্টগ্রামের শত বছরের ইতিহাসের লাল দালানটি, যেটি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সঙ্গে আদালত ভবন। কর্মব্যস্ত দিনে এ দালানটিতে থাকে প্রচণ্ড ভিড়। তবে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেকটাই ভাটা পড়ছে নতুন নতুন ইমারত তৈরি হবার কারণে।

বিচারিক ও প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু ডিসি অফিসের রাস্তার দুপাশে নানা কিছু বিক্রি হলেও শুটকি বিক্রির ইতিহাসটা দীর্ঘদিনের। প্রচলিত আছে, কোর্ট বিল্ডিংয়ের শুটকি সেরা শুটকি। ডিসি অফিস আর আদালতপাড়ায় শুটকি বিক্রি হওয়াটা আসলেই অবাক করার মত বিষয়।

আশপাশের বিষয়কে লক্ষ করাটা ছোটবেলার অভ্যাস। আর এ অভ্যাসটা পেশাগত জীবনে যে অনেক উপকারে এসেছে তা ডিসি অফিসে এসে আবার উপলব্ধি করলাম।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসনের প্রশংসা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠার কথা শুনেছি নানাভাবে। তপ্ত দুপুরে প্রশাসনিক এক কাজে তাঁর অফিসে যাওয়া। সাক্ষাৎ পাবো কি পাবো না এমন দোদুল্যমান চিন্তা নিয়েই পাহাড় বেয়ে ডিসি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো চট্টগ্রামের সব কিছু এখানেই। নিচতলায় কোর্ট চলছে বলে আইনজীবী আর সাধারণ মানুষের ভিড়। মানুষের ভিড়ের মাঝ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ডিসি সাহেবের অফিসের ওয়েটিং রুমে যাই। দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু সেখানে অপেক্ষারত লোক বেশি বলে কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই। এর মাঝে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বারান্দার অনেকটা দখল করে রেখেছে নিজেদের আলাপচারিতায়। এ অবস্থায় কিছুটা সময় দূরে দাঁড়িয়ে ভাবলাম কোনো ধরনের যোগাযোগ না করে এসেছি, সুতরাং দেখা হবার সম্ভাবনা নাই।

কাজের চিন্তা ভেদ করে ডিসির কাছে আসা মানুষদের আলাপচারিতা কানে আসছিল। কেউ ফাইল হাতে অপেক্ষা করছে অফিসিয়াল মিটিংয়ের জন্য, কেউ নিজের সমস্যা সমাধানের উপায় চাইতে, আবার রাজনৈতিক নেতাদের বিশাল বহর অনুদান, দরবার সৌজন্য সাক্ষাৎ নানা কিছু নিয়ে এসেছে। এর মাঝেই কাগজপত্র নিয়ে ছুটোছুটি করছে অফিসের কর্তাব্যক্তিরা। তবে যে বিষয়টি লক্ষনীয় তা হলো, একজন নেতার সাথে কম করে হলেও ৮/১০ জন সঙ্গীসাথী। আর এদের কারণে ওয়েটিং রুমে ভিড়ের আধিক্য। আবার অনেকে মনে করে নেতা বা ডিসি অফিসের সাথে যোগাযোগ আছে এমন কারো সাথে না এলে কাজ হবে না। ডিসির সাথে দেখা হবে না। কিন্তু ডিসি ইলিয়াস হোসেনের বেলায় এ কথা অচল তা নিজেই দেখলাম।

যাই হোক পুরো পরিবেশটা দেখে মনে কৌতূহল জাগল ডিসি সাহেবকে নিয়ে। একজন মানুষকে এত কিছু সামাল দেয়া অসম্ভব। তবে ইলিয়াস হোসেন নিত্যদিন এমন চাপই সামাল দিচ্ছেন। পিএ জানালো, ডিসি স্যারের মিটিং আছে, দেখা করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। কথাটা জানার পর বসার চেয়ার খুঁজতেই এক ভদ্রলোক বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। চেয়ারের জন্য ধন্যবাদ দিতেই সে ভদ্রলোক বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন। দেখা করতে পারবেন এটা নিশ্চিত। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া স্যার দেখা করেন না এমন ঘটনা নাই। স্যার সবার সাথে দেখা করে আবার চেষ্টা করে সমস্যার সমাধান দিতে।’

কথাটা শুনে ভাবলাম, এটা দেশের মানুষের জন্য সত্যি আশার আলো। সব আমলা একরকম নয় বলেই হয়ত চট্টগ্রামের ডিসি ইলিয়াস হোসেনের অফিসে সাধারণ মানুষ আসার সাহস করে। আবার দেখলাম যারাই দেখা করে রুম থেকে বের হচ্ছে তাদের চাহনিতে একটা আস্থা ভরসার প্রকাশ।

কথাগুলো শুনে, সবাইকে দেখে কৌতূহলী মনটা আরো বেশি উৎসুক হলো। সে সুবাদে অপেক্ষার এ প্রহর থেকে শেখা হলো নতুন কিছু। দেখা করে নিজের কাজ করার চেয়ে অনেক বেশি জানলাম একজন কর্তব্যপ্রেমী মানুষকে।

ডিসি ইলিয়াস হোসেন ঠিক দশভুজার মত অফিসের ফাইল দেখা, মিটিং আবার মানুষের কথা শুনে সাহায্য করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন নিজে বা নির্দেশনা দিচ্ছেন অফিসকে। সত্যিকারের কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, দেশ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এমনটা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।

বেলা গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা ৪টার ঘরে। একদম ফাঁকা ওয়েটিং রুম। ডিসি সাহেব বোধ করি বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু তার আগে অফিস সহকারীকে দিয়ে খবর নিলেন আর কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী আছে কিনা। ভদ্রলোক এসে বললেন, আমি কি এবার দেখা করব? বললাম- ‘না। আর একদিন আসব।’

অফিস সহকারী হয়তোবা অবাক হয়েছেন আমার আচরণে। ডিসির সাথে সবার দেখা করার এত অস্থিরতা আর এতটা সময় অপেক্ষা করে আমি দেখা না করে চলে যাচ্ছি। কিন্তু অপেক্ষার এ প্রহরে যা অর্জন করেছি তার প্রকাশ হয় না, এ কেবলই আত্মোপলদ্ধি।

হয়তোবা আর কোনো সময় হলে বলতাম, অযথা সময়টা নষ্ট হলো। কিন্তু এমনটা মনে হয়নি একবারও । বরং পাহাড়ের চূড়াতে বসা জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেনকে অবনত চিত্তে জানাই ‘স্যালুট’।

হাসিনা আকতার নিগার : লেখক, প্রাবন্ধিক