স্বাস্থ্য-সচিবের স্মৃতিতে ১৫ আগস্ট


ঢাকা : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান (লেখক নাম হোসেন আবদুল মান্নান) প্রজাতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কর্মচারী চেতনায়-চিন্তায়ও শ্রেষ্ঠ। লেখালেখিতে অনন্য, সিদ্ধহস্ত। ইতিহাস-আশ্রিত, কালোত্তীর্ণ কখনো বা সমসাময়িক লেখাগুচ্ছ দিয়ে বারেবারে প্রমাণ করেছেন তার চেতনার শ্রেষ্ঠত্ব।

আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। জাতির স্বজন হারানোর দিন, জাতির জনক হারানোর দিন। এই দিনকে সামনে রেখে তিনি পাঠককে দিয়েছেন স্মৃতি হাতড়ে অনবদ্য এক লেখা; ‘দুঃসংবাদ’। নিজের ফেসবুকে দেওয়া সেই লেখায় তিনি স্মৃতিতরঙ্গের ঝাাঁপি খুলে দিয়েছেন।

সেই সময় অষ্টম শ্রেণীতে পড়া কিশোর মান্নান তাঁর লেখায় চেনু মামা, বাবার শোকাভিভূত উদ্বেগ, ভবিষ্যৎ শংকা, গুমোট আকাশ, তখসকার গ্রামবাংলার চিত্র- সবই তুলে এনেছেন প্রাঞ্জলতায়। একুশে পত্রিকার পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

১৫ আগস্ট ‘৭৫ সাল। আজো আমার স্মৃতিতরঙ্গে স্পষ্ট ভেসে আসছে। তখন সকাল সাতটা হবে। বাবার সাথে আমার এক চাচা এবং আমি বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি। বর্ষাকাল। বাড়ির একেবারে কাছাকাছি আঙিনাতেই পানি থৈথৈ করছে। তখনকার দিনে বর্ষা মানে আজকের মত নয়। বর্ষা মানে বৃষ্টিবাদলে প্রায় জিম্মি, কাঁচা রাস্তায় সাপ, ব্যাঙ, কেঁচোর আর চিরচেনা ভেজা পাটের সোঁদা গন্ধের আধিপত্য নিয়ে বেশ ক’মাস ভাটিবাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জলাবদ্ধ অবস্থায় সীমিত স্থানে বসবাস করতে হতো। নৌকাই ছিল চলাফেরার অন্যতম প্রধান সম্বল। আমাদের বাড়ির প্রায় চারদিকে তখনও পানি ছিল। তবে রেলস্টেশনে আসা যাওয়ার বড় রাস্তাটি শুকনো থাকায় কাঁদা পিচ্ছিল থাকলেও হেঁটে আসার মতো সুযোগ ছিল।

মানিকখালি রেলস্টেশন থেকে আধা কি.মি. রাস্তা আমাদের বাড়ি। বাড়ি থেকে ট্রেন চলাচলের শব্দ, হুইশেলের শব্দ, মানুষের কোলাহল সবই সহজে শোনা যায়। ট্রেন থেকে নেমে সকলে পদব্রজে বাড়ি আসতো। সে সময় অন্য কোনও বাহনের কথা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতো না। সেদিনই সকালের ট্রেনে আমার মামা প্রয়াত ছারওয়ার উদ্দিন আহমেদ আমাদের বাড়িতে আসেন। তিনি বাড়িতে ঢুকে দূর থেকে বাবাকে দেখেই চিৎকার করে বলতে থাকেন “ভাইসাব ট্রেনে সাংঘাতিক এক খারাপ সংবাদ শুনে আসলাম, শেখ সাহেবকে নাকি মেরে ফেলেছে!”

আরে বলো কী তুমি! কোথায়, কীভাবে, কারা মারলো? বাবার এমন নানা প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে মামা বললেন, “আমি ট্রেনের কম্পার্টম্যান্টভরা মানুষকে আলাপ করতে শুনেছি। তবে মানুষের মধ্যে কেমন যেন চাপা ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। সবাই কানাকানি করছে। এসব শুনে আমি নিজেও ভয় পেয়ে গেছি।” বাবা হঠাৎ একদম নির্বাক। তাড়াতাড়ি টিউবওয়েলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন এবং দ্রুত জামা পরে স্টেশনের দিকে রওয়ানা করেন। খবরের সত্যতা যাচাই করে দেখা এবং কে কী করছে বা কী করণীয় তা দেখাই মূল উদ্দেশ্য।

মামাকে বাড়িতে রেখে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে হতাশ, বিষণ্ন এবং ভগ্ন মনোরথে বাজার থেকে ফিরে আসেন বাবা। বাবার বয়স তখন চল্লিশোর্ধ আর আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সেদিন বাবাকে দিনভর অস্থির বিচলিত দেখেছিলাম।

দুপুরে মামাকে নিয়ে খাওয়ার সময় বাবা বলেছিলেন, “দেখো চেনু, (মামার ডাক নাম) তোমরা চাকরি-বাকরি কর ঠিক আছে; তবে এই দেশের কপালে কিন্তু চরম ভোগান্তি আছে।” আজকের এই শোকাবহ দিনে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সকল শহীদ সদস্যের প্রতি বাঙালি হিসেবে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।