চব্বিশে চবি সাংবাদিক সমিতি: ভাঙতে ভাঙতে ইস্পাত কঠিন


মাসুদ ফরহান অভি : তেইশ বছর। সময়টা কিন্তু কম নয়। জন্ম নিয়ে শিশুর আঠারো পেরোলে সে পা দেয় যৌবনে। শৈশব, কৈশর মাড়িয়ে সে তখন টগবগে যুবক। সংগঠন হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সাংবাদিক সমিতির বয়স আজ তেইশ। পা দিয়েছে চব্বিশে। সংগঠনটি পার করছে ভরা যৌবন। চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে, হাট-ঘাট মাড়িয়ে, পাহাড়-টিলা ডিঙিয়ে এই সংগঠন এখন পরিপূর্ণ। তার আর পেছন ফেরার ফুসরত নেই, নেই কোনো দাবানলের ধোঁয়ায় ধূসর হওয়ার সম্ভাবনা। যেতে যেতে থমকে যাওয়ার শংকা পালিয়েছে তার যোজন যোজন দূরে। এখন শুধুই এগিয়ে চলা।

আজ তার জন্মদিন। ১৯৯৬ সালের এই দিনটিতেই (৬ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতার কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে কিছু সাহসী সাংবাদিক এই সংগঠনটির গোড়াপত্তন করেছিল। যে আশায় এই গোড়াপত্তন সেই আশায় গুড়েবালি যে পড়েনি তা এখন শতভাগ নিশ্চিত। কখনো হায়েনার তালা, কখনো হুমকি, কখনো বোনা হয় ষড়যন্ত্রের জাল। কিন্তু কিছুই আঁচড় লাগাতে পারেনি এই আয়নায়। যে আয়নায় ফুটে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যা-সম্ভাবনা, দূর্নীতি-দুই নাম্বারি।

সত্য সাহসী সংবাদ প্রকাশ করায় ২০১৪ সালেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয় সমিতির তৎকালীন অর্থ সম্পাদক ফারুক আব্দুল্লাহকে। এসব মামলা, হামলায় মচকে না গিয়ে সমিতির সদস্যরা নিজেদের ভীতকে গড়েছে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়।
এই সমিতির আউটপুট প্রত্যাশার সীমা ছাড়িয়েছে বহু আগেই। টেলিভিশন চ্যানেল থেকে সংবাদপত্র, অনলাইন থেকে রেডিও। নের্তৃত্বে আসনের দিকে তাকালে দেশের গণমাধ্যমের প্রতিটি ভাঁজে মিলবে এই সমিতির ছায়া। কোথাও ব্যুরো প্রধান, কোথাও নিউজ এডিটর কোথাও বা জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। নিজম্ব প্রতিবেদকের দেখা মিলবে তো কদমে কদমে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংবাদিকতায় অপরাধ, রাজনীতি, পরিবেশ, ব্যবসা, কৃষি, গবেষণা, আইন, উদ্ভাবনসহ জাতীয় প্রেক্ষাপটের প্রায় সব বিষয়ের সাংবাদিকতার ট্রেনিং হয়ে থাকে হাতে-কলমে। হুমকি, চাপ কিংবা মজা- সব অভিজ্ঞতাই এখানে হাতের মুঠোয়। ছাত্রজীবনে অন্য কোনো পেশায় গিয়ে বাস্তব এমন অভিজ্ঞতার ঝুড়ি সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। কখনো রাজনৈতিক ব্লেইম, কখনো ধান্ধাবাজ, কখনো বা ছোটলোক। আবার কখনো মামলার আসামী, কখনো বহিষ্কার কিংবা কখনো ক্ষমতাচর্চার অপবাদ। আর এসব শুনতে শুনতে, এসব কাহিনী লিখতে লিখতে, কিছু চরিত্র দেখতে দেখতে, ধাক্কার পর ধাক্কা খেতে খেতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা পাক্কা হয়ে তবেই তৈরী হয় দেশের জন্য, দশের জন্য।

একটি মহল তবে ইর্ষান্বিত। তারা নিজের নাক কেটে এই অগ্রযাত্রায় ভঙ্গ দিতে চায় সবসময়। এই উদ্দেশ্যে করে যাচ্ছে তারা বিনিয়োগ এখনো। এই বিনিয়োগ মিথ্যের, এই পুঁজি ষড়যন্ত্রের। ইতোমধ্যে নিজেদের সুন্দর চেহারায় ধরিয়েছে তারা আগুন। চোখের নিচে লাগিয়ে ফেলেছে অপশক্তির কালিমা। শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ডা, তথ্য গুম করে লুটপাট কিংবা নিজের ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে গিয়ে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার প্রচীরে ফাটল ধরাতে তৎপর হয়েছিল তখন তারা। এখনো তারা সক্রিয় নীরবে। সুযোগের অপেক্ষায়। বারবার বুনো শকুন সেজে কিছু মানুষ চেষ্টা করেছে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার ঐতিহ্য মুছে দিতে। ধারাবাহিকতাকে ঘুরিয়ে দিতে। অগ্রযাত্রার পথে দেয়াল দিতে। নিজের ডানায় ফুটো রেখে অন্যের ঘর উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় তারা। ভুল করে তারা। পারেনিও তারা। নিচতলা থেকে ছয়তলা।

অবাক করা বিষয়, কোথাও শোনা গেছে ভালবাসার গান। কোথাও বোনা হয় ষড়যন্ত্রের বিস্তীর্ণ জাল। কোথাও আশারা দিচ্ছে উঁকি, কেউ হতাশ হয়ে দিয়েছে হুমকি। কেউ বিছিয়েছে ষড়যন্ত্রের জাল, ভালোবেসে কেউবা জড়িয়েছে মায়ার জালে। শুধুমাত্র সৎ সাহস, পেশাদরিত্বের নজির আর নৈতিক ঐক্যের জায়গায় সবাই এক ছিল বলেই এই সংসার টিকে গেছে সগৌরবে।

কবির ভাষায় যদি বলি,
পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙে ঢেউ
ভাঙতে ভাঙতে জানি, গড়ে যায় কেউ।

এই সমিতির সদস্যরাই সেই গড়ে দেওয়ার কারিগর। গড়তে গড়তে তারা ভেঙে দেয় তাদের পাজর, যারা সভ্যতার মুখোশ পরে চর্চা করে অসভ্যতা, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতার ফেরিওয়ালা সেজে বিক্রি করে দেয় বিবেকবোধ, বিচারকের আসনে বসে যারা করে অবিচার, ক্যাম্পাসের রক্ষক হয়ে ক্ষমতার মোহে হয়ে যায় ভক্ষক, ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা যুক্তি দিয়ে পড়িয়ে, শ্রেণী কক্ষের চৌহদ্দি পার হলেই যারা লুট করে সেই অধিকার তাদের শোধরাতেই এই সমিতর সদস্যরা যোগ্য হয়ে উঠে, কলম চালায়। অত্যাচারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে নির্যাতিতের বিরুদ্ধে যারা দেয় শাস্তির রায়- সমিতির সদস্যরা তাদের মসনদ ভেঙে দেয়। এই ছোট ছোট হাতগুলোই গড়ে তুলে পৃথিবীর বিচিত্র সব স্বপ্ন। যে স্বপ্নে ডানায় ভর করে চলে দাম্ভিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ হাজার শিক্ষার্থী।

প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ২০১৪ সালেই আয়োজন করেছিল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসব। আমি শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির ২০১৪ বর্ষের কার্য-নিবার্হী সভাপতি হুমায়ুন মাসুদ ও সাধারণ সম্পাদক তাসনীম হাসানকে। যারা প্রথমবারের মত এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের শুভ সূচনা করে দিয়েছিলেন। যে কমিটির নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলাম আমি।

মাত্র ২৪ ঘন্টার ডাকে সাড়া দিয়ে চাকসু কেন্দ্রে আয়োজিত আমাদের ছোট এই উৎসবে শামিল হয়েছিলেন তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, উপ-পাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, রেজিষ্ট্রার, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির ডিন, সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আজগর চৌধুরী, জিয়াউর রহমান সোহেল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন আহমেদসহ অসংখ্য শুভাকাঙ্খী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধিকার আদায়ের সূতিকাগার অকার্যকর চাকসুর বিকল্প হিসেবে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে চলেছে চবি সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা। চবিতে একমাত্র সংগঠন এটিই যারা প্রতিবছর ব্যালট-ভোটে তাদের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে আসছে দুই যুগ ধরে৷ চবি সাংবাদিক সমিতিই একমাত্র প্লাটফর্ম যেখানে সকল ছাত্রসংগঠন বছরে একবার হলেও অন্তত মিলিত হয়, বুকে বুক লাগিয়ে যায়। গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম একটি পাঠশালাও এই সমিতি। সাংবাদিক সমিতি হোক চবি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের পাথেয়। সমিতির পথ চলা শুভ হোক, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া হোক সবকটি অশুভ বুনো শকুন।

লেখক: সাবেক সহ সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
ও প্রাক্তন চবি প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল।