মুখে স্লোগান, বুকে অমিত সাহস। রাজধানীর অলি-গলি পাড়া-মহল্লায় ছাত্রজনতার ভিড়। মিছিলে প্রকম্পিত রাজপথ। উর্দু মানি না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক কৃষক-আমলা বৃদ্ধ-তরুণ সবার বজ্রমুঠি আকাশের দিকে উঁচিয়ে। তথাকথিত নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদ সেখানে নেই। হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমান তালে মিছিল-স্লোগানে আকাশ ভারী করছেন বাঙালি নারী।
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের প্রথম গেইটের পাশ দিয়ে যেতেই চোখে পড়ল এমন দৃশ্যের দেয়ালচিত্র, যেখানে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান পর্যন্ত নারীর বীরত্বগাথা বর্ণনা করা হয়েছে ৯টি ম্যুরালে। ৯ সংখ্যাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ এখানে। কারণ নয় মাস যুদ্ধ করেই বাঙালি পেয়েছিল তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বাদ।
উদ্বোধনী ফলকে লেখা আছে ‘মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর গৌরবময় ভূমিকা এবং নারীর ক্ষমতায়নের ওপর নির্মিত ম্যুরাল’। গত ১৮ অক্টোবর বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন ম্যুরালগুলো। কলেজের ১ ও ২ নং ফটকের মধ্যবর্তী স্থানে ম্যুরালগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এ কর্মযজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর হোসনে আরা।
৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণার সাথে সাথেই ময়দানে উপস্থিত জনগণ সমবেতভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহ পুনরায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে একই রকম ভাষণ দেন। সাথে সাথেই সমবেত ছাত্ররা ‘না না’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। তারপর থেকেই সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের। পরে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি মুহূর্তে পাল্টে যায়। ছাত্রদের আন্দোলন হয়ে ওঠে সবার। ওই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের ইতিহাস প্রবেশ করে এক নতুন যুগে। আমরা পাই মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার।
দেয়ালচিত্রের দিকে তাকাতেই ভাষা আন্দোলনের ওই ঘটনাগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। যেখানে নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। এর পাশেই আরেকটি ম্যুরাল। সেখানে শহিদমিনার, স্মৃতিসৌধ গৌরবে মুখ তুলে আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার মাথায় লাল-সবুজ কাপড় বাঁধা। তিনি রক্তাক্ত এক স্বজনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। এর পাশেই জনতার হাতে প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’। কোথাও বর্ণমালা অ আ ক খ লেখা। কোথাও পুলিশের গুলিতে ভাষাসৈনিকের মৃত্যুদৃশ্য।
তৃতীয় ম্যুরালেও বর্ণনা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধদৃশ্য। যেখানে দেখা যাচ্ছে একদিকে পাকবাহিনীর রোষে বাঙালির ঘরবাড়ি পুড়ছে, অন্যদিকে এক নারী মুক্তিযোদ্ধা বন্দুক উঁচিয়ে আছেন, তার পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়ছে পাকসেনা। আরেক পাকসেনা আত্মসমর্পণ করছে। চতুর্থ ম্যুরালটিতে বর্ণনা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ইডেন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গৌরবময় অধ্যায়। এক শিক্ষার্থী আহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। শিক্ষিকারা ভাত রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াচ্ছেন।
শুধু যুদ্ধে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কথাই বর্ণিত হয়নি ম্যুরালগুলোতে, স্বাধীন দেশের উন্নয়নে সবক্ষেত্রে নারীর অবদানের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। আদালতের বিচারকার্যে নারী, ব্যাংক-বিমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিজ্ঞান গবেষণাগারেও নারী রেখেছেন তার গৌরবময় পদচ্ছাপ। এসব দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে সেখানে।
একসময় ইডেন মহিলা কলেজের এই গেইট সংলগ্ন ফুটপাতে বসত হকারদের হাট। এখন সেখানে এই ম্যুরাল অনন্য সৌন্দর্য দিয়েছে। সন্ধ্যার পরও এখানে তরুণ-তরুণীদের ভিড় জমছে। আলোর ঔজ্জ্বল্যে তারা পড়ছেন নারীর যুদ্ধজয়ের গল্প। মুর্যালগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে অনেকে সেলফিও তুলছেন।
