শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনভিজ্ঞ দাতা, ভয়ঙ্কর গ্রহীতা ও পরার্থপরতার অর্থনীতি

প্রকাশিতঃ ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১০:২৭ অপরাহ্ন

শেখ মোহাম্মদ জুলফিকার বিপুল : ২০০৩ সাল হবে। সদ্য দেশে ফিরে এসেছি। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের দমবদ্ধকরা জীবন থেকে এসে, দেশ নিয়ে আবেগ তুঙ্গে। বাদামতলি মোড়ে আমার বাল্যবন্ধু জাহাঙ্গীরের ভাতের দোকান, পাশে একটা গাড়ি রিপেয়ারিং সপ। মাঝেমধ্যে সেখানে গাড়ি ঠিক করতে গেলে, জাহাঙ্গীরের সাথেও দেখা করতে যেতাম।

ঈদের মওসুম চলছে। আমার মা এসময় নতুন টাকার বান্ডিল পেতে পছন্দ করে। একদিন আগ্রাবাদ থেকে কিছু নতুন টাকা নিয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করে বের হয়েছি। বের হয়ে গাড়ির দোকানটার সামনে যেতেই দেখি কয়েকজন বেদে-বেদেনী সবার কাছে সাহায্য চাচ্ছে। এক মহিলাকে দেখলাম তার সারা শরীরে দুইতিন জন অপুষ্ট শিশু ঝুলে আছে। ছোটবেলায় আমাদের পাঠানটুলির বাড়িতে প্রায় দেখতাম এরা ভিক্ষা করতে আসতো। আমি ভেবেছি বেদেরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরা ছিল আসলে জিপসি, যাযাবর। আমার দাদি চাটগাঁইয়া ভাষায় বলতো- ‘বেরাইজ্জ্যা’ যার অর্থ ইংরেজি ruthless শব্দটার কাছাকাছি হতে পারে।

ছেলেবেলায় আমার যত ওয়াইল্ড ইম্যাজিনেশন ছিল তার মধ্যে আছে- মফস্বলের কোন রেলস্টেশনের স্টেশনমার হওয়া, হোমিওপ্যাথিরও দোকান দেয়া, অ্যামাজন জঙ্গলে গিয়ে থাকা, ইনকা সভ্যতা, মাচুপিচু থেকে নকশাল আন্দোলন, বলিভিয়ার জঙ্গল, চে গেভারার মতো জীবন কাটানো আর বেদেদের সাথে নদীতে নদীতে ঘুরে বেড়ানো।

হয়তো সুনীল, হুমায়ূন, সত্যজিৎে অস্বাভাবিক ভাবে ডুবে থাকার কারনে এমনটা হতে পারে।

যাইহোক বেদেদের দেখে আমার একপ্রকার মায়া লেগে উঠলো। যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে এরা দারুণ মাইন্ড রিডার হয়। আমাকে দেখেই তারা যেন বুঝে যায়, আমি কিছু দিতে পারি। আমার কাছে আসতেই আমি পকেট থেকে নতুন টাকার বান্ডিল বের করে সবাইকে একটা করে দশ টাকার নোট দিতে থাকি। ভুলে গেলাম বাংলাদেশে ব্যস্ত রাস্তায় এভাবে টাকা ফ্ল্যাশ করে কিছু দিতে গেলে কি হতে পারে। দশ পনের জনের বেদের দল আমাকে ঘিরে ধরল। এর মাঝে এই খাবরটা যেন আশেপাশের ভিক্ষুক কমিউনিটিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল যে- বেকুব চেহারার এক ছেলে বাদামতলি মোড়ে গাড়ির গ্যারাজে সবাইকে টাকা দিচ্ছে।

এমনকি একটু আগে সোনালি ব্যাংকের সামনে একপায়ের যে ভিক্ষুককে দেখেছি, তাকেও দেখি উসাইন বোল্টের মতো দৌড়ে দৌড়ে আসছে। মুহূর্তেই আমি ঘেরাও হয়ে যাই। সব ভিক্ষুকরা আমাকে ঘিরে ধরে। একটু পরেই আমার সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এরা তখন আমার জামা কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করে…। আমি জাহাঙ্গীরকে ডাকতে থাকি কিন্তু তার দোকান পর্যন্ত আমার ভয়েস পৌঁছে না। অবশেষে আমাদের ড্রাইভার ফারুক আমাকে উদ্ধার করে।

আকবর আলি খান, তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে সম্রাট হর্ষবর্ধনের কথা বলেছেন। দারুণ দানশীল রাজা ছিলেন। প্রায় উনি তাঁর সর্বস্ব দান করে দিতেন। দান করতে করতে এক পর্যায়ে নিজের জামা কাপড়সহ দিয়ে দিতেন। সবশেষে গঙ্গায় স্নান করে বাড়ি ফিরতেন। যদিও নিন্দুকেরা বলছে- আসলে সম্রাট হর্ষবর্ধন ঘেরাও হয়েছিলেন। নিজের জামা কাপড় দেয়ার সময় পাননি। ভিক্ষুকের দল নিজ দায়িত্বেই সব খুলে নেয়। আর হর্ষবর্ধন ইজ্জত বাঁচাতে গঙ্গায় ঝাপ দিয়েছিলেন।
আবার এক শবে বরাতের রাতে ড. আকবর আলি খানও এর কাছাকাছি অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন।

তাঁর লেখা ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইটা পড়তে পড়তে বাদামতলি মোড়ে আমার নিজের ঘেরাও হবার ঘটনাটা ফ্ল্যাশব্যাক হয়। ওই সময়টায় আমি দুইটা কথা মনে করার চেষ্টা করেছিলাম- এক, সকালে বের হবার সময় প্যান্টের ভেতরে বক্সার পরেছিলাম কিনা! দুই, আশেপাশে গঙ্গা না থাকলেও, ঝাপ দেয়ার জন্য আগ্রাবাদের বড় দীঘিটাতো আছে! কিন্তু সে পর্যন্ত আমি দৌড়ে যাচ্ছি এটা ভাবতেই আমার নাইটমেয়ার হতে থাকে…

আসলে কেবল দিলেই হয় না। যিনি দিচ্ছেন তাকে অনেক অর্গেনাইজড ওয়েতে দিতে হয়। সচ্ছল ব্যাক্তি নিঃস্বকে দেবে, ধনী রাষ্ট্র দেবে গরিব রাষ্ট্রকে। আজকের যে ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণা, সমাজ, রাষ্ট্র আর পুরো পৃথিবীতে সাম্য আনতে পারে দান। কিন্তু দান ঠিক ভাবে ঠিক মানুষ বা কমিউনিটিতে পৌঁছে অবদান রাখতে পারার জন্য দরকার কঠিন এক কর্মযজ্ঞ। অর্থনীতিতে যেটা আলাদা করেই চর্চা হয়ে আসছে যার নাম- economics of altruism.
সেই আলোচনা অন্যদিন…