শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তামিমের আড্ডায় আইসিসি ট্রফি জয়ের স্মৃতি রোমন্থন

প্রকাশিতঃ ২০ মে ২০২০ | ৭:১০ অপরাহ্ন


ঢাকা : ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে উঠে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো বাংলাদেশ। আর সেখান থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস নতুন গতি লাভ করে । সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। অথচ এই ইতিহাস রচনা করতে কত যে, কাটখড় পোড়াতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তা এদেশের ক্রিকেটপ্রেমিদের অজানা নয়। তবে যারা ২৩ বছর আগে সেই ইতিহাস রচনা করেছিলো, তাদের মুখে আরও একবার শোনার সৌভাগ্য হলো এদেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমিদের।

গতকাল রাতে বাংলাদেশের বর্তমান ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল তার ধারাবাহিক লাইভ শো’তে আমন্ত্রন করেছিলেন, আইসিসি ট্রফিতে খেলা বাংলাদেশের অধিনায়ক আকরাম খান, ব্যাটিং অলরাউন্ডার মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলটকে। পরে তাদের সাথে যোগ দেন পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ও বিশ্ব ক্রিকেটের গ্রেট পেসার ওয়াসিম আকরাম।

জম্পেশ সেই আড্ডার শুরুতে আকরাম-নান্নু-পাইলটদের কাছে আইসিসি ট্রফি জয়ের ইতিহাস মনে করিয়ে দেন তামিম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটে উনাদের অবদান অনেক বড়। উনাদের অবদান কখনো ভোলা সম্ভব না। বিশেষ করে আইসিসি ট্রফিতে। এ নিয়ে প্রশংসা করা ছাড়া আর কিছু নেই। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন।’

তবে পুরো আসরে বাংলাদেশের জন্য বাঁচা-মরার ম্যাচ ছিলো নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। তার আগে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়। তারপরও ঐ ম্যাচটি হবার আশায় মাঠের পানি নিষ্কাশনে নেমে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে পাইলট বলেন, ‘এখনকার মতো তখন তো আর তখন গ্রাউন্ডসম্যান ছিলো না। আমরা সব ক্রিকেটাররাই হোটেল থেকে তোয়ালে নিয়ে আসতাম, চেঞ্জিংয়ের জন্য। ম্যাচের আগে মুশল ধারে বৃষ্টি। আর ওই ম্যাচের পয়েন্ট আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা চাইছিলো, পয়েন্টটা যাতে ভাগাভাগি হয়। তারা দেরি করছিল, মাঠ ভেজা থাকার কথা বলছিল। তখন সবাই মাঠে নেমে পড়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য। সবাই নেমে মাঠে তোয়ালে ভিজিয়ে বালতির সাহায্যে পানি নিষ্কাশণ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হয়নি।’

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায়, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়ায় অলিখিত ‘কোয়ার্টার ফাইনাল’। এ ম্যাচ জিতলেই সেমিফাইনালে খেলতে পারবে। আর হেরে গেলে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন সেখানেই ইতি ঘটবে। অবশ্য ইতি ঘটার মতই অবস্থা তৈরি হয়েছিলো।

৪ এপ্রিল কুয়ালা লুমপুরের রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউট গ্রাউন্ডে হওয়া ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ৪৯ দশমিক ৫ বলে ১৭১ অলআউট হয় নেদারল্যান্ডস। জবাবে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে মহা বিপদে পড়ে বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় দলের হাল ধরেন আকরাম ও নান্নু। এরপর বৃষ্টির কারনে বন্ধ হয় খেলা। ফলে বাংলাদেশের সামনে নতুন টার্গেট দাড়ায় ৩৩ ওভারে ১৪১ রানের।

পরবর্তীতে খেলা শুরু হলে পঞ্চম উইকেটে ৬২ রানের জুটি গড়েন আকরাম ও নান্নু। ফলে স্বস্তি ফিরে বাংলাদেশ শিবিরে। তবে ব্যক্তিগত ২২ রানে নান্নু ফিরে গেলেও এক প্রান্ত আগলে রাখেন আকরাম। সপ্তম উইকেটে পেসার সাইফুল ইসলামকে নিয়ে ৫০ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যান আকরাম। জয় থেকে ৫ রান দূরে থাকতে থামেন সাইফুল, করেন ১৮ রান। তবে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন আকরাম। ৩টি চারে ৯২ বলে অপরাজিত ৬৮ রান করেন তিনি। এতে সেমিফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের টিকিট পেতে তখন এক জয় থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ।

ঐ ম্যাচ নিয়ে আকরাম বলেন, ‘আমরা জানতাম কোনো খেলায় বাংলাদেশের যদি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ থাকে সেটি হলো- ক্রিকেট। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে আমরা ফিল্ডিং ও বোলিং ভালো করি। ব্যাটিংএ ১৫ রানে ৪ উইকেট পতন হয়। বৃষ্টিও শুরু হয়। তখন এক পর্যায়ে বলা হলো, খেলা ২০ ওভারের আগে বন্ধ হয়ে গেলে আমরা সেমিতে উঠব। এরপর আমরা দেরি করতে শুরু করলাম। এরপর খেলাটা বন্ধ হলো। আমরা তো খুশি।

কিন্তু এরপর হঠাৎ শুনলাম, ম্যাচ হতে হবে। ম্যাচ যদি না হয় বাংলাদেশ কোয়ালিফাই করবে না। আমরা তো আবার চাপে। একটা পর্যায়ে নতুন লক্ষ্য দেওয়া হয়। নান্নু ভাইয়ের সঙ্গে নতুন জুটি হলো। সাইফুল আসল, একটা সময় আমরা জিতে যাই। ওই টুর্নামেন্টে আমরা একটা পরিবারের মতো ছিলাম।’

সেমিফাইনালে স্নায়ুচাপে পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে। কারন স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের। ঐ ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৪৩ রান করে বাংলাদেশ। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে ৬টি চারে ৯৬ বলে ৭০ রান করেন পাইলট। জবাবে বাংলাদেশের দুই স্পিনার এনামুল হক ও মোহাম্মদ রফিকের ঘুর্ণিতে ১৭১ রানেই গুটিয়ে যায় প্রতিপক্ষ। এনামুল ৩১ রানে ৩টি ও রফিক ২৫ রানে ৪টি উইকেট নেন।
বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হবার পর ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় কেনিয়ার। শিরোপা লড়াইয়ে টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করতে নামে বাংলাদেশ। স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানে সুবাদে ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৪১ রান করে কেনিয়া।
এ ম্যাচেও বৃষ্টির বাগড়া দেয়। ফলে ২৫ ওভারে ১৬৬ রানের জয়ের লক্ষ্য পায় বাংলাদেশ। শুরুটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের। প্রথম বলেই খালি হাতে ফিরে যান নাইমুর রহমান দূর্জয়। এরপর মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় ও ছোট-ছোট ইনিংসের কল্যাণে লড়াইয়ে টিকে থাকে বাংলাদেশ।

শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারে ২ উইকেট হাতে নিয়ে জিততে ১১ রান দরকার পড়ে বাংলাদেশের। উইকেটে ছিলেন পাইলট ও পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত। ঐ ওভারের প্রথম বলে স্ট্রাইকে ছিলেন পাইলট। কেনিয়ার পেসার মার্টিন সুজির করা প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকান পাইলট। ফলে ৫ বলে ৫ রান দরকার পড়ে টাইগারদের। আর শেষ বলে ১ রান নিয়ে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন শান্ত।

শেষ ওভারের ছক্কা ও জয় নিয়ে পাইলট বলেন, ‘শেষ ওভারে যাতে ১১ রান করে দলকে জেতাতে পারি। এর জন্য আল্লাহর কাছে বলেছিলাম, দলকে জেতাতে আল্লাহ যদি আমার কাছ থেকে ভালো কিছু নিয়ে যায়, যাক। তাও জিততে হবে।’

পাইলটের কথা শেষ হতেই একটি স্মৃতি মনে করিয়ে আকরাম বলেন, ‘সবাই বলে, আইসিসির পরে একজন এটা পেয়েছে তো আরেকজন ওটা পেয়েছে। পাইলট কী পেয়েছে? আসলে সে যখন আইসিসি খেলতে যায়, তখন কিন্তু সে বিয়ে করে যায়। আর তখন তাঁর শ্বশুর তাঁর উপর রাগ করে ছিলো। আর যখন আমরা জিতে দেশে ফিরে আসলাম, তখন দেখলাম, তাঁর শ্বশুর তাকে সোনার চেইন পরিয়ে দিচ্ছে। এ স্মৃতি আমি কখনো ভুলবো না।’