কারাগার নয়, যেন মাদকের আখড়া!

একুশে প্রতিবেদক : ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সাবেক জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহে নগদ টাকা ও মাদকসহ গ্রেফতারের পর কিছুদিন দুর্নীতি বন্ধ থাকলেও আবারও সেই পুরোনো চেহারায় ফিরে গেছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারে এখন টাকা দিলেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য। কারাগার নয়, যেন মাদকের আখড়া! অনুসন্ধান ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছেন এসব তথ্য।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, কারাগারে মাদক ব্যবসায় জড়িত আছে কারারক্ষী ও কয়েদিদের ৭-৮ জনের একটি সিন্ডিকেট। মাদক সংশ্লিষ্টতার দায়ে গত এক বছরে অন্তত ৩২ জন বন্দীকে কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তি দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এসময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মাদক উদ্ধারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বন্দীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ৮টি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে ৮ হাজারের বেশি বন্দী থাকে। এরমধ্যে ৬৫ শতাংশই মাদক মামলার আসামি। কারাগারে এক পিস ইয়াবা বিক্রি হয় ১ থেকে ১৪শ’ টাকায়। এক পুরিয়া গাঁজা বিক্রি হয় দেড়শ’ টাকার ওপরে। কারাগারের বাইরে এক পিস ইয়াবা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এক পুরিয়া গাঁজা বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।

কারাগারের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসার প্রমাণ মেলে ২০১৯ সালের ১৫ জুন। ওইদিন রাতে নগরের কদমতলী এলাকা থেকে ৫০ পিস ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন কারারক্ষী সাইফুল ইসলাম এবং দিদারুল আলম ও আলো আক্তার নামে এক নারী। গ্রেফতারের পর তারা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর আলমের নির্দেশে তাঁরা ইয়াবা ও গাঁজা সংগ্রহ করে কারারক্ষী সাইফুলকে সরবরাহ করেন। সাইফুল তা আলমের কাছে পৌঁছে দেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছু বন্দী আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় সহযোগীদের কাছ থেকে মাদক নিয়ে আসেন। ২০১৯ সালের ২১ জুলাই কারাগারের ভেতরে মাদক মামলার এক আসামির পেট থেকে ১ হাজার ২৮৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ। হাজতি সাজিদুল ইসলাম ওরফে পলাশের পেট থেকে এসব ইয়াবা বের করা হয়। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবার শ্যামপুর গ্রামে।

এর আগে গত ১৭ জুন নূর মোহাম্মদ নামে এক বন্দী আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পর তার কাছ থেকে ৩৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে কারাকর্তৃপক্ষ। একই বছরের ১১ জুন কারাগারের ভেতর থেকে মনির উদ্দিন নামে এক বন্দীর কাছ থেকে ১৪ পিস এবং সাইফুল করিম নামে আরেক বন্দীর হেফাজত থেকে ১৬ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ আছে, কারারক্ষী হুমায়ুন, ফিরোজ গত এক যুগ ধরেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। তারা টাকার বিনিময়ে বন্দিদের সরবরাহ দেন মেমরি কার্ড, পেনড্রাইভ এমনকি রেডিও। ২০০ টাকার মেমরি কার্ড বন্দীদের মধ্যে বিক্রি করেন ১ হাজার টাকা, ৫০০ টাকার রেডিও বিক্রি করেন দুই হাজার টাকায়।

কারারক্ষী মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ; তিনি কারা হাসপাতালের চিকিৎসকের সহায়তাকারী। তার কাজ হচ্ছে মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আসা টেকনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দাদের উপর বিশেষ নজর রাখা। আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় এসব অপরাধী কারাগারে পেটের ভেতরে করে নিয়ে আসেন ইয়াবা। তাদের কাছ থেকে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করেন কারা সহকারী সবুজ দাশ ও মোহন মিয়া।

অভিযোগ আছে, উদ্ধার করা ইয়াবাগুলো তারা কারা প্রশাসনের কাছে জমা না দিয়ে বাইরে বিক্রি করে দেন। আদালতে হাজিরা শেষে কারাগারে মাদক নিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট আসামিদের কাছ প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেন তারা। ইয়াবা-সন্দিগ্ধ আসামিকে পায়খানা করানোর ওষুধ কারা হাসপাতাল থেকে এনে কারারক্ষী সবুজ দাশ ও মোহন মিয়াকে দেন হাবীব মোল্লা। এরপর সবুজ ও মোহন আসামিদের থেকে বিশেষ কৌশলে উদ্ধার করেন ইয়াবা। এভাবে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কারা অভ্যন্তরে যেসব কয়েদি ইয়াবাকা-ে জড়িত তারা হলেন- ইকবাল, ভুট্টো, ইয়াসিন, লেদু। তাদের সহযোগী হিসাবে আছেন কারা হাসপাতালের রাইটার সাহেদ।

জানা গেছে, গত প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে বন্দিদের সাথে স্বজনদের দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ। কিন্তু স্বজনদের সাথে বন্দিদের কথা বলতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুবিধা চালু করেছে সরকার। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া কুমিল্লা বুড়িচং থানার বাসিন্দা শফিউল্লাহ জানান, টাকার বিনিময়ে স্বজনদের কাছে একাধিকবার ফোন কল করার সুযোগ করে দিচ্ছেন সবুজ ও মোহন। সবুজ দাশ বরখাস্ত হওয়া সাবেক জেলার সোহেল রানার আমলে কারা ক্যান্টিনের ম্যানেজার ছিলেন।

মাদক মামলায় সম্প্রতি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা ইকবাল আল ফারুক জানান, কারারক্ষী সহকারী হাবীব মোল্লা ছিলেন কক্সবাজার কারাগারে ক্যান্টিনের ম্যানেজার। এ কারণে হাবীব মোল্লার সাথে মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আসা অনেক আসামির সখ্যতা রয়েছে। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত বন্দিদের জন্য কারা হাসপাতালে সংগৃহীত দামি ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেন হাবীব মোল্লা।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার (বরখাস্ত) সোহেল রানা বিশ্বাসকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

জেলার সোহেল রানার ঘটনায় গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও কারাগারে মাদক ব্যবসার কথা উঠে আসে। তদন্ত রিপোর্টে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন কারাগারের অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। কারাঅভ্যন্তরে মাদক ব্যবসা, দুনীতি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে মন্ত্রণালয়ের ওই তদন্ত রিপোর্টে।

জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশে একই বছর জুলাই মাসে কারাঅভ্যন্তরে মাদক ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান দলটির নেতৃত্বে থাকা দুদকের পরিচালক মো. ইউসুফ গণমাধ্যমে জানান, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে খাবারের সঙ্গেও মাদক ঢোকে।

ওয়াকিল আহমদ, মনছুর আলী ও আব্দুর রাজ্জাক নামে কয়েকজন কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে একুশে পত্রিকাকে বলেন, কারাগারের ভিতরে বিভিন্ন জায়গা ‘ভাড়া’ দেওয়া হয়। মাসিক ১ থেকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে কারারক্ষী ও কয়েদিদের একটি সিন্ডিকেট জায়গা ভাড়ায় নেন। যারা কারাগারে যান তারা কোথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন তা নির্ভর করে সিন্ডিকেটের ওপর। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা এ সুবিধা দেন। কৌশলে কারাগারে যেমন মাদক ঢোকে আবার কারাগারের ভেতরেই টাকার বিনিময়ে ইয়াবা ও গাঁজাসহ আরো অনেক মাদক পাওয়া যায়। কারাগারের ভেতরে কারারক্ষীদের ওই সিন্ডিকেট মাদক-ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ আছে।

গত সপ্তাহে জামিনে মুক্ত হওয়া মাদক মামলার আদামি আব্দুর রশিদ জানান, ‘করোনার কারণে গত প্রায় এক বছর দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকলেও ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে দেখা করার ব্যবস্থা ছিল। করোনার কারণে কারাগারের একটি সিন্ডিকেট এখন কারাগার থেকে বাইরে মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য বন্দিদের থেকে প্রতি তিন মিনিটে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কারাগারে আছে সিটবাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য ও ক্যান্টিন-বাণিজ্য। একটি সিট পেতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্টদের হাতে।

সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া ফরিদ ও আকবর জানান, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারগারে টাকা দিলে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে যে কেউ অসুস্থ না হয়েও কারা হাসপাতালে আরাম আয়েশে থাকতে পারেন। টাকা বেশি হলে বাইরের হাসপাতালেও থাকার সুযোগ আছে। আর জামিনের আদেশ কারাগারে যাওয়ার পর টাকা না দিলে বন্দিরা ছাড়া পান না।

তবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদক ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম-দুনীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আপনি (প্রতিবেদক) যে অভিযোগগুলোর কথা বলছেন সেগুলো তিন বছর আগের। এখন ওই পরিস্থিতি চট্টগ্রাম কারাগারে নেই। মাদক প্রতিরোধে কারাগারের ১২০ ওয়ার্ডে, বন্দিদের মধ্য থেকে ৫ জন করে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। স্ক্যান মেশিনে চেক করা ছাড়া কোনও বন্দী কারাগারের ভেতরে ঢুকতে পারে না। করোনার কারণে প্রায় এক বছর আদালতে মাদকসহ অন্যান্য মামলায় আসামিদের হাজিরা খুব একটা নেই। তাহলে বাইরে থেকে মাদক ঢুকবে কীভাবে।’

সাবেক জেলার সোহেল রানার ঘটনার পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারের অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। এখনো বিষয়টি দুদক তদন্ত করছে। তাহলে কীভাবে শতভাগ নিশ্চিত যে, চট্টগ্রাম কারাগারে মাদক বেচাকেনা নেই কিংবা অনিয়ম নেই, কারারক্ষীদের সিন্ডিকেট নেই?-এমন প্রশ্নে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারা অভ্যন্তরে কোনওপ্রকার মাদকব্যবসা বা অনিয়মের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান খুবই পরিস্কার। আমরা অধিক সতর্ক। কোনও কারারক্ষী মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদের নাম পেলে আমাদের অবহিত করে সহায়তা করুন। -বলেন সিনিয়র জেল সুপার।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদকের বিস্তারসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদকের বিস্তারসহ যে কোনও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আপনারা (প্রতিবেদক) সুনির্দিষ্ট তথ্য দিন। আজই ব্যবস্থা নেব। শুধু কারাগার নয়, জেলা প্রশাসনের অধীন যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আগেকার পরিস্থিতি নেই বলে দাবি করেছেন বেসরকারি কারা পরিদশক জিনাত সোহানা চৌধুরী। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, সোহেল রানা জেলার থাকা অবস্থায় কারাগারের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিশৃংখল পরিস্থিতি ছিল। চুইংগামের ভেতর দিয়ে ইয়াবা পাচার হতো। অনেক সময় মাদকও ধরা পড়েছে। এখন কারা অভ্যন্তরে পরিবেশ অনেক সুশৃঙ্খল। কোনও কারারক্ষী বা সহকারী গোপনে ইয়াবাকা-ে জড়িত থাকলে কী করার আছে। সাড়ে তিন হাজার ধারণ ক্ষমতার কারাগারে এখন বন্দি আছে ৮ হাজার। আছে পানির সংকট। কারাগারের অভ্যন্তরে একতলা ভবনগুলো বহুতল করার জন্য আমারা সুপারিশ করেছি। এগুলো তৈরি করা গেলে কারাগারে সমস্যা অনেকাংশে নিরসন হবে।’

কারা অভ্যন্তরের পরিস্থিতি নিয়ে একইরকম মন্তব্য করেছেন আরেক কারা পরিদর্শক আবদুল হান্নান লিটন। তিনি বলেন, ‘আদালতের হাজিরা শেষে কারাগারে আসা এক হাজতির পেট থেকে (পায়খানা করিয়ে) ইয়াবা উদ্ধার করতে আমি দেখেছি। তবে এখন সেই অবস্থা নেই।’

একুশে/এমআর/এটি