কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিতে নিয়োগবিধি অমান্য!

আবছার রাফি : নিয়োগবিধি অমান্য করে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ১৮১টি শূন্য পদে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রেক্ষিতে নিয়োগবিধি মেনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে পুনরায় প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠিও দিয়েছে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাপশিস) ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)।

কিন্তু দেশের দুই কারিগরি শিক্ষক সমিতি ও আইডিইবি’র অনুরোধ সরকারি কর্মকর্তারা তো রাখলেনই না, আরও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তড়িগড়ি করে মাত্র ৩৯ দিনের ব্যবধানে (১২ জুন ) লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বসেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ কারিগরি শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যেভাবে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আত্মীয়-স্বজনদের চাকুরি দেয়া ও কারিগরি শিক্ষাকে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র থাকাও অমূলক নয়।

জানা গেছে, গত ৩ মে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী রাজস্ব খাতের ২ হাজার ১৮১টি শূন্য পদ পূরণের লক্ষ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। এ বিজ্ঞপ্তিতে কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা হয়নি কোনো পদ। বরং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় এমন সব বিষয়ের পদে পদার্থ-রসায়নে স্নাতক সম্পন্ন করা সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি বড়সড়ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে গত বছরের ১৪ নভেম্বর ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও অধিদপ্তরাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্যাডার বহির্ভূত গেজেটেড ও নন-গেজেটেড (কর্মকর্তা-কর্মচারী) নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বিধিমালা-২০২০’ প্রকাশ করে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ। সেই নিয়োগবিধিতে উল্লেখ করা হয়, ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর ( সপ, ইলেকট্রনিক্স বা টেক, টিআর, ল্যাব) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীকে – কোন স্বীকৃত বোর্ড হইতে (ক) সংশ্লিষ্ট ট্রেডে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (ভোকেশনাল) উত্তীর্ণ অথবা (খ) সংশ্লিষ্ট ট্রেডে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (ভোকেশনাল) বা দাখিল (ভোকেশনাল)সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্যূন ২ (দুই) বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা অথবা (গ) বিজ্ঞানে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষা উত্তীর্ণসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অন্যূন ১ (এক) বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা অথবা (ঘ) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণসহ ২ (দুই) বছর মেয়াদী ট্রেড কোর্সে উত্তীর্ণ অথবা জাতীয় দক্ষতা মান ২ এবং ৩ উত্তীর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।

কিন্তু গত ৩ মে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ, টিআর, ল্যাব, ইলেকট্রনিক্স, টেক) এর ২ হাজার ১৮১টি শুন্য পদে প্রকৃত বাংলাদেশী নাগরিকের কাছ থেকে নিয়োগের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, পদার্থ বা রসায়নে ২য় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রী এবং কম্পিউটার পরিচালনায় দক্ষতা।

এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে গত ৫ মে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর একটি চিঠি দেয় দেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বৃহত্তম সংগঠন ইনিস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স, বাংলাদেশ। এতে উল্লেখ করা হয়, “নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উচ্চ মাধ্যমিক (ভোক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২ বছরের ট্রেড কোর্স এবং ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সন্নিবেশিত করার অর্থই হলো কারিগরি শিক্ষার ব্যক্তিগণ যাতে এই পদে আবেদন করতে না পারে। কারণ এইচএসসি (ভোক) উত্তীর্ণদের ২ বছরের ট্রেড পাশ ও ৫ বছরের অভিজ্ঞতা যুক্ত করা শুধু অযৌক্তিকই নয় বরং অন্যায় ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এইচএসসি (ভোক) উত্তীর্ণদের কোন যুক্তিতে ২ বছরের ট্রেড ও ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে তা ভাবার পর এটি যে একটি অসৎ চিন্তার ফসল তা বুঝতে বাকি থাকে না। উল্লেখিত পদে পদার্থ ও রসায়নে ২য় শ্রেণী যোগ্যতা নির্ধারণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দেওয়া ও কারিগরি শিক্ষাকে ধ্বংস করার এক গভীর ষড়যন্ত্র থাকা অমূলক নয়।”

চিঠিতে আরও বলা হয়, “বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, শনিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২০ এর বর্ণিত যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে অথবা পরিবর্তন করে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ/টিআর) পদে ৩ মে ২০২১ তারিখে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত পদের জন্য যে যোগ্যতা দেখানো হয়েছে, তাতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষতাবিহীন করে ধ্বংস করে ফেলারই নামান্তর। ১৯৫৪ থেকে অদ্যাবধি এ দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ সকল পদে এরুপ অকারিগরি ব্যক্তিদের এ পদে দেয়া হয় নাই।”

গত ২৭ মে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি যে চিঠি দিয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমরা উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করলাম যে, ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ), ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (টিআর/ইলেক্টনিকস/টেক) ও ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (টেক/ল্যাব) ইত্যাদি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসাবে পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি চাওয়া হয়েছে। অপরদিকে এসএসসি ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২ বছরের ট্রেড কোর্স ও ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। বাস্তব অর্থে এই পদে এসএসসি ও এইচএসসি (ভোক) পাশ ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া যাবে না। কারণ ১৯৯৫ সাল থেকে ২ বৎসরের এই কোর্সটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত নিয়োগ বিধিটি ১৪ নভেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত নিয়োগবিধির পরিপন্থি।’ এ প্রেক্ষিতে পদার্থ, রসায়নে ডিগ্রীধারীদের বাদ দিয়ে নিয়োগবিধি অনুযায়ী পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষকদের সংগঠনটি।

বাংলাদেশ টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ শিক্ষক সমিতি গত ৬ মে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর যে চিঠি দিয়েছে তাতে লেখা হয়েছে, “কারিগরি পদগুলোতে সাধারণ শিক্ষিতদের নিয়োগ দিলে, বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কারিগরি এসএসসি (ভোক) ও এইচএসসি (ভোক) গ্র্যাজুয়েটগণ শতভাগ বঞ্চিত হবে। ফলে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে কারিগরি শিক্ষার্থীর হার ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালে ৫০ শতাংশ অর্জন পুরোপুরি ব্যাহত হবে। অর্জিত হবে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আকাঙ্খা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।”

একদিকে নিয়োগবিধি উপেক্ষা, অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যে কারিগরি শিক্ষিতদের আগেভাগে চাকরি হওয়ার কথা সেখানে নিয়োগে এ যুগপৎ বৈষম্য ও বিভাজন। এতে ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চার শতাধিক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর পদের বিষয়াবলি অত্যন্ত গুরত্বসহকারে পড়ানো হয় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। টুলস ইকুইপমেন্ট ও মেশিনারিজ রক্ষণাবেক্ষণসহ সরাসরি ব্যবহারিক ক্লাসসমূহে এ বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। কাজেই কারিগরি শিক্ষার্থীরা এ পদে যে পরিমাণ খাটুনি-যতœ দিতে পারবে তা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা কোনোদিনও দিতে পারবে না।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও দেখা যায়, একই পদসমূহে বিকল্প যোগ্যতা হিসেবে চাওয়া হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক (ভোকেশনাল) পাশ। সাথে দুই বছরের ট্রেড কোর্স ও পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে বলছেন, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড ১৯৯৫ সালে দুই বছরের ট্রেড কোর্স কারিকুলামটি বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার সমন্বয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক (ভোকেশনাল) শিক্ষা চালু করেছে। ফলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অনুযায়ী এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাশ চাকরিপ্রার্থী পাওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিদ্দিক আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজগুলো ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল বেইসড এডুকেশন। এই প্র্যাকটিক্যাল বেইসড এডুকেশনে স্কিল্ড পারসন লাগে। এবং সেই কারণেই এই পোস্টগুলোতে এসএসসি (ভোক) ও এইচএসসি (ভোক) পাশ স্টুডেন্টদেরকে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘এক ডিপার্টমেন্টের ছাত্র অন্য ডির্পাটমেন্টে চাকরি করতে পারে না, আবেদন করতে পারে না। সেই জায়গায় বিজ্ঞপ্তিতে আসছে যারা বিজ্ঞানে পাশ করছে তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য, তারা কতটুকু স্কিলড? তারা কী এ কাজটা পারবে? যদি না পারে তাহলে আমাদের যে স্টুডেন্টরা তো কিছুই শিখবে না। সেজন্য স্কিলের স্বার্থে আমরা বলছি এই পদগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাকরি দেওয়া হোক।’

ছিদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে যে নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত হয়েছে ১৪ নভেম্বর ২০২০ তারিখে সেই বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। সেই নিয়োগ বিধিমালায় এই ছেলেদেরকে নেওয়ার কথা বলা আছে। নিয়োগ বিধিমালায় আছে, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের ওই সব পদে নিয়োগ দিবে। কিন্তু তারা উল্টোটা করছে, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।’

‘দেশ ও জাতির স্বার্থে দক্ষতা উন্নয়ন নীতির অর্থনীতি জরুরি। জননেত্রী শেখ হাসিনার আকাঙিক্ষত সেই উন্নত- দক্ষ বাংলাদেশ গড়তে অবশ্যই দক্ষতার প্রয়োজন। এবং সেই দক্ষতা অর্জন করতে হলে কারিগরি ছাত্রছাত্রীদের এ সমস্ত পোস্টে নিয়োগ দিতে হবে।’ – বলেন ছিদ্দিক আহমেদ।

চট্টগ্রামের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের দেশে এমনিতে দক্ষ জনবলের অভাব, তার ওপর যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে তো দক্ষতা একেবারে উঠে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার কারিগরি শিক্ষার উপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। ধাপে ধাপে দেশের প্রতিটি জেলায় ৫০১ টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ হবে। ৬৪টি পলিটেকনিক হবে। বিশ্বমানের পলিটেকনিক হবে দুইটি। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে যে স্টুডেন্টগুলা বের হয়েছে ওরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি না পায় তাহলে কারা চাকরি দিবে? এছাড়া মানুষের মাঝে একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে যে, টেকনিক্যাল এডুকেশনে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করবে না। তাহলে সরকার যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে এটা ভেস্তে যাবে। সুতরাং আমরা যেটা চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, দক্ষ জনবল তৈরির জন্য এখানে দক্ষ লোকজনকে নিয়োগ দিতে হবে।’

সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চের (সিইআর) তথ্যমতে, জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা তাদের মোট শিক্ষার্থীর ৭৩ শতাংশ, জাপানে তা ৬৬ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৬৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০ শতাংশ, চীনে ৫৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪৬ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে তা মাত্র ১৪ শতাংশ। সরকারিভাবে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। করোনার কারণে যা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

বর্তমানে দেশের চার শতাধিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ৩৪টি বিষয়ে পড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ছাড়া বাকি ৩১টি বিষয়ের ডিপ্লোমাধারীরা বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার গুরত্বপূর্ণ কন্সট্রাকশন ও সিভিল (উড) টেকনোলজির মতো দুই বিষয়ে সরকারি চাকরিতে কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা না থাকায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে। এবার এসব কিছু ছাপিয়ে কারিগরি শিক্ষার্থীদের প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণের অভিযোগ উঠেছে খোদ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক বিষয়ে ডিপ্লোমা শেষ করা মো. হাসান মাসুদ বলেন, ‘এমনিতে বেসরকারি পর্যায়ে চাকরিতে কর্মরত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য কোন পদ-পদবী নির্ধারিত নেই। ফলে মালিকপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনিশিয়ান, অ্যাসিস্ট্যান্ট, সুপারভাইজারসহ নানা নিম্ন পদ-পদবী ও বেতন নির্ধারণ করা হয়। যা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য চরম অবমাননাকর। তারওপর কারিগরি অধিদপ্তরের এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত কারিগরি শিক্ষার্থীদের মনে হতাশার জন্ম দিয়েছে। যে অধিদপ্তরের উচিত ছিলো, সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা; সেখানো বিধিমালা অমান্য করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উল্টো নিজেরাই শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করছে, এটা চরম অন্যায়।’

এদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর পদে সারা দেশের ন্যায় চাকরি পেতে আবেদন করেছে দেশের সীমান্তবর্তী সাত অঞ্চলের চাকরিপ্রত্যশীরাও। যেসব জেলার কোনো কোনোটিতে ২০%-৫৫% পর্যন্ত করোনার উর্ধ্বমূখী সংক্রমণের রেকর্ড গড়ায় নতুন করে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বিরাজ করছে দেশজুড়ে। তার ওপর আছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও। তন্মোধ্যে সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পূর্ণমাত্রায় কঠোর লকডাউন চলছে। বাকি রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, খুলনা, যশোরও কঠোর লকডাউনের পথে।
যেখানে জরুরি সেবার লোকজন ছাড়া বাকিদের ঘরের বাইরে না যেতে নির্দেশ দিয়েছে স্ব স্ব জেলা প্রশাসন। সেখানে এমন ভয়ঙ্কর-শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কীভাবে সীমান্তবর্তী সাত জেলার চাকরিপ্রত্যশীরা আগামী ১২ জুন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নেবেন; এ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) মো. মহসিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে থাকা এই অসামঞ্জস্যতা অনেকে লিখিতভাবে জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত সার্কুলার, বিধান আছে সেটা নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের কমিটি আছে, তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সময় লাগবে। নিয়োগবিধির সঙ্গে এটার (নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি) যে অসামঞ্জস্যতা, তা হঠাৎ করে পরিবর্তন করে ফেলা যায় না। কতগুলো পদ্ধতি আছে।’

নিয়োগবিধির ব্যতয় ঘটানো এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করা হবে কি না – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে। যেহেতু বিজ্ঞপ্তিটা সেখান থেকে দিয়েছে।’ বিষয়টি নিয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

কারিগরি শিক্ষা অধিপ্তরের মহাপরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ফোনে কোনো তথ্য চাইলে আমি কিন্তু দিতে পারবো না। আপনি যদি কোনো তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে চান, তাহলে সরাসরি অফিসে আসবেন।’ নিয়োগবিধি ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অসামঞ্জস্যতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু সরকার এটি সঠিকভাবে করেছে। তবে ফোনে এভাবে তথ্য আদান-প্রদান করা সঠিক না। আপনি এলে তথ্য জানতে পারবেন। ফোনে তথ্য দেওয়া সঠিক না, আপনি ফোন করেছেন তাই সৌজন্যবোধ থেকে ফোন ধরা হয়েছে।’ এ কথা বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন মহাপরিচালক হেলাল উদ্দিন।

এদিকে কারিগরি শিক্ষার ওপর সরকার খুব জোর দিয়েছে বলা হলেও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে গত এক দশক ধরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এই পদে একজন দক্ষ শিক্ষককে বসানো উচিত, যার রয়েছে দেশ-বিদেশের কারিগরি শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসন নিয়ে পরিষ্কার ধারণা। কিন্তু তা হচ্ছে না। গত ১১ মার্চ আবারো কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয় একজন অতিরিক্ত সচিবকে। তিনিই হলেন মো. হেলাল উদ্দিন। মার্চে তার যোগদানের পরই একসঙ্গে ২ হাজার ১৮১ জনকে নিয়োগ দেয়ার বিতর্কিত এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।