রিপোর্টারের ডায়েরি : বাবা হারানোর ব্যথা মিলিয়ে গেলো দাফনের আনন্দে

আজাদ তালুকদার : একাত্তর টেলিভিশনের জিএম (অপারেশন অ্যান্ড এডমিন) মোস্তফা আজাদের বাড়ি চট্টগ্রামের মেডিকেল কলেজ এলাকায়। ১৯৫৪ সালে তার বাবা মেডিকেলের উত্তর কোণায় ৬০ কাঠার একখণ্ড জায়গা কিনেন। জায়গার মধ্যখানে ছোট্ট একটা ছিমছাম বাড়ি। সবুজ আর অরণ্যঘেরা জায়গার চারপাশ। কিন্তু সুন্দর পরিপাটি জায়গাটির ওপর সীমানাপ্রাচীর দিতে গেলেই বাধ সাধে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, মেডিকেলের পুরো জায়গা মাপজোখ না হওয়া পর্যন্ত সীমানাপ্রাচীর দেওয়া যাবে না।

মোস্তফা আজাদ ভাই ও অফিসের কর্তাব্যক্তিদের অনুরোধে আমিও একবার দেখা করেছিলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনি বোঝালেন, জমি মাপজোখের বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাজ। নানা জটিলতায় আটকে আছে কাজটি। জেলা প্রশাসন আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলেই বিষয়টির সুরাহা সম্ভব।

এমন এক জটিলতার মধ্যে ২১ জানুয়ারি ২০১৬ মোস্তফা আজাদের বাবা মারা যান। তাদের পারিবারিক মসজিদের পাশে নিজস্ব জায়গায় সমাধি খুঁড়তে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। জানিয়ে দেওয়া হয় সীমানা-জটিলতা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত এখানে কোনো কবর হবে না। একপর্যায়ে পুলিশ পাঠিয়ে কবর খোঁড়ার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেডিকেলের পক্ষ হয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যান চিকিৎসক নেতা ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী। তিনি মৃতের পরিবারকে ফোনে জানিয়ে দেন বিরোধপূর্ণ জমিতে কবর খোঁড়ার চেষ্টা করলে পরিণতি ভালো হবে না।

চিরতরে প্রিয়জন হারানোর শোক, তার ওপর সেই প্রিয়জনকে দাফনের অনিশ্চয়তায় পরিবারটির অবস্থা কেমন হতে পারে সহজে অনুমান করা যায়। অমানবিকতার শেষ পেরেকটি টুকে দেওয়ার পর শোকাহত পরিবারটির সামনে তখন মোস্তফা আজাদের কর্মস্থল একাত্তর টেলিভিশনই ভরসা। অসহায় পরিবারটির আকুতি আর কেউ না শুনুক, জগতের সব মানুষ মানবিক আচ্ছাদন খুলে নগ্ন উল্লাস করুক, একাত্তর টেলিভিশন অন্তত তা করবে না। সম্ভব হলে পাশে দাঁড়াবে।

সেই ভরসায় জিএম মোস্তফা আজাদ আমাকে ফোন দিলেন। কাঁদো গলায় বললেন, ‘আজাদ ভাই আমার বাবা মারা গেছেন।’ সমবেদনা জানিয়ে জানাজা কখন হবে জানতে চাইলাম তার কাছে। দেখি আর কোনো কথা নেই। তখনও আমার জানা ছিল না, একজন মানুষের মৃত্যুর পর মৃত্যুশোক ও কষ্টের চেয়েও বড় কোনো কষ্টকর ‘সংবাদ’ অপেক্ষা করছে। ক্ষাণিক পর ঢুকরে কেঁদে উঠেন আজাদ ভাই। বলেন, ‘জানাজা বোধহয় হবে না।’

: জানাজা হবে না মানে!
: হ্যাঁ আমার বাবাকে কবর দিতে দিচ্ছে না মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। কবর দিতে না পারলে জানাজা হবে কী করে। জায়গা মাপের কথা তুলে আমাদের ভিটেয় বাবার কবর খুঁড়তে দিচ্ছে না তারা। যোগ করেন মোস্তফা আজাদ। এই খবরে ‘বিস্মিত’-এর উপরে কোনো শব্দ থাকলে আমি বোধহয় তাই হয়েছি।

নিউজের সন্ধানে আমার অবস্থান তখন বন্দর এলাকার দিকে। আজাদ ভাইকে শান্ত¦না দিলাম। বললাম, আমি কাজ সেরে যত দ্রুত সম্ভব আসছি। চিন্তা করবেন না, নিশ্চয় এর একটা সুরাহা হবে।

একটি প্যাকেজের কাজ মাঝপথে থামিয়ে মোস্তফা আজাদের বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। আগ্রাবাদ বারিক বিল্ডিং মোড়ে আসার পর একে একে রেজা ভাই (সৈয়দ ইশতিয়াজ রেজা, একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা পরিচালক) ও শাকিল ভাই (শাকিল আহমেদ, একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ)-এর ফোন। মোস্তফা আজাদের বাবার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে দুজনই বললেন, সব কাজ বাদ দিয়ে মানবিকতার শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলার চেষ্টার বিরুদ্ধে আমি যেন রুখে দাঁড়াই।

আমার মনে হয়েছে, এই ঘটনা হয়তো চমেক অধ্যক্ষ ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানেন না। তিনি জেনে-শুনে এমন কাজে সমর্থন দিতে পারেন না। ন্যূনতম বিবেক থাকলেও এই কাজ কেউ করবে না, করতে পারে না। ব্যাপারটি অধ্যক্ষের কানে পৌঁছাতে পারলেই দাফনের বিষয়টি সুরাহা হবে সেই আশা জাগিয়েই ফোন করি প্রিন্সিপাল স্যারকে।

এরপর তিনি আমাকে যা শোনালেন, তা হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে আরো উসকে দেওয়ার মতো। তিনি বললেন, মাপজোখ করে জায়গার সীমানা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত জায়গার ওপর কোনো ধরনের স্থাপনা, বাউন্ডারি, কবর-সমাধি কিছুই আমরা করতে দেবো না। সীমানা-জটিলতা নিরসনের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি ৫-৬ মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। তখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলে তিনি জানান।

-ধরে নিলাম ৬ মাস পর সব ঠিক হয়ে গেলো। কিন্তু এ মুহূর্তে লাশটার কী হবে, লাশটা কি তাহলে ৬ মাস পর্যন্ত রেখে দিতে বলছেন?
মেনে নিলাম পুরো জায়গাটি মেডিকেলের। সেখানে মৃতের কোনো জায়গা নেই। মারা যাবার পর চিরনিদ্রায় শায়িত হতে আপনার কাছে এক টুকরো জায়গা চাইছেন। মেডিকেলের হাজার একর ভূমির এক কোণোয় ভিটে-মাটিহীন লোকটি তিনহাতের একটি ঠিকানার জন্য আপনার কাছে মিনতি করছে,
আবেদন জানাচ্ছে। আপনি কি তাকে সেই ঠিকানা না দিয়ে পারবেন! আমি প্রশ্ন করি।

অধ্যক্ষ বললেন, ‘এ মুহূর্তে আমার কিছুই করার নেই।’

সঙ্গে সঙ্গে আমার মন-মেজাজ বিগড়ে গেলো। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। সংযত হয়ে বললাম, আপনি যদি শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে আজ মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, নোংরা ও অমানবিক নিউজের শিরোনাম হবেন আপনি। সুতরাং, আমরা চাই না আপনি সেরকম একটি সংবাদের শিরোনাম কিংবা উপাদান হয়ে ওঠুন, ইতিহাসের নগ্ন পৃষ্ঠায় আপনার নাম লিপিবদ্ধ করুন।

এরপর অধ্যক্ষকে বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘আমরা ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। আমরা পৌঁছার আগেই আপনার লোকজন ও পুলিশকে সেখান থেকে সরে যেতে বলুন। দয়া করে তাদেরকে কবর খোঁড়ার সুযোগ করে দিন।’

অধ্যক্ষের সঙ্গে ফোনালাপের আধঘণ্টার মধ্যে ক্যামেরাম্যান বাবুন পালকে নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হই। গিয়ে দেখি পুলিশ এবং মেডিকেলের এস্টেট শাখার লোকজন যেখানটায় কবর খুঁড়তে চেয়েছিল সেখানে পাহারা দিচ্ছে।

বাবুনকে ইশারা করলাম দৃশ্যটি ভিডিও করতে। ক্যামেরা ‘অন’ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের লোকজন নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করে। তাদের বললাম, ক্যামেরার সামনে কিছু না বলে যাবেন না। একজন মৃত মানুষের দাফন-কাফনে বাধা দিতে কে আপনাদের পাঠিয়েছে, কোন থানা থেকে এসেছেন- ক্যামেরার সামনে বলতে হবে। ততক্ষণে সব পুলিশই হাওয়া। তারা যে যার মতো করে চলে গেছে।

এবার ধরলাম স্টেট শাখার লোকজনদের। ভদ্রভাবে তাদের পরিচয় জেনে নিলাম। বললাম, আমি জানি এখানে আপনাদের কোনো দোষ নেই। হয়তো দেখা যাবে আপনাদের মধ্যে এমনও আছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন- বলেই এস্টেট শাখার সিনিয়র কর্মকর্তাটির মুখের সামনে একাত্তর টিভির মাইক্রোফোন তুলে ধরি।

এ অবস্থায় অনেকটা নার্ভাস হয়ে পড়েন তিনি। কিছু বলার চেষ্টা করেও পারছেন না। আমি বললাম, কিছু বলতেই হবে। কেন এসেছেন অন্তত তাই বলুন। ততক্ষণে ভদ্রলোকের মাঝে কাঁপন শুরু হয়েছে।

কম্পমান শরীর নিয়ে বলা শুরু করলেন- সীমানাপ্রাচীর না থাকায় মেডিকেলের বিশাল আয়তনের জমি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছিল না। ফলে বেশকিছু জায়গা নানাভাবে বেদখল হয়ে গেছে। এখানেও মেডিকেলের জায়গার অংশবিশেষ আছে বলে ধারণা। সে কারণে অধ্যক্ষ স্যারের নির্দেশে আমরা এসেছি।’

নিজের ভিটেয় একজন মৃত মানুষের দাফন ঠেকানো গেলে কি মেডিকেলের সব জায়গা উদ্ধার হয়ে যাবে? পাল্টা প্রশ্নে আর কোনো জবাব নেই ভদ্রলোকের। একপর্যায়ে তারাও রণেভঙ্গ দিয়ে চলে যান। এখন শুধু আমরা আর মৃতের আত্মীয়স্বজন। বললাম, এবার কবর খুঁড়ুন দেখি কে কী বলে!
কিছুক্ষণ কবর খোঁড়ার কাজ তদারকি করে আমরা অফিসে ফিরে আসি। ফেরার সময় মোস্তফা আজাদ ভাইকে বলি, এবার আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এরপরও কিছু হলে আমাকে নক্ করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি হাজির হবো।

পরে অবশ্য আর কোনো ঝামেলা হয়নি। অনেক মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হলো মোস্তফা আজাদের বাবার। নিজের মাটিতে বাবার শবদেহ শুইয়ে দিতে পেরে অসীম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তারা। বাবা হারানোর ব্যথা ছাপিয়ে বাবাকে দাফনের আনন্দটাই যেন সেদিন বড় হয়ে উঠেছিল প্রয়াতের পরিবারের কাছে।

পৃথিবীতে আনন্দের রকমফের আছে জানি। কিন্তু এমন ‘আনন্দ’ আমি কখনো দেখিনি, শুনিনি। আমার কাছে এই এক নতুন ‌আনন্দ’। সাংবাদিকতার কল্যাণে, সহকর্মীর প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একটি ‘শবযাত্রা’র অন্যরকম বিদায়-আনন্দের সারথী হওয়ার কথা যখন মানসপটে ভেসে উঠে তখন মনে হয় আমি বোধহয় এখনো মানুষ হওয়ার চেষ্টায় আছি। আর সেটি ভেবে অন্যরকম ভালোলাগা ছুঁয়ে যায়।