শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাঙ্গুনিয়ার ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ ও একজন স্বজন তালুকদারের মনোনয়ন

প্রকাশিতঃ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১১:৩১ পূর্বাহ্ন


আবছার রাফি : আবহামান কাল থেকে এক অসাম্প্রদায়িক জনপদ রাঙ্গুনিয়া সব ধর্মাবলম্বীদের পারস্পরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সহাবস্থানের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। পারিবারিক, সামাজিক যে কোনো স্তরে এই জনপদের মানুষের ভ্রাতৃত্ব আকাশসম উঁচু, ইস্পাত কঠিন শক্ত; যার স্বীকৃতি শুধু এই এলাকার নয়, ভিন্ন এলাকার মানুষও অকপটে দিয়ে যান।

তবে এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে সব সময় একই অবস্থানে ছিল, একেবারে তা নয়। এই সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত করতে বারবার হীন চেষ্টা হয়েছে। অর্থ আর ক্ষমতার দম্ভে অনেকেই এই ভ্রাতৃত্বের শক্ত ভিত নষ্ট করতে গিয়ে আজ তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, হচ্ছেন।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, দু’হাজার সাল বা তৎপরবর্তী সময়ের কথাই বলা যায়। তখনকার সময়ে রাঙ্গুনিয়া শাসন করতেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সম্প্রীতির রাঙ্গুনিয়াকে শতধা বিভক্ত করার যে চেষ্টা তিনি চালিয়েছেন তা সকলেরই জানা।

এক সমাবেশে হাত উঁচিয়ে নমস্কার দেওয়ার ভঙ্গিতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমার নমস্কার/আদাব ভোটের দরকার নেই’- অর্থাৎ হিন্দু/বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভোটের দরকার নেই। নেতার এমন বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে কর্মী-সমর্থকদের মাঝে। ধীরে ধীরে সামাজিক, রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতে থাকেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা। সংকোচিত হতে থাকে তাদের বাক-স্বাধীনতা। পূজো বা অন্য সব ধর্মকর্মে মামলা-হামলা চলতে থাকে একের পর এক। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের এমন নাজুক পরিস্থিতি হয়তো এখন অনেকে স্বপ্নেও ভাবতে চান না।

তারপর ২০০৮ সাল ২৯ ডিসেম্বর। ‘আমি রাঙ্গুনিয়ার- রাঙ্গুনিয়া আমার’ এমন স্লোগানে অসাম্প্রদায়িক রাঙ্গুনিয়া বিনির্মাণের ডাক দেন একজন হাছান মাহমুদ। তাঁর অসম্প্রদায়িক শব্দস্রোতে দীর্ঘদিনের হারিয়ে যাওয়া ‘সম্প্রীতি’ ফিরে পাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় রাঙ্গুনিয়ায়। ধীরে ধীরে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসেন তিনি। কেউ বিপদে পড়লে- তিনি হিন্দু নাকি মুসলিম, খ্রিস্ট্রান নাকি বৌদ্ধ সেই পরিচয় জানার আগেই সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন তিনি। সমান চোখে সবকিছুতে সব ধর্মাবলম্বীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন ড. হাছান মাহমুদ। রাঙ্গুনিয়ায় এমন কোনো মসজিদ-মন্দির-গীর্জা বাকি নেই যেখানে তিনি সহায়তার হাত বাড়াননি। এই সহায়তা কখনও সরকারিভাবে আবার কখনও ব্যক্তিগতভাবে। মোদ্দাকথা রাঙ্গুনিয়া আবারও ফিরে পেল তার হারিয়ে যাওয়া ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’।

এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল রাঙ্গুনিয়াবাসীর জীবন-যাপন। কিন্তু এরই মধ্যে আবারও সম্প্রীতি নষ্টের পাঁয়তারা শুরু করে উগ্রবাদী স্বার্থান্বেষী মহল। এবারের ষড়যন্ত্রের গভীরতা এতই সদূরপ্রসারী যে সেখানে তারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ, তারা জানে এই অঞ্চলের মানুষ এতই ধর্মপ্রাণ যে একবার ধর্মকে ব্যবহার করে অশান্তি তৈরি করা গেলেই কেল্লাফতে। তাই দেরি না করে, সুখ-শান্তিতে বসবাস করা মানুষগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় নানা কূটকৌশল করে। শুরু হয় ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী আচরণ, নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি। পরিস্থিতি এতই উত্তপ্ত হয়েছে যে-কোনো মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে উপস্থিত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। দীপ্তকন্ঠে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার স্থান বাংলায় নেই’। সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে চপেটাঘাত করেন সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখে। তাঁর এমন অনড় অবস্থানে আবারও তৈরি হলো সেই সাম্য-সম্প্রীতি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের অভিযোগ ছিল রাঙ্গুনিয়ায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বঞ্চিত-নিপীড়িত। এমনকি স্বাভাবিক জীবন-যাপনেরও ব্যতয় ঘটতো তাদের। কিন্তু বাস্তবচিত্র এই বক্তব্যের পুরোপুরি বিপরীত, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সমান অংশগ্রহণ নেই। চাকরি-বাকরিসহ অনেক বিষয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি শত শত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আজ সুন্দরভাবে জীবন পার করছে।

রাজনৈতিক নানা পদ-পদবীতেও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ, অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে যে বেশি তা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

সবশেষ ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন। হিন্দু বা বৌদ্ধ নয়, মুসলিম বা খ্রিস্টান নয়, এটা রাঙ্গুনিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সব ধর্মের মানুষের যে সবকিছুতে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে, তারই নিদর্শনের প্রমাণ দিচ্ছে।