অন্তরা নন্দী : মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের যতটা ঘটা করে সচরাচর বিয়ে হয় ঠিক তেমনটা করেই বিয়ে হলো নীলার। অতিরিক্ত জৌলুস যেমন ছিল না তেমন একেবারে সাদামাটা আয়োজনও ছিল না। তার স্কুলশিক্ষক বাবার পক্ষে যতটা সম্ভব ঠিক ততোটাই তিনি করেছেন। তাও একেবারে কোনও চাপ যে তার বাবার ওপর যায়নি তেমনটাও না। তাই বলি বলি করেও শখের লাল জামদানি শাড়িটার কথা বাবাকে বলতে পারেনি নীলা। তাছাড়া বিয়ের শাড়িটাতো এমনিতেই লাল বেনারসি। আর উপহারেও কয়েকটা লাল শাড়ি পেয়েছে। তাই তেমন আফসোসও হয়নি। কয়েক বছর পর পড়ালেখা শেষে সে নিজে যখন চাকরি করবে তখন না হয় কিনবে। আর তার বরও তো তাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারে। তার বাবা তো তাকে বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে না!
বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে নীলার। অর্ক নামের তিন বছরের এক পুত্র সন্তানের মা এখন সে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ নিয়ে ভরা সংসার। সবাইকে আপন করে নিয়েছে নীলা। নীলার পড়ালেখাও শেষ। ছেলে ছোট বলে এখনো চাকরির চেষ্টা করছে না। স্বামী সুমনের চাকরিতে হয়েছে পদোন্নতি। কিন্তু খরচও অনেক বেড়ে গেছে। বৃদ্ধ বাবা মায়ের চিকিৎসা, ভাই-বোনদের পড়াশোনা, একটা ছোট বাচ্চার সমস্ত খরচ সব মিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষটা। তাই এখনো পর্যন্ত সুমনকে লাল জামদানি শাড়িটার কথা বলেনি নীলা। থাক অর্ক একটু বড় হোক তখন তো নীলা নিজেই চাকরি করবে, তখন কিনবে। সময় তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না!
দেখতে দেখতে বিয়ের পনের বছর পেরিয়ে গেল নীলার। সে এখন দুই সন্তানের মা। পিউ নামের কন্যা সন্তান এসেছে তার ঘরে সাত বছর আগে। সংসার সামলাতে গিয়ে আর চাকরি করা হয়ে ওঠেনি নীলার। ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনায় বেশ ভালো। শহরের নামিদামি স্কুলে পড়াশোনা করছে। নাচ, গান, ক্রিকেট, কারাতে যে যা পারছে শিখছে। শ্বশুর মারা গেছেন দুই বছর আগে। অসুস্থ শাশুড়ি। এদেরকে নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে নীলার। দেবর, ননদদের যার যার আলাদা সংসার হয়েছে। ভালো আছে সবাই। এর মধ্যে সুমন যতটা পেরেছে তার শখআহ্লাদ পূরণ করেছে। শুধু লাল জামদানিটাই এখনো কেনা হয়নি। আসলে মুখ ফুটে সুমনকে কখনো বলাই হয়নি। এতো দায়িত্ব ওর ওপর। জামাই হিসেবে নিজের শ্বশুর, শাশুড়ির প্রতিও সমস্ত দায়িত্ব পালন করছে সুমন। এর মধ্যে কী করে অত দামি একটা শাড়ির কথা বলে সে? একটা ভালো জামদানি শাড়ির যা দাম! একটু গুছিয়ে নিক মানুষটা সব। এক সময় বললেই হবে।
এসব সুখস্মৃতি নিয়েই এখন বেঁচে আছে নীলা। মনে পরে নিজের জন্যে একটা লাল জামদানি শাড়ি কেনার জন্য ও কতবার যে টাকা জমিয়েছে, সেই টাকা খরচও করেছে সংসারের প্রয়োজনে, সন্তানদের আবদার মেটাতে। তাতে কোনও আফসোস নেই নীলা চৌধুরীর। আর স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে ইচ্ছেটাতো চিরতরে মরেই গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের এমন অনেক ইচ্ছেতো এভাবেই অপূর্ণ থেকে যায়।
কয়েকদিন পর নীলার পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী। ছেলে-মেয়েরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাদের পড়ালেখা প্রায় শেষের পথে। সুমন খুব হিসেবি মানুষ। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে, তাদের দুইজনের বৃদ্ধ বয়সের জন্য যথেষ্ট টাকা জমিয়ে রেখেছে। এখন চাইলেই সুমন একটা শাড়ি কিনে দিতে পারে। কিন্তু নীলাকে একটা ভালো শাড়ি পরতে দেখলে যে দুজন মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হতো নীলার মা আর শাশুড়ি, তারা কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাই একটু হলেও ইচ্ছেটা ম্লান হয়ে গেছে। তাছাড়া নিজেরও একরকম বয়স হয়েছে। এখন লাল শাড়ি পরলে লোকে কী বলবে? কিন্তু তার অনেক দিনের শখ থাকবে কেন? এবার সে একটা লাল জামদানি শাড়ি কিনবেই। এসব ভাবতে ভাবতে সুমনের অফিস থেকে ফোন এলো। হঠাৎ স্ট্রোক করায় অফিস থেকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুমনকে। সেদিন রাতেই মারা যায় সুমন।
নীলা চৌধুরী এখন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধা। ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। তারা মাকে খুব যত্নে রেখেছে। নাতি-নাতনিদের নিয়ে তার জীবন এখন মোটামুটি সুখের বলা যায়। ছেলের প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটে খুব বড় একটা ঘর দেওয়া হয়েছে তাকে। আলমারি ভর্তি নতুন সব দামি দামি শাড়ি। বেশির ভাগই পরা হয়নি। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না এখন আর। অবসরে নিজের দীর্ঘ জীবনটার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তিনি। কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি সবার সাথে। স্বামীর কথা মনে পড়লেই বুকটা হু হু করে ওঠে।
সারাজীবন সবার জন্য শুধু করেই গেল। কিন্তু সুখটা উপভোগ করার সময় সে পেল না। তার সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে। স্ত্রী মনে কষ্ট পায় এমন কোন আচরণ কখনো সে করেনি। কত কিছুই না দিয়েছে সুমন তাকে। তার সামর্থ্য মতো মোটামুটি দামের কত শাড়ি, ছোটখাটো গয়না, দেশের মধ্যে কয়েকবার ঘুরতেও নিয়ে গেল। শুধু লাল জামদানি শাড়িটাই হলো না। বলাই হয়ে ওঠেনি কখনো। কী করে বলবে! সুমন নিজেই তো খুব বেশি দামি জামা কাপড় কিনতো না। একবার নিজের হাত খরচ থেকে টাকা জমিয়ে একটা স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন নীলা। মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল সুমন।
এসব সুখস্মৃতি নিয়েই এখন বেঁচে আছে নীলা। মনে পরে নিজের জন্যে একটা লাল জামদানি শাড়ি কেনার জন্য ও কতবার যে টাকা জমিয়েছে, সেই টাকা খরচও করেছে সংসারের প্রয়োজনে, সন্তানদের আবদার মেটাতে। তাতে কোনও আফসোস নেই নীলা চৌধুরীর। আর স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে ইচ্ছেটাতো চিরতরে মরেই গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের এমন অনেক ইচ্ছেতো এভাবেই অপূর্ণ থেকে যায়।