চট্টগ্রামের সাবেক আরডিসি-এনডিসি’র পেটে শত কোটি টাকার সরকারি জমি!

একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের সাবেক আরডিসি-এনডিসিসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্রের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার সরকারি জমি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ, ১৯৭৯ সালে ‘কল্লোল গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে একটি সংগঠনকে বন্দোবস্তি দেওয়া ৩ দশমিক ৩৭ একর খাস জমি নিজেদের নামে দলিল করে নিয়েছেন তৎকালীন আরডিসি-এনডিসিসহ সংশ্লিষ্ট ভূমিদস্যু চক্র।

বর্তমানে এ জমি নানা কায়দায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দখলে রেখেছেন জনৈক জুনাব আলী ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দিদারুল আলমসহ প্রভাবশালী একটি চক্র।
সমিতিকে বন্দোবস্তি দেওয়া জমির দখল সমিতিকে বুঝিয়ে দিতে জেলা প্রশাসন একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও নগরের বায়েজিদ বোস্তামি বাংলাবাজার এলাকার জুনাব আলী ও তার সহযোগীদের কূটকৌশলের কারণে তার বার বার ভেস্তে যায়। সরকারি ও আধাসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই মূলত কল্লোল গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড সদস্য।

বিষয়টির তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কল্লোল গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. বাদশা মিয়া।
বিষয়টির তদন্ত করা হবে বলে একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন দুদক, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক লুৎফুল কবীর চন্দন।

দুদকে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭৯ সালে কল্লোল গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড সরকারি জমি স্থায়ী বন্দোবস্তি পেতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। এর প্রেক্ষিতে সংগঠনটিকে চট্টগ্রাম মহানগরের পূর্ব নাসিরাবাদ মৌজার বিএস ২৭৩ নং প্লটের ৩ দশমিক ৩৭ একর কৃষি জমি স্থায়ী বন্দোবস্তি দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়।
জমিটি সমিতির নামে দলিল সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তৎকালীন আরডিসি মোহাম্মদ এয়াকুব আলী ও এনডিসি মোহাম্মদ আবুল হোসেন এবং সমিতির তৎকালীন সেক্রেটারী একেএম কবির উদ্দিন আহমেদ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে ২৮জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বন্দোবস্তি দলিল (৭৪৪৩) সম্পাদন করেন।

অভিযোগে বলা হয়, সমিতির সদস্য না হয়েও তৎকালীন আরডিসি মোহাম্মদ এয়াকুব আলী ও এনডিসি মোহাম্মদ আবুল হোসেনসহ আরও চার ব্যক্তির নামেও অবৈধভাবে দলিলটি সম্পাদন করা হয়। চক্রটি সরকারি এ সম্পত্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে একাধিক ভুয়া দলিল তৈরি এবং বিক্রির চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা যায়, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ওই জমির অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে সমিতিকে বুঝিয়ে দিতে একাধিকবার আদেশ দেওয়ার পরও ‘রহস্যজনক’ কারণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেননি। ২০১৩ সালে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারুক আহম্মদ অবৈধ দখলদার এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও জমিটি সরকারের কোনও প্রতিনিধিকে বুঝিয়ে না দিয়ে রহস্যজনক কারণে তিনি জমির দখল বুঝিয়ে দেন জুনাব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও ক্রীড়া সংগঠক দিদারুল আলম চৌধুরী, মো. নেছার উদ্দিন দুলুসহ আরও কয়েকজনকে। ফলে সমিতিকে বন্দোবস্তি দেওয়া সরকারের ওই জমি ফিরে পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অভিযোগ আছে, সরকরি সম্পদ আত্মসাত ‘জায়েজ’ করতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও সমবায় আইন উপেক্ষা করে তৎকালীন আরডিসি ও এনডিসি এবং জুনাব আলীকে সমিতির সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে জুনাব আলী কখনো সমিতির চেয়ারম্যান আবার কখনও সমিতির সেক্রেটারি সেজে গোপনে সমিতির ১৮জন সদস্যের নামে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে একের পর এক ‘বায়নানামা’ দলিল তৈরি করে নেন। জমি বিক্রির জন্য পত্রিকায় কথিত দরপত্র আহ্বান করেন সমিতির সাবেক সেক্রেটারি ফখরুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ ওই চক্র। তবে তাদের এ প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।

জানা যায়, ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা- এবং সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে জুনাব আলীকে সমিতির সাধারণ সভায় কড়া সতর্ক করা হয়। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি সমিতির সদস্য পদ থেকে জুনাব আলীকে বহিষ্কারও করা হয়।
বন্দোবস্তি দলিলের ১১ নং শর্ত মতে, জেলা প্রশাসক এবং সমিতির পূর্ব-অনুমতি ব্যতীত সমিতির সদস্য বা অপর ব্যক্তির কাছে বিক্রি কিংবা হস্তান্তরে নিষেধ রয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রামের তৎকালীন আরডিসি মোহাম্মদ এয়াকুব আলী একুশে পত্রিকাকে বলেন, সরকার সমিতিকে জমিটি বন্দোবস্তি দিয়েছে। পরে একাধিক দলিল বানিয়ে জাল জালিয়াতি হয়েছে বলে শুনেছি। সমিতির সাথে আমি এক সময় ছিলাম। এখন নেই।

বন্দোবস্তি দলিল সম্পাদনের সময় আপনি কল্লোল গৃহ নির্মাণ সমিতির সদস্য ছিলেন না, তাহলে সমবায় আইনের কোন ধারায় দলিলে আপনার নাম অর্ন্তভুক্ত করা হলো-এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এয়াকুব আলী।
চট্টগ্রাম জেলার সাবেক এনডিসি মোহাম্মদ আবুল হোসেনের মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সমিতির বর্তমান সেক্রেটারি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ, সমবায় সমিতির অডিট প্রতিবেদনেও জুনাব আলীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সমিতির অর্থ ও সম্পত্তি আত্মসাতের চিত্র উঠে আসে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ৭ মে ও ২০১৯ সালের ১৮ জুন সমিতির অডিট আপত্তি ও বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসার শেখ কামাল হোসেন। রহস্যজনক কারণে শত কোটি টাকার এ সম্পত্তি উদ্ধারসহ সমিতির অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি শেখ কামাল হোসেন।

ভূমি জবর দখল, ভূমি বন্দোবস্তির শর্তভঙ্গ করে অবৈধ বায়নানামা দলিল তৈরি ও অবৈধভাবে সমিতির সদস্য হওয়া প্রসঙ্গে জুনাব আলী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আপনাদের (প্রতিবেদক) কী সমস্যা? এগুলো নিয়ে আপনারা কেন মাতামাতি করছেন? সরকার জনগণকে জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে ৫০ বছর আগে। এখন কেন এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। এ বিষয় নিয়ে কিছু পেলে আপনারা পত্রিকায় যা ইচ্ছা তা লিখে দেন।’

সমিতির সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ প্রসঙ্গে জুনাব আলী বলেন, ‘এটা ভূল। সমিতির ২০জন সদস্য আমাকে বায়নানামা দলিল দিয়েছেন। ৬জন সদস্য মারা গেছেন। আর অবশিষ্ট ৩ জন আমাকে বায়নানামা দলিল না দিয়ে বিভিন্নভাবে ঝামেলা পাকাচ্ছেন।

কল্লোল গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতির সম্পত্তি বেহাত ও অডিট আপত্তির বিষয়ে শুনানির পর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা সমবায় অফিসার শেখ কামাল হোসেন বলেন, ‘ সমিতির সম্পত্তি বেহাত ও অডিট আপত্তির বিষয়ে শুনানি হয়েছে। এখন বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জায়গাটির অবস্থান শেরশাহ বাংলাবাজারের পশ্চিমে ডেবারপাড় এলাকায় বুরহান বিএসআরএম স্কুলের পেছনে পাহাড়ের পাদদেশে। জায়গাটির আয়তন পূর্ব পশ্চিমে প্রায় এক হাজার ফুট। উত্তর দক্ষিণে প্রায় চারশ’ ফুট। জায়গাটির মাঝখানে পূর্ব পশ্চিমে আছে প্রশস্ত রাস্তা। দুপাশে আছে বড় বড় অন্তত ৩০টি প্লট। প্রত্যেক প্লটে মাটি থেকে চার ফুট উচ্চতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কিছু প্লটে বেড়া ও টিনশেড দিয়ে তৈরি ঘরে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার। জায়গাটির পশ্চিম উত্তর কোণায় শোভা পাচ্ছে একটি সাইনবোর্ড। সেটিতে লেখা আছে কল্লোল গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি।

সেখানে বসবাসকারী এক যুবক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জুনাব আলী জায়গাটির মালিক দাবি করছেন। কিন্তু আমরা শুনছি এটি সরকারি জায়গা। জুনাব আলী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অনেক ভুয়া দলিল করে প্লট আকারে বিভিন্নজনের কাছে জায়গাটি বিক্রি করেছেন। এখনো করছেন।”

এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, “বিষয়টি প্রায় ৪০ বছর আগের। আমি কিছুই জানি না। না বুঝে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমার করণীয় কিছু থাকলে আমি করবো।’

বাংলাবাজার ডেবার পাড়ে সরকারি জমি দখলে রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে দিদারুল আলম চৌধুরী একুশে পত্রিকার কাছে দাবি করেন, বাংলাবাজার ডেবারপাড়ে কল্লোল গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি নামের কোনও সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত নন। তিনি বলেন, সরকারি জায়গা দখলের সাথে আমার নাম জড়িয়ে সাংবাদিকদের মিথ্যা তথ্যে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আমার জায়গা গুলশান আবাসিক এলাকায়, ডেবারপাড়ে নয়।- বলেন দিদারুল আলম।