শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মায়ের লাশ মিলছে, কিন্তু নবজাতক ভাইকে পাচ্ছেন না ইসমাইল!

প্রকাশিতঃ ৩ মার্চ ২০২১ | ৭:২৮ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : সন্তান প্রসবের সময় মারা গেছেন হাজেরা খাতুন (৪৫) নামের একজন মা। পরে সেই মা ও নবজাতক সন্তানকে নেয়া হয় চট্টগ্রাম নগরের পার্কভিউ হাসপাতালে।

সেখান থেকে হাজেরা খাতুনের লাশের পাশাপাশি নবজাতক শিশুকেও পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু মায়ের লাশ নিতে বলা হলেও নবজাতক ভাইকে নিতে পারছেন না ইসমাইল হোসেন নামের ২৫ বছরের এক যুবক।

ইসমাইলের অভিযোগ, নবজাতক শিশুটিকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বিক্রির চেষ্টা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।

এর আগে গত ১ মার্চ রাত আড়াইটার দিকে নগরের পাঁচলাইশের কাতালগঞ্জ ২ নং রোডের পাশে নিজ বাসায় বাচ্চা প্রসবের সময় মারা যান হাজেরা খাতুন। প্রসবের সময় হাজেরা খাতুনের পরিবারের কোনো সদস্য উপস্থিত না থাকায় নবজাতক ও মরদেহ পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যান পাঁচলাইশ থানা পুলিশের সদস্যরা।

পরবর্তীতে হাজেরা খাতুনের বড় ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন মায়ের মরদেহ ও নবজাতক শিশুকে নিতে পার্কভিউ হাসপাতালে আসলেই শুরু হয় বিপত্তি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইসমাইল ও তার পরিবারের সদস্যদের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে বলে।

এদিকে, ইসমাইল গত ২ মার্চ এ বিষয়ে পাঁচলাইশ থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ মরদেহ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি জানালেও বাচ্চা দিতে রাজি হয়নি। সে সময় পরিবারের সদস্যদের পুলিশ জানায়, দুই-তিনদিন পরে এসে বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আজ বুধবার পর্যন্ত মরদেহ বা নবজাতক- কাউকেই বুঝে পায়নি পরিবার।

মায়ের লাশ ও নবজাতক ভাইকে নিয়ে হাসপাতাল ও পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ইসমাইলের ভোগান্তির শিকার হওয়ার প্রমাণও মিলেছে বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে। একুশে পত্রিকার হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পার্কভিউ হাসপাতালে গিয়ে নিজের ভাইকে দেখতে চেয়ে কর্তব্যরত নার্সের কাছে বারবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন ইসমাইল। এসময় ইসমাইলের সাথে বেশ দুর্ব্যবহার করতে দেখা যায় সেই নার্সকে। ৩ ঘন্টা চেষ্টার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি ইসমাইল।

অন্য একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পাঁচলাইশ থানা পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার পর দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন ইসমাইল। ভিডিওটিতে দেখা যায়, সমস্যার সমাধান পেতে পাঁচলাইশ থানার জামাল নামে এক পুলিশ সদস্যের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন ইসমাইল। তখন ওই পুলিশ সদস্য অকথ্য ভাষায় ইসমাইলকে গালিগালাজ করেন। বারবার অনুরোধ করেও সহায়তার বদলে দুর্ব্যবহার করা হয় ইসমাইলের সাথে। এসময় সহায়তার জন্য থানায় আসায় বিরক্তি প্রকাশ করেন জামাল নামের ওই পুলিশ সদস্য। একসময় থানা থেকে তাদের চলে যেতে বলা হয়।

নিজের ভোগান্তির কথা জানাতে গিয়ে ইসমাইল হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বাবা গত ছয় মাস আগে মারা গেছেন। এখন আমার মা-ও মারা গেছেন। মায়ের ‍মৃত্যুর সময় আমি গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। পরিবারের কোনো সদস্য না থাকায় পাঁচলাইশ থানা পুলিশের সদস্যরা আমার মা ও নবজাতক ভাইকে পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার মায়ের লাশ দিতে রাজি হলেও বাচ্চাকে দিতে অসম্মতি জানায়। আমি এখন পর্যন্ত এটা জানি না যে, আমার ভাই হয়েছে নাকি বোন। একটিবারের জন্যও বাচ্চার চেহারা দেখতে পারিনি। গত দু’দিনে দুইবার হাসপাতালে গিয়েছিলাম, ওরা আমাদের সাথে কথা না বলে বারবার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।’

পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে ইসমাইল বলেন, ‘এত আহাজারির পর পুলিশ প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা করছে না। উল্টো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তারা সহযোগিতা করছে। আমাদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। আমরা বলেছি, প্রয়োজনে আমরা প্রমাণ দিবো যে আমি নবজাতকের ভাই। কিন্তু তারা শুধু লাশ নিয়ে যেতে বলে, বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা নিশ্চুপ থাকে। আর হাসপাতাল বলে, পুলিশকে নিয়ে আসলে বাচ্চা দেওয়া হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা তাদের লাশ দিতে চাচ্ছি। কিন্তু তারা বাচ্চা ছাড়া লাশ নিতে চাচ্ছে না। তাই লাশটি আমরা আনজুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় আমরা বাচ্চা তাদের দিতে চাচ্ছি না।’

তিনি বলেন, ‘বাচ্চা দেওয়ার জন্য আমরা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। কারণ আদালতের নির্দেশনা ছাড়া আমরা কিছু করতে পারবো না। বাচ্চার ফয়সালা আদালত করবে। এই বিষয়ে আমরা একটি জিডি করে আদালতকে জানিয়ে দিচ্ছি। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে। যার কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান হবে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা চাইলে নিজস্ব বিবেচনার মাধ্যমে কোনো মরদেহ দাফন-সৎকারের জন্য দিতে পারি। কিন্তু যখন একটি বাচ্চা বেওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া যায়, তখন সেটার আসল অভিভাবককে ছাড়া কাউকে দিতে পারি না। কারণ পরবর্তীতে অন্য কেউ যদি নিজেকে বাচ্চাটির অভিভাবক হিসেবে দাবি করে, তখন আমরা আইনি জটিলতায় পড়বো।

তিনি আরও বলেন, ‘বাচ্চাটি ছেলে। প্রয়োজনে বাচ্চাটির আসল অভিভাবককে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আমরা সকল ধরনের সহায়তা করবো। এমনকি আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা তাদের পাশে থাকবো। তবে এই বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমাধান করা হবে।’

অন্যদিকে সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে পার্কভিউ হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার তালুকদার জিয়াউর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘থানা থেকেই আমাদেরকে বাচ্চাটিকে দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা এই ক্ষেত্রে জিম্মাদার। যেভাবে থানা আমাদের নির্দেশনা দেবে, আমরা সেভাবেই কাজ করবো।’

হাসপাতালের কর্মরত নার্সের দুর্ব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করা হয়নি। উল্টো তারা আমাদের সাথে বেশকিছু বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও ঝগড়া করেছে। এছাড়া তো কোনো সমস্যা নেই।’

তালুকদার জিয়াউর রহমান বলেন, বাচ্চাটিকে দেখতে একসাথে অনেকজন আমাদের কাছে এসেছে। তখন আমরা তাদের বলেছি, থানা থেকে যদি বাচ্চাটিকে দেখতে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সেটা অনুসরণ করবো।

‘তারপরও এখন যদি কেউ দেখতে চায় তাহলে আমরা অবশ্যই দেখার সুযোগ দিবো। আপনি এক্ষুণি তাদের বলুন আসতে, তাহলে আমি নিজেই দেখার ব্যবস্থা করে দিবো।’