নিয়োগবিধি লংঘন করে প্রভাষকের চাকরি, ২৮ বছর পর ধরা

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের বিধান অনুযায়ী কলেজ প্রভাষক পদে যোগ দিতে হলে আবেদনকারীর স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে নিয়োগ পেতে বিধিলঙ্ঘন ও তথ্য গোপন করে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে বিজয় স্মরণী কলেজের সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণ বিভাগের এক তদন্তের পর দীর্ঘ ২৮ বছর পর উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।

জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারিতে ১৯৯৩ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বিজয় স্মরণী কলেজ। সেই বছরই ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান বর্তমান সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন। কলেজ প্রভাষক পদে যোগ দিতে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন হলেও তার (কামাল উদ্দিন) সে সময় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না। এক্ষেত্রে শুধু স্নাতক (সম্মান) পাশের সনদ দিয়েই নিয়ম বহির্ভূতভাবে কলেজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

একুশে পত্রিকার হাতে আসা কামাল উদ্দিনের শিক্ষাসনদ ও সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইংরেজি বিভাগে ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে অনুষ্ঠিত স্নাতকোত্তর (এমএ) পরীক্ষায় তিনি অংশ নেন। একই বছরের জুলাই মাসে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং সার্টিফিকেট ইস্যু হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ ইংরেজি। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর কলেজের ৭ম সভায় তাকে প্রভাষক পদে যোগদানের সুপারিশ করা হয়। স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রায় দশ মাস আগে ২ অক্টোবর তিনি প্রভাষক পদে যোগ দেন।

এর আগে আলমগীর মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি কামাল উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রভাষক পদে যোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বিজয় স্মরণী ডিগ্রি কলেজ নিয়োগপ্রক্রিয়ায় জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তে শিক্ষাপরিদর্শক এএইচএম জাহাঙ্গীর আলম ও সহকারী শিক্ষাপরিদর্শক রূপক রায়কে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।

পরবর্তীতে কামাল উদ্দীন আহামদের (ইনডেক্স নম্বর- ৪১১১২৭) নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তে ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর বিজয় স্মরণী ডিগ্রি কলেজ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এসময় অভিযোগকারীর প্রদত্ত তথ্য এবং তৎকালীন প্রতিষ্ঠান প্রধান অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের বক্তব্যে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, অভিযোগকারীর প্রদত্ত তথ্য (নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশ এবং প্রভাষক হিসেবে যোগদান, জনবল কাঠামো অনুযায়ী নিয়োগ নীতি, স্নাতক (সম্মান) পাশের সনদ দিয়েই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও এমএ (ফাইনাল) পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়) এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও সহকারী অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের দেওয়া তথ্যে মিল পাওয়ায় বিধিলঙ্ঘন ও তথ্য গোপনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়।

পরবর্তীতে ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রের মাধ্যমে নিরীক্ষা ও আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তদন্ত প্রতিবেদনটি বিজয় স্মরণী ডিগ্রী কলেজ অধ্যক্ষ বরাবর পাঠিয়ে প্রতিবেদন প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষ (কলেজের সভাপতি, গভর্নিং বডি) এর মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ব্রডশিট জবাব প্রেরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু এমন অনিয়ম ও বিধিলঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রায় ১ বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদনের জবাব দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। এতে সন্দেহের আঙুল উঠেছে কলেজ কর্তৃপক্ষের দিকে। অভিযোগ, কলেজ অধ্যক্ষ বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনটির জবাব ১৫ দিনের মধ্যে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলেও তা গভর্নিং বডির সভাপতিকে জানানোই হয়নি।

এছাড়াও এডহক কমিটিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে কামাল উদ্দিনের নিয়োগ নিয়েও আছে অভিযোগ। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফর ছিদ্দিক ও এডহক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আজমের কাছের লোক হওয়ায় বিধিলঙ্ঘন করে নির্বাচন ছাড়াই কামাল উদ্দিনকে কলেজ পরিচালনা পরিষদের এডহক কমিটির শিক্ষক-প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

শুধু তাই নয়, মোহাম্মদ আজমের স্ত্রী সৈয়দা রওশন জামাল একই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থাকায় আজমের এডহক কমিটিতে থাকা নিয়েও আছে প্রশ্ন। এডহক কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে মোহাম্মদ আজম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফর ছিদ্দিকের মাধ্যমে নির্বাচন ছাড়াই কামাল উদ্দিনকে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়াসহ কলেজের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও অভিযোগ আছে।

এদিকে, নির্বাচন ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে কামাল উদ্দিনকে গভর্নিং এডহক কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অভিযোগ পাওয়ায় কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি প্রফেসর ড. ফশিউল আলম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফর ছিদ্দিককে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য একটি লিখিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানাতে বলেন। কিন্তু দিনের পর দিন পার হয়ে গেলেও গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে কোনো প্রতিবেদনই দেওয়া হয়নি।

জানা যায়, সম্প্রতি গভর্নিং বডির সভাপতি পুনরায় নির্বাচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। যার প্রেক্ষিতে ঘোষণা করা হয় নির্বাচনের তফসিল। এরপরই বাধে নতুন বিপত্তি। ভোটার তালিকা থেকে অবৈধভাবে বাদ দেওয়া হয় ৮ জন শিক্ষককে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুনরায় অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে কামাল উদ্দিনকে জয়ী করতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিলঙ্ঘন করেই এমন কাজ করেছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফর ছিদ্দিক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি প্রফেসর ড. ফশিউল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, বিধিলঙ্ঘন ও তথ্য গোপন করে কামাল উদ্দিনের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। এই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন কিংবা এর জবাব দেওয়ার নির্দেশনার বিষয়েও কলেজ অধ্যক্ষ আমাকে কিছু জানাননি। আপনার কাছে যেহেতু জানতে পেরেছি আমি অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এডহক কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কলেজ অধ্যক্ষের কাছে লিখিত প্রতিবেদন আকারে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু আমার কাছে এখন পর্যন্ত প্রতিবেদনটি দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন-যোগ করেন তিনি।

জানতে চাইলে অভিযুক্ত কামাল উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে জাল সনদ প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে শুধু স্নাতক (সম্মান) পাশের সনদ দিয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ এবং যোগদানের দশ মাস পর স্নাতকোত্তর সনদ সংযুক্ত করার বিষয়টি সত্য। ওই সময় আমি মাস্টার্সের অ্যাপেয়ার্ড সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলাম। কলেজ কর্তৃপক্ষও বিষয়টি মেনেই আমাকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল।’

তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণ বিভাগের তদন্ত কমিটিকেও আমি এই কথাগুলো বলেছি। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। চলতি বছরের ২০ আগস্ট আমরা তদন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি। কেন এটি পেতে আমাদের দেরি হলো তা আমি জানি না। কলেজ-অধ্যক্ষ এর জবাব দিবেন। তবে প্রতিবেদনটি আপনারা দেখলেই বুঝতে পারবেন আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে একটি মহল ভিত্তিহীনভাবে অভিযোগটি করেছে- বলেন কামাল উদ্দিন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনের মাধ্যমেই গভর্নিং এডহক কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি। সমস্ত বিধিবিধান মেনে শিক্ষকদের উপস্থিতিতে, জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অধ্যক্ষ নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এখানে ইন্টার্নাল কিছু সমস্যা আছে। আসলে আওয়ামী সংগঠন ‘বাকশিস’ সমর্থন করি। এর বিরোধীরাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফর ছিদ্দিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘শুরুতে কলেজটির একাডেমিক স্বীকৃতি কিংবা পাঠদানের অনুমতি কিছুই ছিল না। সে সময় কলেজের স্বার্থেই অ্যাপেয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে অস্থায়ীভাবে ১ বছরের জন্য কামাল উদ্দিনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তার নিয়োগপত্রেও বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। যোগদানের দশ মাস পর তিনি স্নাতকোত্তর সনদ সংযুক্ত করেন। জাল সনদ প্রদান কিংবা জালিয়াতির অভিযোগ যে অস্পষ্ট তা তো প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়ে যে অভিযোগটি উঠেছে সেটিও অসত্য। জেলা প্রশাসক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কামাল উদ্দিনসহ তিনজনের নাম পাঠিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কামাল উদ্দিনের নাম মনোনীত করা হয়। এরপর শিক্ষকেরা ভোটের মাধ্যমে তাকে নির্বাচিত করেছে। আর জেলা প্রশাসক স্বাক্ষর করার আগে বেশ কয়েকবার এগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।’

এক বছরে কেন প্রতিবেদনের জবাব দেওয়া হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি স্বাক্ষর করা হলেও সপ্তাখানেক আগে আমরা তদন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি। যেহেতু আমাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে আমরা এর জবাব দিবো।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিন বলেন, ‘মোহাম্মদ আজম কলেজের শুরু থেকে প্রায় সময়ই এডহক কমিটির সদস্য ছিলেন। এটা নতুন কিছু নয়। স্ত্রী শিক্ষক হলে স্বামী এডহক কমিটির সদস্য হতে পারবেন না এমন কোনো আইন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে নেই।’

কলেজের এডহক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আজমের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।