চট্টগ্রামে মেয়র মনোনয়ন, বিএনপিতেও আসতে পারে চমক

চট্টগ্রাম : মেয়র পদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পথ ধরে হাঁটতে চায় বিএনপি। খুব বেশি আলোচিত নয়, কিন্তু সার্বিক যোগ্যতায় এগিয়ে, এমন কাউকে মনোনয়ন দিয়ে সৃষ্টি করতে চায় চমক। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী মহলের একাধিক সূত্রে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে।

আগামি ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের এ সংক্রান্ত সভা থেকে আসতে পারে এই চমক। এ লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণী ফোরাম চমক সৃষ্টি কাকে দিয়ে হতে পারে ইতোমধ্যে সেই পর্যালোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।

নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, বিএনপি চট্টগ্রাম নগর কমিটির সহ সভাপতি, তিনবারের নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিয়াজ মোহাম্মদ খান, বিএনপির পদত্যাগী নেতা (সম্প্রতি দলে ফেরা) চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নার্সিং ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও জাতীয়তাবাদী ঘরানার চিকিৎসক সংগঠন ড্যাব-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লুসি খান।

জানা গেছে, বিএনপি নীতি-নির্ধারণী ফোরাম মনোনয়ন-প্রত্যাশী এই পাঁচজনকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। এই পাঁচজনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, একই সঙ্গে জনসম্পৃক্ততার পাশাপাশি দলের জন্য ত্যাগ-অবদান, রাজনৈতিক কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়া, পারিবারিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, অতীতে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ইত্যকার বিষয়গুলো নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের আলোচনা-বিশ্লেষণে উঠে আসছে এমনই তথ্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

বিশ্লেষকদের মতে, ৫৩ বছর বয়সী ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি থেকে ওয়ার্ড, থানা বিএনপির রাজনীতি করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এক-এগারোর সময় ‘মাইনাস টু ফর্মূলা’ সামনে রেখে অনেক বড় বড় নেতা যখন সংস্কারপন্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ কিংবা আত্মগোপনে, তখন মধ্যমসারির নেতা ডা. শাহাদাত হোসেনই রাজপথে সরব থেকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। সভাপতি হিসেবে নগর বিএনপির হাল ধরার পাশাপাশি কারাবন্দী, নির্যাতিত নেতাকর্মীদের নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন শাহাদাত। অসংখ্যবার কারানির্যাতিত বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে অন্তত ৪০ টি মামলা চলমান। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকা থেকে তিনি গ্রেফতার হন। জেলে থেকেই বিএনপির টিকিটে চট্টগ্রাম কোতেয়ালী আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হন। শাহাদাতের দুই চাচাই পাকবাহিনীর হাতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন, বাবাও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল-এই আলোচনাগুলোও মনোনয়ন ইস্যুতে সামনে আসছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ৫৫ বছর বয়সী আবুল হাশেম বক্কর চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনীতি করে একসময় যুদবল নগর কমিটির সভাপতি হন। সেখান থেকে বিএনপি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ; সাধারণ সম্পাদকে আসীন হন। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খাটেন একাধিকবার। তার বিরুদ্ধেও আছে অসংখ্য মামলা। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েও চট্টগ্রাম নগরে দলের সব নেতাকর্মীদের আশ্রয় কিংবা ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে না পারার বিষয়গুলো মনোনয়ন-ইস্যুতে সামনে উঠে আসছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মনোনয়ন-আলোচনায় হঠাৎ করেই সামনে চলে এসেছেন ৬৫ বছর বয়সী নিয়াজ মোহাম্মদ খান। ১৯৯৪, ২০০৫ ও ২০১০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৩ নং উত্তর পাঠানটুলি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনবারই বিপুল ভোটে জিতেন তিনি। চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট নিয়াজ মোহাম্মদ খান ১৯৭৯ সালে যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া যুব কমপ্লেক্স, ডবলমুরিং থানার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরবর্তীতে জাসাস চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্ববায়ক, কেন্দ্রীয় জাসাসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, ডবলমুরিং থানা বিএনপির সভাপতি এবং পর্যায়ক্রমে নগর বিএনপির ২১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পরে নগর বিএনপির সহ সভাপতি হন এবং বর্তমানে সেই পদে আসীন তিনি।

এছাড়া সিডিএ’র তিনবারের বোর্ড মেম্বার, একাধিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত নিয়াজ খানের আরেকটি প্লাস পয়েন্ট তিনি শহরের পাঠানটুলি এলাকার আদি বাসিন্দা এবং বিখ্যাত খান পরিবারের সন্তান। তার পিতা প্রয়াত আকরম খান বনেদী ব্যবসায়ী, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী দাদা মৌলভী মো. আমানত খান ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের আলোচিত রাজনীতিবিদ। ১৯২৬ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একইভাবে তার চাচা আশরাফ আলী খানও ছিলেন রাজনীতিবিদ, শ্রমিক নেতা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবারও না হারা, পারিবারিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার পাশাপাশি তৃণমূল থেকে উঠে আসা সজ্জন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়াজ খানের নাম মনোনয়ন ইস্যুতে আলোচনার সামনে উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬ মেয়াদে দুইবার এবং বর্তমানে মেয়াদে দুইবার রাজনৈতিক মামলায় জেলে যেতে হয়েছে তাকে। জানা গেছে, এগুলোও বিবেচনা হচ্ছে তার আমলনামা হিসেবে।

২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তৎকালীন হেভিওয়েট নেতা মোরশেদ খানের মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় প্রার্থীসঙ্কট দেখা দিলে মনোনয়ন পান দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা এরশাদ উল্লাহ। পরবর্তীতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিস্কৃত হয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন দল-বিচ্ছিন্ন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে বহিস্কৃত অবস্থাতেই দলের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। দল মনোনীত প্রার্থী চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের আশ্বাসে শেষপর্যায়ে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন এরশাদ উল্লাহ। সেই থেকে দলে ফিরলেও এরশাদ উল্লাহর প্রায় দীর্ঘ একদশকের রাজনীতি-বিচ্ছিন্নতা মনোনয়ন ইস্যুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনীতি-বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, একমাত্র নারী মনোনয়ন-প্রত্যাশী ডা. লুসি খান চট্টগ্রামের রাজনীতিতে খুব বেশি পরিচিত মুখ না হলেও আপাদমস্ত বিএনপি পরিবারে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা। চিকিৎসাবিদ্যায় বিদেশে পড়তে গিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন মহিলা দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সুবাদে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার।  ইউএসটিসিতে ডাক্তারি পড়ার সময়  মোরশেদ খানের উৎসাহে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া লুসি খান বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর দেশে ফিরে বিএনপি ঘরানার বিএমএ ও ড্যাব-এর সাথে সম্পৃক্ত হন। হন ড্যাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন লুসি খান। বিএনপির পদত্যাগী নেতা মোরশেদ খান, জহির উদ্দিন খান, একে খান, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-এই পরিচয়টিও লুসি খানের মনোনয়ন-বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে বলে বিএনপির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিএনপির নীতি-নির্ধারণী মহলের আভাস, চট্টগ্রামের মেয়র মনোনয়নের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন ও ‘চমক’ এর বিষয়টি এবার জোরেশোরে প্রাধান্য পেতে পারে। তাই যদি সত্য হয়, জীবনের কোনো নির্বাচনে না হারা সরল, মাঠপর্যায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা-যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠা নিয়াজ মোহাম্মদ খান অথবা মেধাবী চিকিৎসক লুসি খানের কপাল খুলতে পারে। আর সেটাই হতে পারে বড় ‘চমক’।

বিষয়টির সঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত পোষণ না করে বিএনপির অন্যতম মনোনয়ন-প্রত্যাশী ডা. শাহাদাত হোসেন কয়েকদিন আগে একুশে পত্রিকাকে বলেন, কিছুদিন আগে দল থেকে আমাদের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, এক পদে যারা আছে তাদের অন্য কোনো পদে নাও রাখা হতে পারে। অর্থাৎ মনোনয়ন প্রদানের বেলায় দায়িত্বশীল পদের বাইরে থেকেও কাউকে বিবেচনা করা হতে পারে কিছুটা এমন আভাস পেয়েছিলাম।

তবে আমি মনে করি দল কাকে মনোনয়ন দেবে সেটি সম্পূর্ণ দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের এখতিয়ার। আমি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মী। দলের দুর্দিন-দুঃসময়ে রাজনীতি করেছি। এখনো প্রতিনিয়ত জেল-জুলুম মামলা হামলা, নির্যাতন সয়ে দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে রাজপথে সোচ্চার আছি। কঠিন পরিস্থিতিতেও দলের নেতাকর্মীদের আগলে রেখে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। নগরের আনাচে-কানাচে আমার বিচরণ। অলি-গলি পথঘাট সব আমার চেনা। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সাথে আমার চমৎকার সম্পর্ক। এসব বিবেচনায় আমিই মনোনয়ন পাবো বলে দৃঢ় আশা। এরপরও দল যদি অন্য কাউকে যোগ্য বিবেচনা করে সেক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই নেই। দলের সিদ্ধান্তই মেনে নেবো।

সূত্র মতে, মনোনয়নের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তারেক রহমান। মনোনয়ন-বিবেচনায় তিনি কোন ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় আনছেন, মাঠের যোগ্যতার চেয়ে অন্য যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিবেন, নাকি গতানুগতিক হিসাব-নিকাশ করবেন সেটি একান্তই তার বিষয়।

আগামি সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের সাথে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতে পারেন বলে জানা গেছে। মূলত এরপরই মনোনয়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। আর সে সিদ্ধান্তটি জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সোমবার রাত অথবা মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত।

এদিকে আজ (শনিবার) দুপুরে ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় মনোনয়ন বোর্ডে অনুষ্ঠেয় সাক্ষাৎকারের বিষয়টি পাঁচ মনোনয়ন-প্রত্যাশীকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকতে টেলিফোন পেয়েছেন জানিয়ে নিয়াজ মোহাম্মদ খান ও ডা. লুসি খান শনিবার রাতে একুশে পত্রিকাকে বলেন, আজ দুপুরে ২টার দিকে ফোন করে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে আমাদের বলা হয়েছে। আমরা যথাসময়ে মনোনয়ন বোর্ডে উপস্থিত হবো। মনোনয়নের ক্ষেত্রে গতানুগতিক সংস্কৃতি ছাপিয়ে গুণগত পরিবর্তনের যে আভাস পাচ্ছি তা যদি হয় তাহলে তারাই মনোনয়ন পাবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ আলোচ্য দুই মনোনয়ন-প্রত্যাশীর।