এই ‘কান্না’ ওর একার নয়, পুরো দেশের বাচ্চাদের

সুলতানা কাজী : উনিশ সালে প্রতিদিন টিফিনে আমাকে আম দিতে এ সময়! মনে আছে, মা? আমি তিন বন্ধুকে প্রায়ই আমগুলো খাইয়ে ফেলতাম আর তোমাকে বলতাম, টিফিন সব শেষ করেছি আজকে! তুমি খুশি হয়ে পরের দিন আবারো আম কেটে দিতে! জানো মা, তিনবন্ধুর একজনের নাম আমি মনেই করতে পারছি না! আমি বললাম, কেনো? বন্ধুর নামতো ভোলা উচিত না।

আমার মেয়ে মন-খারাপ করা মুখে বললো, সে নতুন ভর্তি হয়েছে বলে বেশিদিন মেশা হয়নি বলেই হয়তো! কথোপকথনের ফাঁকে খেয়াল করলাম, মেয়ের চোখে পানি! বললাম, তুমি কাঁদছো? সে বললো, প্রতিদিন কাঁদি আমি কিন্তু তুমি না দেখতে পাও মতো!

তারপর অনেকটা ভাবুক মানুষের মতো আমাকে বললো, তুমি পত্রিকায় আমার কেন কান্না পায়, কেন মন খারাপ হয়, তা নিয়ে লিখতে পারবে? বললো, এটা কিন্তু পুরো দেশের বাচ্চাদের কান্না, মা! অবাক চোখে হা করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে! পুরো দেশের সাথে নিজের চাওয়াকে মেলানোর এমন দর্শন পেলো কোত্থেকে?

ছোটবেলা থেকে ঠোঁটস্থ, মুখস্ত আমাদের, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটা। আমাদের প্রথম পাঠ হয় মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে। তারপর একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছেই সমর্পিত হই উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্যে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিবার থেকেও বেশি ভালোবাসি।

গেল বছর সতেরোই মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রয়েছে। খুবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিল সেটা, যেটা আপামর জনসাধারণের চাওয়াই ছিল। সরাসরি শ্রেণি পাঠদানের বিকল্প অনলাইন পাঠদানের শুরুও হলো মার্চের পর থেকে। বছর শেষে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক মূল্যায়নে নতুন শ্রেণিতে ভর্তিও হলো সবাই।

জাতিসংঘের মতে, মৌসুমী রোগ হিসেবে এ করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে থেকে যেতে পারে। তারই প্রেক্ষিতে, অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সমস্ত খাত খুলে দেওয়া হলো। খুবই আশাব্যঞ্জক এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। একমাস, তিনমাস, ছয়মাস বা এক বছরের ব্যাপার নয় যে বসে বসে অপেক্ষা করা যায়!

আমার ব্যক্তিগত ভাবনা থেকেই বলছি আচ্ছা, করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে আসার আগে কি বলে আসছিল যে, শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তার সংক্রমণ বেশি হবে? সেটা যদি না হয়, তাহলে বারবার শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ ঘোষণা হচ্ছে? শিক্ষার্থীরা কি সমাজের বাইরে বসবাসরত কোনো গোষ্ঠী?

এই দীর্ঘ বন্ধে অভিভাবক হিসেবে বন্দি বাচ্চাদের কিছু কার্যক্রম তুলে ধরি এবার। জানি না, অনেকের সাথে মিলে কিনা! তিন মেয়ে আমার। বড়জন সিক্সে, মেজোটা থ্রিতে, ছোটপাখিটা মাত্র প্লে পড়ুয়া। প্রায়ই তারা ইউনিফর্ম পরে দেখে, কতটা ছোট হয়েছে! স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়া অভিনয় করে! যতœ করে তুলে রাখা টিফিনবক্স মাঝে মাঝে খুলে দেখে ঠিক আছে কিনা। বাসার দেয়ালকে বোর্ড বানিয়ে টিচার টিচার খেলে! নিজে নিজে কথা বলে, জিজ্ঞেস করলে বলে…বন্ধুর সাথে কথা বলে! পরীক্ষায় পাশে বসা অন্যদের যা দেখতো তা নকল করে! ঘরকে স্কুল বানায় পিলো দিয়ে! আরও কত কিছু!

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু সিলেবাস শেষের জন্য নয় কিন্তু! শিক্ষার্থীরা সামাজিকতা শেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই। পারস্পরিক মেলামেশা থেকে তারা মেন্টালি সোশ্যাল হয়। এই দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বে তারা যে মেন্টাল ট্রমার মধ্যে আছে, তার ক্ষতিপূরণ করবে কে?

স্বাস্থ্যবিধিকে সরকারি ঘোষণা না ভেবে ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা যতদিন মানুষের মাথায় ঢুকবে না, ততদিন এরকম মহামারি ভয়াবহ অভিশাপে পরিণত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। চাইলে আসলে, আমরা এ জাতি সবই পারি! যেমনটা পেরেছিলাম বায়ান্নে, একাত্তরে! মগজে সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি স্থায়ী আসন গাঁড়লেই মুক্ত হবো করোনার হাত থেকে। সুস্থ থাকি, সুস্থ রাখি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অচিরেই আলো-বাতাসের মুখ দেখুক! প্রাণ পাক আমাদের কচিসোনারা। আবারো গমগম আবহে মুখরিত হোক প্রিয় প্রাঙ্গণগুলো। হাসুক পৃথিবী সুস্থতায়।

সুলতানা কাজী সহকারী শিক্ষক (বাংলা), অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।