ডেটলাইন ১৯৭১ : ফটোগ্রাফি যোদ্ধা মিশেলের জন্য অতল শ্রদ্ধা

প্রকৌশলী জ্যোতির্ময় ধর : ২৫ মার্চ  ১৯৭১, রাত সাড়ে নটা । ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লবিতে,   বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর মধ্যকার গোলটেবিল বৈঠক কভার করতে আসা কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনারত। হটাৎ মুহুর্মূহু মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের শব্দে বিদেশি সাংবাদিকরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সবকিছু জানা না থাকলেও গুলির ও বোমার আঘাতে হতে থাকা বিকট শব্দ কোনো গুরুতর কোনো পরিস্থিতির আভাস দেয় তাদের মনে। তাঁরা তখনো বুঝতেই পারেননি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে, ঢাকায় শুরু করেছে ইতিহাসের নির্মম নিধনযজ্ঞ।

২৬ এ মার্চ সকাল থেকে সারা ঢাকা জুড়ে ছিল কারফিউ। থমথমে ভীতিকর পরিবেশ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কনভয় অবস্থান নিয়েছিল ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এবং হোটেল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল, কেউ যাতে হোটেল থেকে বের হতে না পারে। ওইদিন বিকেলে হোটেলে আসেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক। তিনি আরও ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রেস লিঁয়াজো অফিসার। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত শতাধিক বিদেশি রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিকদের কৌশলে দেশ ছাড়ার হুমকি দেন এই মেজর সিদ্দিক সালিক।

তিনি বলেছিলেন “এটি একটা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি এখানে থাকা খুবই ভয়ঙ্কর আমরা তোমাদের নিরাপত্তার কথাই ভাবছি তোমাদের এখানে থাকা নিরাপদ না

সে সময় সকল বিদেশী নাগরিক হোটেল ছেড়ে চলে গেলেও সকলকে ফাঁকি দিয়ে থেকে যান সাংবাদিক মিশেল লরেন্ট, যিনি ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। ১৯৪৬ সালের ২২ জুন ফ্রান্সের ভার্ননে জন্ম নেয়া মিশেল ছিলেন একজন যুদ্ধ-ফটোসাংবাদিক। ১৯৬২ সালে এপিতে (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) ফটোসাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে বিভিন্ন যুদ্ধের সরাসরি চিত্রধারণ করেন তিনি। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আরো একজন সেদিন রয়ে গিয়েছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তিনি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন জন ড্রিং। হোটেলের কর্মচারী ও অন্যান্য বাঙালিদের সহায়তায় মিশেল লরেন্ট, সায়মনের থেকে যাবার কথা জানতে পারেন এবং দেখা করেন।

একজন সাংবাদিক ও একজন ফটোসাংবাদিক মিলে খুব ভালোভাবে রিপোর্টটি করা যাবে, সে চিন্তা থেকে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। শহরের পরিস্থিতি বোঝার জন্যে ২৭ মার্চ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পাঞ্জাবি পরে হোটেল থেকে বের হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শুরু করে পুরোনো ঢাকা পর্যন্ত যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তা প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগ্ননাথ ও জহুরুল হক হলের বীভৎস হত্যাকাণ্ডসহ আশেপাশের এলাকার প্রচুর ছবি তোলেন মিশেল।

নিরাপদে পুনয়ায় হোটেলে ফিরে এলেও তাদের মূল চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় ক্যামেরা, ফিল্ম ও রিপোর্টের নোটগুলোর নিরাপত্তা। সাহায্যের জন্যে প্রথমে ব্রিটিশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করলে সেখানে তারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু আশার আলো মেলে জার্মান অ্যাম্বেসিতে। ‘কূটনৈতিক’ ট্যাগ লাগিয়ে মিশেলের ফিল্মগুলো পাঠাতে রাজি হয় জার্মান হাইকমিশন। আশ্বাস পেয়ে গণহত্যার ধারণ করা ৯ রোল ছবি তথা অর্ধেক ফিল্ম মিশেল জমা দিয়ে আসেন। জার্মান অ্যাম্বেসির কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন বন এ (তৎকালীন জার্মানির রাজধানি) পৌঁছার পর তারাই এপিকে (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) ফোন করবে আর এপি কর্তৃপক্ষ ছবি ও ফিল্মগুলো নিয়ে যাবে।

অন্যদিকে ছবি তোলার সময় জহুরুল হক হলের রাস্তায় টহলরত পাকিস্তানি সেনারা তাদের দেখতে পেয়ে মেজর সিদ্দিক সালিককে খবর পাঠায়। পরবর্তী সময় দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সায়মন ড্রিং জানান, সে রিল আর জার্মান পৌঁছায়নি। খুব সম্ভবত সতর্কতার অংশ হিসেবে, পাকিস্থান সেনাবাহিনী, সকল প্রকার কূটনৈতিক কাগজপত্র আলাদা করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদেশে পাঠায়। আর তাতেই জব্দ হয় রিলগুলো।

ছবি তুলে নিয়ে আসার পর তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা ত্যাগ করা। সে সময় টিকেটের পরিবর্তে দেশ ত্যাগের জন্যে নম্বর স্লিপ দিত। হোটেলের বাঙালি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সায়মন ও মিশেল জার্মান নাগরিকের কাছ থেকে দুটো নম্বর পান এবং ঢাকা-করাচি-কলম্বো রুটে ব্যাংকক পৌঁছান। এর মাঝে করাচি বিমানবন্দরে তাদের পুনরায় তদন্ত করা হয় এবং মিশেলের থেকে বাকি ফিল্ম ও সায়মনের থেকে মোজার ভেতর লুকোনো প্রতিবেদনের শর্টনোট নিয়ে নেয়।

ব্যাংকক পৌঁছে তারা প্রতিবেদন তৈরি করেন। টেলিগ্রাফের জন্যে সায়মন লেখেন Casualties Like to b Heavy”.

মিশেল লরেন্ট লেখেন তাঁর বিখ্যাত প্রতিবেদন At Dacca University Burning Bodies of Students Still lay in their Bed, A Mass Grave Had Been Hastily Covered এপির বরাত দিয়ে প্রভাবশালী সাময়িকী টাইমে প্রকাশিত হয় প্রতিবেদনটি।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিছানায় তাদের দেহ এখনও জ্বলছে

একটি বিশাল হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে… ’

মিশেল লরেন্ট

অ্যাসোসিয়েট প্রেসের একজন চিত্রগ্রাহক, যিনি সেনাবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বিধ্বস্ত জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করেছেন

ঢাকা, মার্চ ২৯পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলি চালানোর দুদিন রাতে সম্ভবত শুধু ঢাকাতেই ৭০০০ পাকিস্তানী মারা গিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে আমেরিকা থেকে সরবরাহিত এম২৪ ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি এবং পদাতিক বাহিনী দিয়ে সেনাবাহিনী কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আক্রমণ করে শহরের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস করে দিয়েছে। এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুরের শক্তিশালী অনুসরণকারীদের বাসস্থান জনবহুল পুরাতন শহর এবং এই শহরের উপকণ্ঠে ,৫০০,০০০ মানুষের থাকা শিল্পাঞ্চল

শনিবার রবিবার লড়াইয়ের স্থলভাগের এলাকাগুলোতে ঘুরে স্পষ্ট বোঝা যায় যে শহরটি কোনোপ্রকার পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই দখল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থীর পোড়া মরদেহ এখনও তাদের ছাত্রাবাসের বিছানায় পড়ে আছে। ডরমেটরিগুলি সরাসরি ট্যাঙ্ক দ্বারা আক্রমণ করা হয়েছিল এবং তড়িঘড়ি করে জগন্নাথ কলেজে একটি গণকবর দেওয়া হয়েছিল (প্রকৃতপক্ষে, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল) এবং ইকবাল হলে ২০০ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রায় ২০টি লাশ এখনও মাঠ এবং ছাত্রাবাসে পড়ে আছে। সৈন্যরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাজুকাস নিক্ষেপ করেছে বলে জানা গেছে, তবে হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি

ঢাকায় জীবন স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসছেপশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের এমন দাবি থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ কেবল তাদের বহনযোগ্য জিনিসপত্র নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ঠেলাগাড়িতে খাবার কাপড়ের বোঝাই করে যাচ্ছেন। সামরিক শাসনাদেশ থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েকটি ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে ফিরে এসেছেন। সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ছিল খুবই নগণ্য। পাকিস্তানিরা অস্ত্র ব্যবহার না করার সামরিক নির্দেশ মানছে। সরকারি দালানগুলো থেকে আবারও উড়ছে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। গত দশদিনের ওড়ানো সবুজ, লাল এবং হলুদ রঙেরবাংলাদেশএর স্বাধীনতার পতাকা নামিয়ে এটি ওড়ানো হচ্ছে

পুরোনো শহরে, যার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বয়স্ক পুরুষ এবং মহিলাগুলো ধ্বংসাবশেষের মাঝেই বসবাস করছেন। সেনাবাহিনীর লরি এবং সাজোয়া গাড়ি প্রায় নির্জন রাস্তায় টহল দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর টহল থেকে এড়াতে গাড়িগুলোতে পাকিস্তানের পতাকা দিয়ে আটকানো হয়েছে। দেহগুলো এখনও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আছে, যেখানে তারা সেনাবাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিল। রেলওয়ের পাশে শান্তি শহরগুলো পুড়ে গেছে। গুলি মৃত্যু দেখে লোকেরা এখনও হতবাক হয়ে বসেছিল

বিদেশী সাংবাদিকদের একটি বিশাল দলকে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তী সহিংসতা প্রত্যক্ষ করা থেকে প্রতিরোধ করতে সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। ঢাকা আন্তর্জাতিক হোটেলটিতে পঁয়ত্রিশ জন বিদেশি সংবাদদাতাকে আটক রাখা হয়েছিল এবং কেবল এই সাংবাদিক এবং একজন ব্রিটিশ সংবাদদাতা সেনাবাহিনীকে লুকিয়ে বের হতে সম্মত হয়। পরে ঢাকা বিমানবন্দরে সেনাবাহিনী ধারণ করা ফিল্ম এবং নোট জব্দ করে। করাচিতে, পুলিশ আমাকে নগ্ন হবার জন্যে জোর করে, আমার লাগেজ আবার তল্লাশি করা হয়, এবং বাকি ফিল্মও ধরা পড়ে যায়

দ্য টাইমস, ৩০ মার্চ ১৯৭১

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় বাহিনীর সাথে পুনরায় ঢাকায় ফেরেন মিশেল ও সায়মন। এবার সাথে আসেন এপির আরেক সাংবাদিক হ্রস্ট ফাস। ১৮ ডিসেম্বর কাদেরিয়া বাহিনীর সমাবেশে চার অভিযুক্ত রাজাকারকে হত্যা করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মিশেল। এবারও তোলেন ছবি। তার তোলা ছবিগুলো নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে ছাপা হয়। মিশেল ও হ্রস্টের এ ফটোস্টোরি পায় পুলিৎজার ও ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার।

যুদ্ধ-ফটোগ্রাফির নেশায় ভিয়েতনামও ছুটে যান মিশেল। তবে এবার আর শেষ রক্ষা আর হয়নি। ১৯৭৫ সালের ২৮ এপ্রিল ভিয়েতনামের যোদ্ধারা কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে তাকে। যুদ্ধের ময়দানেই প্রাণ হারান মানবতার জন্যে কাজ করে যাওয়া এ অকুতোভয় যোদ্ধা। আর মিশেলই ছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত শেষ সাংবাদিক।

তথ্যসূত্রঃ Assignment Bangladesh 71  (1999)

লেখক : প্রকৌশলী , জার্মান ইন্সিটিউট অফ অলটারনেটিভে এনার্জি এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি।