কমিকস ‘নন্টে-ফন্টে’র ৫০ বছর ও শিশুসাহিত্যিক নারায়ণ দেবনাথ

জ্যোতির্ময় ধর : নব্বই-এর দশকে যাদের কেটেছে কৈশোর ও শৈশব, তাঁরা অবশ্যই বাংলা কমিকস ‘নন্টে-ফন্টে’র সাথে পরিচিত। দেখতে দেখতে পঞ্চাশটা বছর অতিক্রম করে ফেললো বাঙালির জনপ্রিয় কমিক্স ‘নন্টে-ফন্টে’। বইয়ের পাতায় কার্টুন চিত্রে ‘নন্টে-ফন্টে’ কমিক্স আজও বাঙালি সমাজে চিরন্তন। সাহিত্যিক নারায়ণ দেবনাথের অমর সৃষ্টি ‘নন্টে-ফন্টে’। বাঙালি বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের আজও সমান মজাদান করে ‘নন্টে-ফন্টে’। প্রাণখুলে হাসতে চাইলে ‘নন্টে-ফন্টে’র জুড়ি মেলা ভার। বাংলার শহর থেকে গ্রামাঞ্চল প্রতিটি জায়গায় সমান জনপ্রিয় ‘নন্টে-ফন্টে’৷ এই কমিক্সের নন্টে-ফন্টে চরিত্র দুটো বেশ হাস্যকর তার থেকেও আরো বেশি হাস্যকর কেল্টুদা। সকাল থেকে রাত যার দস্যিপনা চলতে থাকে। দিনের শেষে মাস্টারমশাই এর কাছে কখনো বেতের বাড়ি খায় সে আবার কখনো মাস্টারমশাই তার ওপর ফুলদানি ছুঁড়ে মারে। নন্টে-ফন্টে পর্যন্ত তাকে জব্দ করতে ছাড়ে না। কখনো তাকে নকল বাঘ সেজে প্রবলভাবে ভয় দেখায়। কেল্টুটা হাজার চেষ্টা করেও নন্টে-ফন্টেকে শায়েস্তা করতে পারে না। নন্টে-ফন্টের সাথে কেল্টুদার দুষ্টুমি চললেও তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুতা অটুট থাকে।

শিশুদের কি শুধুই মজার গল্পই শুনিয়েছেন নারায়ণবাবু? নাকি চরিত্রগুলোর মধ্যে হাস্যরসের মাধ্যমে গভীরতর কোনও অর্থ বলতে চেয়েছেন? নীতিশিক্ষা দিয়ে বলতে চেয়েছেন, কেল্টু যতই তেল মারুক আর নালিশ করুক, শেষবেলায় তাকেই অপদস্থ হতে হয়। কপালে জোটে ফুলদানি ছুড়ে মার অথবা বেতের বাড়ি। অথবা স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট স্যর পাতিরাম হাতির কেল্টুর প্রতি বেশির ভাগ সময়ে পক্ষপাতিত্ব দেখানোর পরেও কেল্টুর জন্য তাঁকে কমিকসের শেষ দৃশ্যে অনেক সময়ই নাজেহাল হতে হয়। তখন সুপারিনটেনডেন্ট স্যরকে উদ্ধার করার দায়িত্ব সেই নন্টে আর ফন্টের। কে ভাল, কে খারাপ, কে ওপরচালাক, কে নালিশবাজ, কে পক্ষপাতদুষ্ট— নন্টে-ফন্টে কমিকসের মধ্যে মজার ছলে এ সব শিখে নেওয়ার কৌশলই কি শিশুদের শিখিয়ে দিয়েছেন নারায়ণবাবু?

চলতি বছরে পঞ্চাশ বছরে পা দিল ‘নন্টে-ফন্টে’। ১৯৬৯ সালে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘নন্টে-ফন্টে’। প্রায় পঞ্চাশ ধরে যত্ন সহকারে নিজের হাতে ছবি এঁকে ও গল্প লিখে সাহিত্যিক নারায়ণ দেবনাথ জীবন্ত করে তুলেছেন ‘নন্টে-ফন্টে’ কমিক্সকে। নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট চরিত্রগুলি নিতান্তই সহজ সরল। সেখানে নেই কোনও বিদ্বেষ, নেই কটাক্ষ, নেই দুঃখ, নেই রাজনীতি । আছে শুধু ছোটোদের অ্যাবসার্ড হিউমারের মজা । সুন্দর গল্প, ছাপা অক্ষরের মতো ঝরঝরে হাতের লেখায় জোরালো সংলাপ এবং অবশ্যই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন আঁকা তাঁর সৃষ্টির মূলধন । অদ্ভুত সব মজাদার শব্দে তাঁর কমিকসে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ আমাদের সহজেই আকৃষ্ট করে।

যেমন, বোমা ফাটার আওয়াজকে তিনি ভাষায় প্রকাশ করেছেন গুড়ুম শব্দে, বিস্বাদ জাতীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ওয়াক থুঃ শব্দে, সারমেয়দের উত্তেজিত অবস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন গররররর… শব্দ, হাসির ক্ষেত্রে হা হা, হি হি, হো হো, প্রভৃতি নানান শব্দকে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে ব্যবহার করেছেন। এরকম আরও অনেক উদাহরণই আছে। এখানেই তাঁর সৃজনশীলতা। গল্পের ভাষাও কখনও কৃত্রিম মনে হয় না । ছোটোদের মুখে ছোটোদের ভাষা আবার বড়দের মুখে বড়দের ভাষা ঠিক ঠিক ভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন । কমিক রিলিফের জন্য তিনি কখনই শালীনতার মানকে অতিক্রম করে যাননি । এখানেই তাঁর জয়, আর এখানেই তাঁর বিশেষত্ব।

বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ণ দেবনাথের আগমন ঘটে ১৯৪৯-১৯৫০ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মণ্ডলীর উৎসাহে। তাঁর প্রথম কমিকস “হাঁদা ভোঁদা” নামটিও তাঁদের প্রস্তাবিত। এর আগে কুমারসম্ভবের বাংলা অনুবাদের বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের কাজ প্রকাশনা জগতের সাথে যুক্ত কর্তা-ব্যক্তিদের নজর কাড়ে । তারপরেই জোটে তৎকালীন বিখ্যাত দেব সাহিত্য কুটিরের ইলাস্ট্রেটরের কাজ। প্রথম ইলাস্ট্রেটর হিসেবে তিনি তৎকালীন বিখ্যাত শুকতারা পত্রিকার তিনটি ছবি এঁকে ৯ টাকা পারিশ্রমিক পান। এরপর একের পর এক গল্পের ছবি, বইয়ের মলাটের ইলাস্ট্রেশনের কাজ তিনি করতে থাকেন । প্রতুল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের ছবি আঁকার আদর্শ মনে করতেন তিনি।

১৯৬২ সালে শুকতারা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর জনপ্রিয় কমিকস হাঁদা ভোঁদার । হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠকদের বিপুল সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে তিনি নিজেই অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তা গ্রে-স্কেলে প্রকাশ করা হয় । ২০১২ সালেই  হাঁদা-ভোঁদা ৫০ বছর পার করেছে। নারায়ণবাবুর বাবার সোনা-রুপোর দোকান ছিল। সেই দোকানে গিয়ে মাঝেমধ্যে বসতেন নারায়ণবাবু। বসে বসে দেখতেন পাড়ার ছেলেদের কাণ্ডকারখানা। ‘হাঁদা ভোঁদার কাণ্ডকারখানা’য় উঠে এসেছিল সে সবই। হাঁদার পুরো নাম হাঁদারাম গড়গড়ি, ভোঁদার— ভোঁদা পাকড়াশী। সঙ্গে আছেন তাঁর পিসেমশাই, বেচারাম বকশি। নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা-ভোদার প্রথম গল্পের নাম ছিল ‘হাঁদা ভোদার জয়’। গল্পের বিষয়বস্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ।

গোলাপি রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি পরা, সঙ্গে কালো রঙের হাফপ্যান্ট। খালি পা। বাঁটুলের সঙ্গে থাকে তার দুই ভাগ্নে, ভজা ও গজা। প্রথম দিকে বাঁটুল তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও পরে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঁটুলকে এনে ফেলেন নারায়ণবাবু। মহাশক্তিমান বাঁটুলকে দেখা যায় শত্রু সেনার যুদ্ধজাহাজ, প্লেন, ট্যাঙ্কার ধ্বংস করতে। যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঁটুলের কমিকস উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হতে থাকে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই কমিকসের চলার পথে বাঁটুলের চেহারাতেও বদল এসেছে। বাঙালি সুপারহিরোর কোমর আর পা আরও সরু হয়েছে। বেড়েছে বুকের ছাতি।

সেসময় অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল- লেখক কার আদলে তৈরি করেছেন ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের প্রধান চরিত্র বাঁটুলকে। অনেকেই ধারণা করতে থাকেন, পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত ব্যায়ামগীর মনোহর আইচের আদলে তৈরি করা হয়েছে বাঁটুলকে। হয়তো লেখকের চরিত্র অঙ্কনে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও অকল্পনীয় শক্তি, বীরত্বে গাঁথা বাঁটুলের তুলনা একমাত্র সুপার হিরোদের সাথেই করা যায়। এখনো পর্যন্ত বাঙালির নিজস্ব সুপারহিরো কিন্তু বাঁটুলই। কেউই তার একনায়কত্বে ভাগ বসাতে আজও পারেনি।  কীভাবে তৈরি হলো এই কমিক্সের চরিত্র? কী বিষয় মাথায় রেখে লেখক নারায়ণ দেবনাথ বাঁটুলের এই চরিত্রটি অঙ্কন করেছেন? লেখক নারায়ণ দেবনাথ এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, একবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের চরিত্রটি কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। যদিও তিনি শুরুতে বাঁটুলকে কোনো অলৌকিক শক্তি (সুপার পাওয়ার) দেননি। পরবর্তী সংখ্যাগুলাতে লেখক ধীরে ধীরে বাঁটুলকে একজন প্রচন্ড শক্তিশালী মানুষ হিসেবে তুলে ধরেন। গুলি দিয়ে বাঁটুলকে আঘাত করা যায় না, মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় এক ফোঁটা জল পড়ল, মাথায় নারকেল পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তার পোশাক-আশাক মোটেও প্রচলিত সুপারহিরোর মতো নয়। গোলাপী স্যান্ডো গেঞ্জি ,কালো হাফপ্যান্ট তার একমাত্র পোশাক। বাঁটুল সবসময় খালি পায়েই থাকে। কারণ জুতো পরলেই নাকি ছিঁড়ে যায়। তার আছে দুই স্যাঙাত যাদের নাম বিচ্ছু ও বাচ্ছু, কখনও কখনও তাদের নাম গজা ও ভজা বলেও পরিচিতি পেয়েছে। তারা সবসময়েই ব্যস্ত থাকে কিভাবে বাঁটুলকে জব্দ করবে, কিন্তু শেষে নিজেরাই জব্দ হয়।

বাঁটুলের প্রতিবেশী হলেন বটব্যাল বাবু ও তার চাকর। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গেও বাটুলের বন্ধুত্ব। বাঁটুলের আরেক অনুগত সৈনিকের নাম লম্বকর্ণ। আর বাঁটুলের পোষা কুকুরের নাম ভেদো, পোষা উটপাখির নাম উটো। সে সৎ ও দেশপ্রেমী। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁটুলকে নামানো হল ওয়ার ফ্রন্টে। সে দেশের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। বাঁটুলের প্রচণ্ড শক্তি মাঝে মাঝেই তার প্রতিবেশীদের সমস্যার কারণ হয়। নারায়ণ দেবনাথ তার তুলির ছোঁয়ায় এই কমিক্সকে অসামান্য করে তুলেছেন। সমসাময়িক বিষয় থেকে শুরু করে নানা মজাদার বিষয় ছিল এই কমিক্সের প্রাণ। মজার ছলে লেখক অতি সিরিয়াস কথাকে সহজেই পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতেন যা এক কথায় অনন্য।

১৯৬৯ সালে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে নন্টে-ফন্টে। ‘শুকতারা’র হাঁদা-ভোঁদার পাল্টা কমিকস চালু করতে ওদের মতোই দুই বিচ্ছু ছেলের চরিত্র নন্টে আর ফন্টেকে সৃষ্টি করেন নারায়ণ দেবনাথ। এমন দুই কিশোর, যারা প্রায়ই একে অন্যের পিছনে লাগে, মজা করে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নন্টে-ফন্টে কমিকসের চরিত্র ছিল অনেকটা হাঁদা-ভোদার মতোই। ১৯৭২ সালে এসে নন্টে-ফন্টে কমিকস পাল্টে যায় অনেকটা। এ বার যোগ হয় নন্টে-ফন্টের হোস্টেল জীবন, হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট আর কেল্টুদার মতো চরিত্র।     এই পাল্টে যাওয়ার পিছনেও গল্প আছে। কমিকস লেখা ও ছবি আঁকার পাশাপাশি প্রচুর বই ও পত্রপত্রিকার অলঙ্করণের কাজও করেছেন নারায়ণ দেবনাথ। শিল্পী হিসাবে বইবাজারে যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। ১৯৭২ সালে একটি গল্পের বইয়ের অলঙ্করণের কাজে হাত দেন তিনি। বইয়ের নাম ‘পরিবর্তন’, লেখক মনোরঞ্জন ঘোষ। এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে।

বাংলা চলচ্চিত্রও হয়েছিল এই বই থেকে। পরে সেই চলচ্চিত্রের হিন্দি রূপান্তর হয়, ‘জাগৃতি’ নামে হিন্দি চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। বাংলা বইটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অনেক পরে ১৯৭২ সালে বইটি যখন পুনর্মুদ্রিত হয়, সেই বইয়ের অলঙ্করণ করেন নারায়ণ দেবনাথ। অলঙ্করণের সময় তিনি দেখতে পান, গল্পে রয়েছে দুই বালকের হোস্টেল-জীবনের কথা। রয়েছে হোস্টেলের এক মোটাসোটা সুপারিনটেনডেন্টের কথা, যিনি খেতে খুব ভালবাসেন; বা হোস্টেলের এক রাঁধুনির কথা, যার রান্নাঘর থেকে মাঝেমধ্যেই খাবার চুরি হয়। এই সব মজার দৃশ্য আঁকতে আঁকতেই তাঁর মনে হয়, এমন মজার ঘটনা নন্টে-ফন্টের কমিকসে নিয়ে এলে কেমন হয়? এর পরেই ১৯৭৩ সালে নন্টে-ফন্টের গল্পে যোগ হয় হোস্টেল, সুপারিনটেনডেন্ট স্যর, রাঁধুনি এবং বিখ্যাত চরিত্র কেল্টুরাম।

তিন ডাকসাইটে কমিকসের মধ্যে নারায়ণবাবুর প্রিয় সন্তান বাঁটুল। সৃজনশীল নারায়ণ দেবনাথের তুলিতে এবং কলমে আজও হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল, কিংবা নন্টে ফন্টে –রা সমানভাবে সাবলীল । আজ প্রায় ৯৫ বছর বয়সেও নারায়ণ দেবনাথ মেতে আছেন সৃষ্টির খেলায়। কোলকাতার হাওড়ার শিবপুরের পৈতৃক বাড়িতে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহন করেন নারায়ণ দেবনাথ । স্বাধীনতার বহু পূর্বেই তাঁদের পরিবার পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের মুন্সিগঞ্জ থেকে শিবপুরে চলে আসেন । পিতা হেমচন্দ্র দেবনাথ ও তাঁর এক কাকার যৌথ প্রচেষ্টায় তাঁদের একটি সোনার দোকান (কমলা শিল্পালয়) গড়ে উঠে শিবপুরে । আঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁক সবকিছুকেই হার মানায় । বাড়ির দেওয়ালগুলি পর্যন্ত তাঁর হাত থেকে নিস্তার পায়নি । তাই হাওড়ার শিবপুরের অনিলবাবুর পাঠশালা এবং পরে বি কে পাল ইন্সটিটিউশনে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস –এ পেইন্টিং নিয়ে আঁকার প্রশিক্ষণ শুরু করেন । তখন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল । তাই শেষ পর্যন্ত ছয় বছরের কোর্সের শেষ বছরের পরীক্ষা দিতে পারেননি । তবে সেই সময় আর্টিস্টদের সেরকম কাজের সুযোগ ছিল না । তাই আর্ট-কলেজ থেকে বেরিয়ে নারায়ণ দেবনাথ কয়েক বছর প্রসাধন দ্রব্য নির্মাতাদের জন্য ছোটোখাটো আঁকার কাজ (যেমন – পাউডার, আলতা, লোগো, সিঁদুরের বাক্সের নকসা, প্রভৃতি) করেছেন । হরফ শিল্পী হিসেবেও তিনি গরানহাটা ও ধর্মতলার দুটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন কাজ করেছেন । তারপর কিছুদিন জীবনতৃষ্ণা, স্বরলিপি, কমললতা, প্রভৃতি সিনেমার টাইটেল কার্ড বানানোর কাজও করেছেন ।

এই শিল্পী যে ভাবে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একা হাতে কমিকসের ছবি এঁকেছেন, সঙ্গে লিখেছেনও— বিশ্বের কমিকসে এমন উদাহরণ আর ক’টা আছে? এতো দীর্ঘদিন ধরে কোনো কমিক্স বেঁচে থাকার নজির কমিক্সের দুনিয়াতেও খুব বেশি একটা নেই।  সম্প্রতি যেমন একটা ঘটনা হয়েছে যে অ্যাসটেরিক্স কমিক্সের ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে যেটা নিয়ে কভার স্টোরি করা হয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে অ্যাসটেরিক্স কমিক্সের ৬০ বছর হয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে তার বাজার, তার বিক্রি। এমনকি তার সেলিব্রেশন হয়। ওদের ওখানে এটা নিয়ে সেমিনারও হয়। বেলজিয়ামে এটার এক্সিবিশন হয়, এটার মিউজিয়াম আছে, এটা নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুতুল বিক্রি করা হয়। এখানে অনেক রকম বাণিজ্যিক এবং ইনভলভমেন্টটা অনেক বেশি৷ এখানের মানুষ অনেক বেশি সতর্ক ও আগ্রহী৷ বেলজিয়াম থেকে অ্যাসটেরিক্স বের হয়, ফ্রান্স থেকে টিনটিন বের হয়। এদের একটা বিরাট বড়ো মার্কেট রয়েছে। ওখানে একটা কমিক্স বানানোর জন্য বড়ো একটা টিম কাজ করে। কেউ একজন লেখে, কেউ একজন আঁকে। আর তার বাজার হচ্ছে অনুবাদের মার্কেট যা সারা পৃথিবী জুড়ে বিক্রি হয়। ফ্রেঞ্চ থেকে টিনটিন ত্রিশ-চল্লিশটা ভাষায় অনুবাদ হয়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড কোনো একটা কোম্পানির মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুড়ে তার মার্কেট ছড়িয়ে পড়ে ৷

আর আমাদের নারায়ণবাবুর নন্টে-ফন্টে , বাঁটুল , “হাঁদা ভোঁদা” এরা সবাই রিজিওনাল কমিক্স তার মার্কেট শুধু রিজিওনালনেসির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।৷ এটাই হচ্ছে ঘটনা। নারায়ণবাবু একটা প্রান্তিক এলাকা হাওড়াতে বসে,  একটা মানুষ যখন একা একা ছবি আঁকছেন, একা একা গল্পও লিখছেন, আবার একা একা রঙ করছেন, আবার একা একা বইয়ের যে কভারটা হয় সেটাও তিনি নিজে করছেন। তারপর পঞ্চাশ বছর ধরে উনার কমিক্স গুলো নিয়ে একাধিক প্রজন্মকে আনন্দ দিয়েছেন। এটা তো আরো অনেক বড় ব্যাপার।

২০১৩ সালে নারায়ণ দেবনাথকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বঙ্গ বিভূষণ সম্মাননা প্রদান করেছে । ১০ই মে ২০১৩ তে, পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী একটি চিঠিতে তাঁকে লেখেন – আপনি বাংলা কমিকসের কিংবদন্তী । ছবিতে গল্পকার হিসেবে আপনার আসনটি স্বতন্ত্র । দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও অধিক সময় ধরে আপনার সৃষ্টি করা বিভিন্ন কমিকস ছোটো বড়ো সবার কাছে সমান জনপ্রিয়…  এরপরই আসে আরও একটি স্বীকৃতির খবর । ২৩ শে আগস্ট ২০১৩ তে, সাহিত্য আকাদেমির সচিব ডঃ কে শ্রীনিবাস রাও একটি চিঠিতে তাঁকে জানান ২০১৩ সালের বাল সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত করা হবে তাঁকে । ১৫ই নভেম্বর ২০১৩, পানাজি, গোয়ায় এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়।

প্রসঙ্গতয, ২০০১সালে উদয়ন ভট্টাচার্য –এর উদ্যোগে প্রথম তৈরি হয় হাঁদা ভোঁদা টেলি এপিসোড । ২০০২ সালে সন্দীপন বর্মণের পরিচালনায় নির্মিত হয় নন্টে ফন্টে টেলি এপিসোড । অ্যানিমেশনে হাঁদা ভোঁদা ও বাঁটুল দি গ্রেট তৈরি করেন অজয় সেনশর্মা এবং নন্টে ফন্টে তৈরি করেন সৌরভ মণ্ডল । ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম নারায়ণ দেবনাথের উপর ডকুমেন্টরি ফিল্ম নির্মাণ করেন উজ্জ্বল কুমার দাস পরে পার্থ প্রতিম চট্টোপাধ্যায়ও একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম নির্মাণ করেন ।

নারায়ণবাবু অবশ্য এ সব নিয়ে ভাবিত নন। প্রশ্ন করলে শুধু মুচকি হেসে বলেন, “মানুষের ভালবাসা পেয়েছি অফুরন্ত। আমার চরিত্র বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের কাছে প্রিয়। এটা কম নাকি? এই ভালবাসা ক’জন পায়?”

লেখক : প্রকৌশলী , জার্মান ইন্সিটিউট অফ অলটারনেটিভে এনার্জি-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি।