শান্তনু চৌধুরী : সংবাদমাধ্যমে যারা কাজ করেন বিশেষ করে দৈনিক, অনলাইন বা টেলিভিশনে তাদের সকালবেলাটা শুরু হয় নানা চিন্তার মাধ্যমে। আজকে ভালো কোনো সংবাদ মিলবে তো। যেদিন কিছুই মিলে না সেদিন বলা হয়, ‘ডাল ডে’। কিন্তু বাংলাদেশে এমন দিন খুব কমই ঘটে। কারণ প্রতিদিন কোনো না কোনো খবর ঠিকই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাট এসব সমস্যার কিছুটা প্রকাশিত বা কিছুটা অপ্রকাশিত থাকলেও নায়িকাদের নানা কেচ্ছা কাহিনীতো রয়েছেই। আর এখন ধরতে গেলে সংবাদিকতা তো আর সেই জায়গায় নেই। এখন সাংবাদিকতা আর লাইক, ভিউ সাংবাদিকতার তেমন একটা পার্থক্যও চোখে পড়ে না।
এছাড়া নানা কালাকানুন দিয়ে তো রাষ্ট্রও সাংবাদিকতার হাত পা বেঁধে দিয়েছে। সে কারণে বাধ্য হয়েই লেবু বা আলু বেগুনের বাম্পার ফলনই মূলত এখনকার দৃশ্যমাধ্যমের প্রধান খবর। তাই সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে পরীমনির জামিন না হলেও সাংবাদিকদের বরং বেশিই লাভ। প্রতিদিন কোনো না কোনো ‘আইটেম’ থাকবেই। তার ফ্যান-ফলোয়ার বেশি, লোকজন এসব নিউজ ‘খায়’ বেশি।
কলকাতার সংসদ সদস্য ও নায়িকা নুসরাতের মা হওয়ার নিউজ যেভাবে সেদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো লাইভ করলো তাতে বলতেই হয় আমাদের সঙ্গে সাংবাদিকতার মানে তাদের তেমন কোনো পার্থক্যই নেই। দেখলাম অনেক সাংবাদিকের হাসপাতালে ভিড়। অপেক্ষা কবে সন্তান জন্ম নেবে, কে আর আগে ব্রেকিং দেবেন! এবার সন্তান জন্ম হওয়ার পর শুরু হলো ছেলের নাম যে ঈশান রাখলো তা নাকি নায়ক যশের সঙ্গে মিলিয়ে। এরপরও গানের ছন্দে বলা হয়, ‘প্রতিদিন কতো খবর আসে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’।
প্রতিটি মানুষের জীবনটাইতো একটা উপন্যাস। সেখানে উত্থান পতন আছে। হারজিত আছে। সম্প্রতি মোটিভেশনাল স্পিকার সোলায়মান সুখনের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি বলছেন, দুঃসময়ে কে পাশে থাকছেন, কে থাকছেন না সেটির হিসেব রাখবেন পই পই করে। প্রয়োজনে ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। আবার যারা সহযোগিতা করেননি তাদের হিসেবও রাখবেন। আপাতদৃষ্টিতে এই কথাটি খুব একটা খারাপ না। দুঃসময়ের বন্ধুইতো প্রকৃত বন্ধু। ‘সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়’। কিন্তু আবার সব জায়গায় বলা হচ্ছে, ক্ষমাই মহত্বের গুণ।
এতো প্রতিহিংসা জিইয়ে রেখে, কে কাছে এলো কে এলো না এসব না ভেবে কী লাভ বরং নিজের মতো করে নিজেই এগিয়ে যাওয়াই উচিত। আসলে সবকিছুর মূলে মানুষ। মানুষই নিজের সত্যাসত্য নির্ণয়ের মাপকাঠি। তাই মানুষকেই আপন করার কথা বলা হয়েছে। ‘মানুষ আপন টাকা পর-যতো পারিস মানুষ ধর’। কিন্তু চাইলেই কি মানুষের কাছে যাওয়া যায়? চাইলেই কি আপন হওয়া যায়? প্রাণে প্রাণে মন না লাগলে, মনের সাথে মন মিলে এক মন না হলেও পাগলতো হয় না মন।
তেমনি দেশের ক্ষেত্রে যদি বলি, ‘এক প্রাণতার মমত্বেতে পরস্পরের সমাবেশ-নিগূঢ় অটুট হলেই জানিস, একটি দানায় বাঁধবে দেশ’। এই যে সমাবেশ সেটি হয়নি বলেই ২০ বছর ধরে আফগানের থেকেও তাদের মনকে জয় বা ভেতরে চেঞ্জ করতে পারেনি মার্কিন সৈন্যরা। সে কারণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রশিক্ষিত হওয়া আফগান সৈন্যরা তালেবানদের কাছে মিমিষেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। বড় ধরনের প্রতিরোধতো দূরের কথা, জোর গলায় বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেনি। অথচ কোনো কোনো তালেবান সৈন্যকে দেখলেই মনেই হবে না ওরা যুদ্ধ জানে। পায়ে স্যান্ডেল পর্যন্ত নেই। ভরসা হাতে থাকা অত্যাধুনিক মেশিনগান। এরপর ফুটছে বোমা।
ভারতবর্ষ থেকে লেজ গুটিয়ে পালানোর সময় ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমান, দেশ সীমানা এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছিল যাতে এক ধরনের গ-গোল সবসময় লেগে থাকে। যেটি এখনো আছে এবং বোধবুদ্ধি ছাড়া আদৌ থামবে বলে মনে হয় না। এই যে মার্কিন ও ন্যাটোর সৈন্যরা আফগান ছাড়ছে এ আগে আইএস হঠাৎ সক্রিয় সেটিকেও তেমন একটি চক্রান্ত বলে দেখছেন বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একটা অশান্তি সৃষ্টি করে রাখলে পশ্চিমা বিশ্বের লাভ।
অস্ত্রের ব্যবসা হবে! তবে সার্বিকভাবে তালেবানরা কখনো একটি ভালো দেশ বা উন্নত জাতি গঠন করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সভ্যতা ধ্বংসের নজির ইতোমধ্যে ওরা দেখিয়েছে। মাত্র অল্পকদিনেই ওদের স্বরূপ প্রকাশ হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ গেল বিশ বছরে আফগানরা সংস্কৃতির দিক থেকে বেশ এগিয়েছিল। যে যেভাবে পারছে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। মাঝে মাঝে ইতিহাস যখন পড়ি মনে হয় আফগান থেকে শুরু করে পাকিস্তান কতো কতো ইতিহাসসমৃদ্ধ। একবার গিয়ে দেখে আসতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু এই দেশ দুটির সন্ত্রাসী কর্মকা- এমন জঘন্য মনে হয় না এই জীবনে আর যাওয়া হবে। আবার এসব দেশে গেলে অন্য দেশ ভিসা দিতে চায় না।
তালেবান আফগান দখলের পর প্রথম ধাক্কায় মার্কিন বিমানে করে আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যায় দেশটির ৬৪০ নাগরিক। সেই বিমানে ছিলেন আফগান পপ গায়িকা আরিয়ানা সাইদ। দেশটির সাংস্কৃতিক প্রথা ভেঙে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক। মার্কিন মডেলদের মতো সাহসী পোশাকে দেখা গেছে আরিয়ানাকে। নিজের দেশ আফগানিস্তানে খোলামেলা পোশাকেই ঘুরে বেড়াতেন তিনি। প্রকাশ্য মঞ্চ বা অনুষ্ঠানে গাইতেন গান। গত ২০ বছর দেশটির নারীরা যে স্বাধীনতাপ্রত্যাশী ছিলেন, সেই পথ দেখানো নারীদের অন্যতম আরিয়ানা সাইদ।
ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আফগান তরুণ নারী চিত্রপরিচালক রোয়া হায়দারি। দেশ ছেড়েই সামাজিক মাধ্যমে আবেগঘন পোস্ট করেন তিনি। নিজের একটি ছবি টুইট করে রোয়া হায়দারি লেখেন, ‘আমি আমার গোটা জীবনটা ছেড়ে চলে এলাম। আরও একবার আমার মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হলাম। আরও একবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে আমাকে। আমি কেবল আমার ক্যামেরা এবং একটি মৃত আত্মা নিয়ে সমুদ্র পাড় করেছি। ভারী হৃদয় নিয়ে, বিদায় মাতৃভূমি। ফের দেখা না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে প্রতিদিন মিস করবো’।
ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আফগান তরুণ নারী চিত্রপরিচালক রোয়া হায়দারি। দেশ ছেড়েই সামাজিক মাধ্যমে আবেগঘন পোস্ট করেন তিনি। নিজের একটি ছবি টুইট করে রোয়া হায়দারি লেখেন, ‘আমি আমার গোটা জীবনটা ছেড়ে চলে এলাম। আরও একবার আমার মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হলাম। আরও একবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে আমাকে। আমি কেবল আমার ক্যামেরা এবং একটি মৃত আত্মা নিয়ে সমুদ্র পাড় করেছি। ভারী হৃদয় নিয়ে, বিদায় মাতৃভূমি। ফের দেখা না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে প্রতিদিন মিস করবো’।
সায়েদ সাদাত। আফগানিস্তানের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভাগ্যের সন্ধানে জার্মানি পাড়ি দেন তিনি। এখন ডেলিভারি ম্যান। জার্মানির পূর্বাঞ্চলীয় শহর লিপজিগে বাইসাইকেলে করে খাবার ডেলিভারির কাজ করেন তিনি। সম্প্রতি কমলা রংয়ের ইউনিফর্ম পরা সাদাত তাঁর বাইকের পাশে বসে রয়টার্সকে বলেন, এর জন্য আমার মোটেই কোনো অপরাধবোধ নেই। আমি আশা করি, অন্য রাজনীতিকেরাও আমার পথ অনুসরণ করবেন। লুকিয়ে থাকার চেয়ে জনগণের সঙ্গে কাজ করাই উত্তম।
আসলেই পালিয়ে বাঁচা সবসময় সমাধান নয়। কিন্তু সময় হয়তো অনেককে বাধ্য করে। তবে প্রিয় স্বদেশকে কি কেউ কখনো ভুলতে পারে? যেমনটি দেশ ভাগ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া অনেকেই ভুলতে পারেননি প্রিয় মাতৃভূমিকে।
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক