‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’


চট্টগ্রাম : যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর চলমান দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে নড়েচড়ে বসে যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকাণ্ডের মাধ্যমে রাতারাতি ধনকুবের বনে যাওয়া বিভিন্ন অঞ্চলের গডফাদাররা। অনেকের মাঝে রীতিমতো আতঙ্কও তৈরি হয়। বিদেশ পাড়ি জমানোর জন্যও তৎপরতা শুরু করে কেউ কেউ। চট্টগ্রামেও শুরু হয় অপরাধীদের গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা।

এই অবস্থায় দুর্নীতি দমন কমিশন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্ত-তালিকায় উঠে আসে চট্টগ্রামের উপজেলাভিত্তিক এ ধরনের যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী, গডফাদারদের নাম।

এসব অপরাধীদের চিহ্নিত করতে গিয়ে কোনো কোনো সংস্থা দেখতে পায় যে, অন্যান্য এলাকার চেয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় এ ধরনের দুর্বৃত্ত ও অপরাধীর সংখ্যা কম। তথ্যমন্ত্রীর কাছে এমন অপরাধীদের স্থান বা আশ্রয়ও নেই এমন তথ্যও আছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার মতে, যুবলীগের নাম ব্যবহার করে রাঙ্গুনিয়ায় হাতেগোনা এ ধরনের যে ক’জন অপরাধী রয়েছেন তাদের লাগাম টেনে ধরতে পারলে বা তাদেরকে আইনের আওতায় আনা গেলে তথ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা হবে দেশের অন্যান্য উপজেলার চেয়ে অনেক বেশি শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপদ বাসযোগ্য উপজেলা।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদেরও প্রাণান্তকর চেষ্টা একটি সত্যিকারের বাসযোগ্য, নিরাপদ রাঙ্গুনিয়া গড়ে তোলা। মূলত সেই চেষ্টাকে এগিয়ে দিতে এবং সমাজ পরিবর্তনে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধিৎসু, বস্তুনিষ্ঠ, সাহসী সাংবাদিকতার অংশ হিসেবে পত্রিকাটির সম্পাদক আজাদ তালুকদার ২২ সেপ্টেম্বর রাঙ্গুনিয়া যুবলীগের ডন পরিচয়ধারী অপরাধীদের তথ্য ইনবক্সে আহ্বান করে একটি পোস্ট দেন। পোস্টটিতে লিখেন- কুখ্যাত এরশাদ সিকদারের ‘স্বর্ণকমল’ আদলে এলাকায় বাড়ি নির্মাণকারী (সেই বাড়ির নিচ দিয়ে পালানোর জন্য বাংকার তৈরি), দৃশ্যমাণ আয়-উপার্জন না থেকেও শহরে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক, স্থানীয়ভাবে প্যারালাল থানাপ্রশাসন গড়ে তুলে ‘টর্চারসেল’ গঠন এবং বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার নামে দৈনিক ৫০ হাজার টাকা আদায়কারী, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণকারী, অবৈধ অস্ত্রের মজুদদার অঘোষিত যুবরাজ, রাঙ্গুনিয়ার ‘যুবলীগ ডন’ এখন কেমন আছেন? দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন শুনলাম-কার কাছে কী তথ্য আছে ইনবক্স করুন।’

এরপর একুশে পত্রিকা কার্যালয়ে এধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধীদের তথ্য-প্রমাণ আসতে থাকে। তথ্যগুলো যখন যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা শুরু হলে নিজেকে আড়াল করার জন্য উঠে পড়ে লাগে রাঙ্গুনিয়া যুবলীগের একটি অংশ। একুশে পত্রিকা সম্পাদকের পোস্টে কারো নাম উল্লেখ না থাকলেও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি সামশুদ্দোহা সিকদার প্রকাশ আরজু সিকদার বিষয়টি নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে কখনো ভুয়া আইডি খোলে আবার কখনো তার অনুগত লোকদের মাধ্যমে এবং কখনো তার আপন ভাতিজার আইডি থেকে ফেসবুকে একুশে পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে আপত্তিকর পোস্ট দিতে থাকেন।

সবশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলে একুশে পত্রিকা সম্পাদককে সরাসরি আক্রমণ করে ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগ নিয়ে কটূক্তিকারী’ উল্লেখ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের ব্যানারে স্থানীয় ইছাখালী এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে আরজু সিকদার। সেখানে আরজু সিকদার একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদারকে আক্রমণ করে প্রায় ৬ মিনিটের বক্তব্য দেন। পুরো বক্তৃতাজুড়ে ছিল একুশে পত্রিকা সম্পাদককে মেরে ফেলা, কেটে ফেলার হুমকি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের একাধিক নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, একুশে পত্রিকা সম্পাদকের যুবলীগ নামধারী অপরাধীর তথ্য আহ্বান করে দেয়া পোস্ট সুনির্দিষ্টভাবে নিজের ঘাড়ে কেন নিয়ে যাবেন যুবলীগ সভাপতি আরজু সিকদার, যদি তিনি সেইসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না থাকেন! কিংবা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর কেন তিনি (আরজু) নিজের প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন! তার কিসের এত ভয়? ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না”-ব্যাপারটি কি সেরকম? এমন প্রশ্নও করেন রাঙ্গুনিয়ার সাধারণ মানুষ।

অনেকে বলছেন, রাঙ্গুনিয়া যুবলীগ কিংবা যুবলীগের ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে বিক্ষোভ সমাবেশের নামে প্রকারান্তরে আরজু সিকদার নিজের অস্তিত্ব কিংবা জনপ্রিয়তা জানান দিতে চেষ্টা করলেও প্রকৃতপক্ষে শোডাউন করে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা যাবে কিনা সেটি সময়ই বলে দেবে।

বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুছ একুশে পত্রিকাকে বলেন, সংগঠন করি বলে আমাকেও যেতে হয়েছে। আমাকে ভুল বুঝে লাভ নেই। একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদারকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি, সম্মান করি। একুশে পত্রিকার সম্পাদকের কারো নাম উল্লেখ না করা পোস্টকে উছিলা করে, যুবলীগকে ব্যবহার করে আজকের বিক্ষোভ একধরনের স্ট্যান্টবাজি বলেও স্বীকার করেন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুছ।

এদিকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন রাশেদ তালুকদার নামে নিউজিল্যান্ড প্রবাসী রাঙ্গুনিয়ার এক স্থায়ী বাসিন্দা। ‘রাঙ্গুনীয়ার চাঁদাবাজ শিল্পপতি আরজু ও তার ছেলে মাফিয়া আশফাক’ শিরোনামে উক্ত স্ট্যাটাসে রাশেদ লিখেছেন, ‘আরজু সিকদার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে সৌদি আরব গিয়েছিল কাজের সন্ধানে। সেখানে সে কোন কাজ করতে পারেনি। এলাকার ছেলেপেলেদের বাসা অফিসে ঘুরে ঘুরে চলত টাকাপয়সা ধার নিয়ে চলত। কারো জামাকাপড় গেঞ্জি পেন্ট পছন্দ হলে পরার জন্য বলে আর ফেরত দিত না। সেই আরজু সিকদার এখন পাজেরো গাড়ি চালায়। কাজীর দেউরিতে আলিশান ফ্ল্যাট কিনেছে। গ্রামেও আলিশান বাড়ী।’

‘আয়ের খাত কি? ভুমি দখল থানার দালালি মাদক বিক্রির কমিশন। থানায় আরজুর কথা ছাড়া মামলা নেয়না। সে মিমাংসার কথা বলে বাদী বিবাদী দুই পক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়। থানার পাশে অফিসের নামে যে বিল্ডিংটা আছে সেটাও এক বড়ুয়ার সম্পত্তি মিমাংসা করে দিবে বলে নিজে দখল করে বসে আছে। রাঙ্গুনীয়াতে ইটভাটা, বালি উত্তোলন, মেলার জুয়া থেকে শুরু করে এমন কোন খাত নেই তার কমিশন ছাড়া। প্রতিটি খাত থেকে আরজু কমিশন নেয়। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। চাঁদাবাজি করে সে এখন শিল্পপতির কাতারে। আরজু যাকে বিয়ে করেছে সে একজন সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর মেয়ের পরিবার থেকে কেউ রাজি ছিলনা পরে আরজু দলবল নিয়ে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।’

রাশেদ তালুকদার আরও লিখেছেন, ‘তার ছেলে আশফাক এখন রীতিমত আতংকের নাম। তার কাজ হল স্কুল কলেজগামী মেয়েদের উত্যক্ত করা, চাঁদাবাজি করা। কিছুদিন আগে একটা মেয়ের সাথে অবৈধ মেলামেশা করতে গিয়ে ধরা খায় পরে এলাকাবাসী বিয়ে করিয়ে দেয়। এর বেশ কিছুদিন পর মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় এবং ওই পারিবারকে সে রীতিমতো হুমকির মধ্যে রাখে। সে চৌমুহনী, রওয়াজার হাট থেকে শুরু করে লিচুবাগান পর্যন্ত প্রত্যেক দোকানদার থেকে সে দলবল নিয়ে চাঁদাবাজি করে। কিছুদিন আগে পোমরায় একজন নীরিহ ব্যক্তির জায়গার দিকে আশফাক কুনজর দেয় চাঁদা দাবী করে। দলীয় কর্মীরাও বাপ পুতের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। এর শেষ দেখতে চাই রাঙ্গুনিয়াবাসী।’