শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভাব আর বিধি-নিষেধে অন্যরকম ঈদুল আযহা দেশে দেশে

প্রকাশিতঃ ১ অগাস্ট ২০২০ | ১০:১২ অপরাহ্ন


ফায়সাল করিম : নেই প্রতিটি এলাকায় সারি বেঁধে কুরবানি দেয়ার দৃশ্য। খুব একটা চোখে পড়েনি কোলাকুলি কিংবা ঘরে ঘরে উৎসবের চেনা আমেজও। অনেকটা সাদামাটা আনুষ্ঠানিকতায় মোড়ানো ছিল বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর এবারের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। করোনার ছোবলে লন্ডভন্ড বিশ্বে একদিকে দেখা গেছে অভাবের তাড়না অন্যদিকে লকডাউনের বিধি-নিষেধ। সবমিলিয়ে মলিনতায় উদযাপিত এক অন্যরকম ঈদ।

লস এ্যাঞ্জেলস টাইমসের মতে, এবারের ঈদ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে মহামারির প্রকোপে। এর মধ্যে শুক্রবার সৌদি আরবে মুসলমানরা ৯২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সীমিত পরিসরে ঈদুল আযহার আনুষ্ঠানিকতা উদযাপন করে। করোনার কারণে সৌদি আরবের পবিত্র শহর মক্কায় এ বছরের হজের আনুষ্ঠানিকতা প্রভাবিত হতে দেখা গেছে ব্যাপকভাবে।

সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে অংশ নিলেও করোনা মহামারির কারণে এবার হজে অংশ নিতে পেরেছেন প্রায় এক হাজার মুসল্লি। শুক্রবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে জামারাতে পাথর নিক্ষেপের পর মিনার উদ্দেশে রওনা হন হাজিরা। পরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দেওয়া হয় পশু কোরবানি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শুক্র ও শনিবারের ঈদে দেখা গেছে বিধি-নিষেধ, লকডাউন আর দারিদ্রতার প্রভাব। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মাস্ক পরে মুসল্লিদেরকে নামাজ আদায় করতে হয়েছে। মালয়েশিয়ার কিছু কিছু মসজিদে কোরবানির রীতি বাতিল করা হলেও কুয়ালালামপুরে কেংকু আব্দুল্ আজিজ শা্হ জামে মসজিদে ১৩টি গরু কোরবানি দেওয়া হয়েছে।

তুরস্কের আয়া সোফিয়া মসজিদে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক এ ভবনকে বহু বছর পর সম্প্রতি মসজিদে রূপান্তরিত করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়ে এরদোগান। সংসদের স্পিকার, পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রী এবং ইস্তাম্বুল শহরের গভর্নর আয়া সোফিয়া মসজিদের ঈদের জামাতে যোগ দেন।

বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যের কাছাকাছি নিয়ে গেছে, যার ফলে অনেকের পক্ষে এবার কোরবানি পশু কেনার ঐতিহ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

সোমালিয়ায় এবারের ঈদের আগে মাংসের দাম কিছুটা বেড়েছিল যেটি প্রভাব ফেলেছে কুরবানির বাজারে। মোগাদিশুর একজন সরকারী কর্মচারী আব্দিশাকুর দাহির। লস এ্যাঞ্জলেস টাইমসকে তিনি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে আর্থিক সংকট থাকায় এই প্রথম তিনি ঈদের জন্য ছাগল কিনতে পারেন নি। “আমি আমার পরিবারের জন্য কুরবানির পশু কিনতে পারিনি এবার। আপাতত এখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলছে। দিন দিন জীবন কঠিন হয়ে পড়ছে।“ বলেন দাহির।

ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার বসবাস। কঠোর স্বাস্থ্য নির্দেশিকার মধ্যে এবার সেখানে মসজিদে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়। দেশটির সরকার ঘোষিত নির্দেশ মতে, নাগরিক ও বাসিন্দারা নিজেদের জায়নামাজ নিয়ে এবং একে অপরের থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে থেকে ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছে। এছাড়া ইমামদের মাস্ক পড়ার বিধানসহ হাত মেলানো বা আলিঙ্গনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল সরকার। তাছাড়া দীর্ঘ লাইন এড়াতে দরিদ্রদের জন্য দরজায় দরজায় মাংস বিতরণের ব্যবস্থাও করেছিল তারা।

ইন্দোনেশিয়ার কারখানা শ্রমিক আগুস সুপ্রিতনা, যাকে এই মহামারির কারণে কাজ থেকে ছাটাই করা হয়েছে তিনি বলেন “এই মহামারী আমাদের ঐতিহ্যকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে, একই সাথে আরো বেশী মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ”

আফ্রিকা টাইমস সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে এবার কোরবানির পশুর দাম দ্বিগুণ ছিল। গবাদি পশু বিক্রেতারা জানায়, আগে কোরবানির আগেবাগেই বেশিরভাগ পশু বিক্রি হয়ে গেলেও এবার বিক্রি কমে গেছে এবং যারা কিনছে তারা খুব বেশি দামে কিনতে পারছে না।

ঈদে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সড়কগুলো বেশ ফাঁকা ছিল লকডাউনের কারণে। সেখানে কর্তৃপক্ষ ১০ দিনের লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ায় মসজিদে ঈদের নামাজও বাতিল করা হয়েছে। তবে ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলের সুলাইমানিয়া শহরে কঠোর কারফিউ সত্ত্বেও বিপুল জনসমাগমের মাধ্যমে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়ও পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। রাজধানী দামেস্কসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদে মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সিরিয়া সরকার ঈদগাহে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয় নি।

ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, ২৭ হাজারের বেশি মুসল্লি পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে নামাজ আদায় করেন। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এবং নাগরিকের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি দেন।

কসোভো এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মসজিদ বন্ধ থাকায় ঈদের নামাজে অংশ নিতে পারেননি মুসল্লিরা। লেবাননে মুসলিমরা কঠোর নিরাপত্তার ও বিধি-নিষেধের মধ্যে মসজিদে নামাজ আদায় করেছে। সেখানে বৃহস্পতিবার থেকে আংশিক লকডাউন জারি করা হয়েছে যা ১০ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। ঈদে রাজধানী বৈরুতের মোহাম্মদ আল-আমিন মসজিদে দেখা গেছে সামাজিক দুরত্বের নিয়ম মানতে মুসল্লিরা রাস্তায় দাঁড়িয়েও নামাজ আদায় করেছে।