চট্টগ্রামে ডিজে পার্টির নামে কী চলছে?

মোহাম্মদ রফিক : ‘সোনিয়া’ এমন একটি পেশায় যুক্ত হয়েছে, যেখানে রূপযৌবন হল পুঁজি, তিনি চট্টগ্রাম নগরের নামকরা একটি অভিজাত হোটেলের বারমেড। বয়স চল্লিশের কোটা পেরিয়ে গেছে। তবুও যৌবনকে ধরে রেখেছেন অজানা আকর্ষণে। ডিজে পার্টিতে নাচগান এবং যৌনপিপাসু পুরুষদের ‘শখ’ মেটানোয় তার কাজ। গরিব পরিবারের সন্তান সোনিয়াকে রঙ্গশালার বারমেড বানিয়েছে চট্টগ্রাম শহরের ‘সু’ আদ্যাক্ষরের কথিত এক নারী উদ্যোক্তা।

শুধু সোনিয়া নয়, এরকম অসংখ্য মেয়েদের কৌশলে মডেল, অভিনেত্রী বা গায়িকা বানানোর ফাঁদে ফেলে ‘শরীরবাণিজ্য’ করতে বাধ্য করছে একটি চক্র। এভাবে ডিজে পার্টির আড়ালে চলছে ‘মেয়েবাজি’। এর আগে গত ২৯ আগস্ট ‘নামীদামী হোটেলে ‘যৌনতা’ বিকিকিনিতে ৬ নারী’ এবং গত ৫ সেপ্টেম্বর ‘চট্টগ্রামের গোপন রঙ্গ, কী হচ্ছে সেখানে’ শিরোনামে একুশে পত্রিকার অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় ‘মেয়েবাজি’র জগতে। কেউ কেউ এ জগত থেকে নিজেকে ‘আপাতত’ গুটিয়ে রাখলেও থেমে নেই কথিত রঙ্গশালা চক্রের অপতৎপরতা।

চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত হোটেল এবং বাসাবাড়িতে রাতের আঁধারে মাদক আর নারী নিয়ে মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডিজে পার্টি। অর্থ-বিত্ত-প্রভাবশালী-প্রতাপশালী ক্ষমতাধররাই আয়োজক, উদ্যোক্তা। গানের তালে তালে অশ্লীল নৃত্যে, মাদক-ইয়াবার নীল নেশায় যেন অবাধ ‘যৌনতার’ বাজার। রূপের হাটে রঙের দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিনোদনের জন্য সেখানে কাগজের মতো টাকা উড়ে।

জানা গেছে, ঢাকায় চিত্র নায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় ডিজে পার্টির নামটি নতুন করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। নগরের নামীদামী আবাসিক হোটেল ও বিলাসবহুল ভবনের ফ্ল্যাটে বসে ডিজে পার্টির নামে চলছে অসামাজিক কার্যকলাপের রমরমা ব্যবসা। খুব অল্প খরচে এ ধরনের পার্টিতে পৌঁছে যাচ্ছে চট্টগ্রামের তরুণ-তরুণীরা। এক সময় উঠতি বয়সের ছেলেরাই ডিজে পার্টির বড় খদ্দের হলেও এখন সময়ের সঙ্গে পাল্টা দিয়ে এসব ডিজে পার্টিতে বাড়ছে অভিজাত পরিবারের তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা। গানের তালে তালে অশ্লীল নৃত্য, ইয়াবার ছড়াছড়ি, সঙ্গে অবাধ যৌনতা কী নেই সেখানে?

অনুসন্ধান বলছে, নগরের আগ্রাবাদ এলাকার একটি অভিজাত হোটেলে চলে ডিজে পার্টি। এসবের মধ্যমণি ‘র’ আদ্যাক্ষরের এক নারী। তার ডিজে চলে প্রতি মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার। আর তার ডিজে পার্টির নাম ‘স্প্রিরিট’। এতে ডিজে করেন রফিক ও সোহেল নামে দুই যুবক। এদিকে একই হোটেলে ডিজে পার্টিও আয়োজন করেন এসকে আদ্যাক্ষরের এক নারী। তার পার্টিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন ‘জা’ আদ্যাক্ষরের এক কাউন্সিলর।

স্থানীয় একটি কলোনিতে তার মালিকানাধীন পাঁচতলা ভবনের পঞ্চমতলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছেন ‘এসকে’ নামের ওই নারীকে। ওই নারীর সহযোগিরা হলেন-মৌ এবং রাজিয়া। তারা থাকেন নগরের এক খান গেইট এলাকায়। ডিজে পার্টিতে গান করে তারা টিপস আদায় করেন। এ দুজনের কাজ হলো-ডিজে পার্টিতে অংশ নেওয়া খদ্দেরের সাথে নারীদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। একজন খদ্দের থেকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ‘দালালি’ নেন মৌ ও রাজিয়া।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাদক সেবন ও বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে আগ্রাবাদ হোটেল থেকে ৯৬ জন নারী-পুরুষকে আটক করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে আটককৃতদের মধ্যে ১৪ জন নারী এবং ৬২ জন পুরুষ। এরমধ্যে ‘র’ আদ্যাক্ষরের নারীও ছিলেন। ওই হোটেল থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছিল তখন। গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার হাসান চৌধুরী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেয়েবাজির জগতে যুক্ত ‘প’ নামে ওই নারীর সাথে সিএমপির তৎকালীন এডিসি পদ মর্যাদার ‘ত’ আদ্যাক্ষের এক পুলিশ কর্মকর্তার বেশ সখ্যতা ছিল। এই পুলিশ কর্মকর্তা ওই হোটেলের সুইমিং পুলে বসে ‘সীসা’ (এক ধরনের মাদক) সেবন করতেন। প্রায় প্রত্যেক দিন এসকে’র সাথে আড্ডা দিতেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

‘প’ আদ্যাক্ষরের ওই নারী চট্টগ্রামের সাবেক এক সিটি মেয়রের আস্থাভাজন পরিচয় দিয়ে গেল বিপিএল-এ কিছু কাজ পান। সেসময় নিজেকে বিপিএল’র চিয়ার্স লিডার হিসেবেও পরিচয় দেন এ নারী। বিপিএল-এ অংশ নেওয়া বিসিবির কর্মকর্তাদের ‘পার্টিগার্ল’ সাপ্লাই দেন ‘এসকে’।

সূত্রটি জানায়, একই চক্রে জড়িত আছেন’ ‘শ’ আদ্যাক্ষরের একটি ফ্যাশন হাউসের ‘ই’ আদ্যাক্ষরের এক কর্ণধার। তার সাথে আছেন ‘ন’ ‘ম’ আদ্যক্ষরের নারী উদ্যোক্তা এবং ‘ব’ ‘প’ ‘শাকি’ ‘আলম’ স্মি, আদ্যক্ষরের নারী ও পুরুষ। ‘স্মি’ এখন মহানগর জাতীয় পার্টির এক নেতার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। মনোরঞ্জনের জন্য ওই নেতাকে নিয়মিত নারী সাপ্লাই দেন তিনি।

সূত্র মতে, ‘মেয়েবাজি’ জগতের আরেকটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে আছে রাজু, তারেক ও মুরাদ নামে তিন যুবক। এই মুরাদ বর্তমানে নগরের জুবিলী রোডে একটি দুই তারকা হোটেলে ডিজে প্রোগ্রাম করেন। সেখানে বসানো হয় প্রতিনিয়ত ‘বার প্রোগ্রাম’। এ ডিজে প্রোগ্রামে পাশ্চাত্য ঢংয়ের পোশাক পড়ে নারীদের ডান্স করানো হয়। আগ্রাবাদ এলাকার ওই অভিজাত হোটেলের ডিজে পার্টিতে নিয়মিত অংশ নেওয়া এক নারী জানান, এ হোটেলের সুইমিং পুলের পাশে একটি ফায়ার এক্সিট রুম আছে। সেটি দিয়ে বোরকা পড়ে ‘মেয়ে’রা ঢুকেন। এরপর হলের পাশে থাকা ড্রেসিং রুমে তারা তাদের পোশাক পরিবর্তন করেন।

ডিজে পার্টিতে অংশ নিতে ২০০০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করেন ‘কাস্টমাররা’। মেয়েরা হোটেলের পেছনের গেট দিয়ে ঢুকলেও ‘কাস্টমাররা’ ঢুকেন সামনের গেইট দিয়ে। নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন গেইট পাহারায়। হোটেলের বল রুমের আগে দুটি টেবিল একসাথে করে বসে সেখানে টিকিট বিক্রি করে নিরাপত্তাকর্মীরা। টিকিট সংগ্রহের পর তাদের নাম ও মোবাইল নং এন্ট্রি করে রাখা হয়। পরে এসএমএস’র মাধ্যমে ডিজে প্রোগ্রামের সিডিউল ‘কাস্টমারদের’ জানিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত ডিজের নামে চলে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। ‘অনুষ্ঠান’ শেষে হোটেল কর্তৃপক্ষের দুটি কালো রংয়ের ‘হাইচ’ মাইক্রোবাসে করে ‘মেয়েদের’ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, ডিজে রাজু’র সাথে আছে এমিলি। তাদের বাসা নগরের দেওয়ান বাজার এলাকায়। এ জগতের ‘গুরু’ বলে পরিচিত রুমার স্বামী একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ‘মেয়েবাজি’র আরেক নাম সোহেল। একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত ‘ই’ আদ্যাক্ষের কথিত এক সাংবাদিক। খুলশি এলাকার একটি শপিং মলে রাজুর দোকান আছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, একসময় জিইসি মোড এলাকার একটি চার তারকা হোটেলও চলতো এসব অপকর্ম। ‘আ’ এবং ‘প’ আদ্যাক্ষের দুই যুবক এসব চালাত। একই এলাকায় তাদের ‘ব’ আদ্যাক্ষরের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। ‘প’ নামের যুবক একসময় জিইসি মোড এলাকার ‘ল’ আদ্যাক্ষরের একটি আবাসিক হোটেলে ডিজে পার্টির আড়ালে নারীদের শরীর বিকিকিনি করেন এ যুবক। তার ‘রঙ্গশালায়’ নিয়মিত অংশ নেন ‘শ’ ‘র’ ও নানা ভাই খ্যাত ‘স’ আদ্যাক্ষরের শিল্পপতি।

সূূত্রটি জানাচ্ছে, নগরের জুবিলী রোডের একটি হোটেলের ‘রুফটপে’ এখনো নিয়মিত বসে মদের আসর। চলে অবাধ যৌনতা। সেখানে অংশ নেন পুলিশ কর্মকর্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা। ডিজে পার্টিতে নাচগান করে ‘যৌনপিপাসু’ পুরুষদের ‘আনন্দ’ দানকারী এক নারী পরিচয় গোপন রেখে একুশে পত্রিকার কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “বউবাচ্চা রেখে, লোকদেখানো সুখী সংসার রেখে নিজের কন্যার বয়সী মেয়েদের শয্যাসঙ্গী হিসেবে পেতে দালালদের কাছে নিত্য ধর্না দেয় কারা? গোপনে অভিজাত বাসাবাড়ি, হোটেল, রিসোর্ট, অবকাশযাপন কেন্দ্রগুলোতে কারা হাঁটুর বয়সী মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করতে যায়? মেয়েদের পেছনে কারা টাকা উড়ায়? কারা তাদের শখ আহ্লাদ মেটানোর খরচ জোগায়? কারা ঘরে বউ রেখে টাকার গরমে নারী পোষে, নোংরামো করে বেড়ায়? “রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, প্রশাসনের বড় মাঝারি এমনকি আমলারাও এখন এই জগতের নিয়মিত খরিদ্দার।’ বলেন ওই নারী।

পুলিশের অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রামের খুলশি এলাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল ভবনের ফ্ল্যাটে প্রায় রাতে ডিজে পার্টি করে থাকেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। আর এসব পার্টিতে টিকেট কিনে যোগ দেন তরুণ থেকে শুরু করে মাঝবয়সী পুরুষ। অবাধ যৌনতার পাশাপাশি উঠতি তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। মদ, বিয়ার, ইয়াবা, কোকেন, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ প্রায় সকল ধরনের মাদক পাওয়া যায় এসব পার্টিতে। মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম শহরের খুলশি, আগ্রাবাদ এলাকার অভিজাত হোটেল, গেস্ট হাউস, বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাড়িতে চলছে ডিজে পার্টির নামে মাদক ও দেহ ব্যবসা। ডিজে পার্টিগুলোয় মদ, বিয়ারের পাশাপাশি সেবন করা হয় ইয়াবা। চলে অসামাজিক কার্যকলাপ।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকাগুলোর মধ্যে যেসব স্থান নিরাপদ, নির্জন সেসব এলাকায় প্রায় রাতেই ডিজে পার্টির নামে বেপরোয়াভাবে চলছে যৌন-বাণিজ্য। তরুণদের বিপদগামী করছে এসব চক্র। তারা ডিজে পার্টির নামে কমবয়সী মেয়েদের দিয়ে যৌনকর্ম করাচ্ছে। বিভিন্ন বাসা-অফিস ভাড়া নিয়ে চক্রটি এসব অপকর্ম করছে। এ প্রসঙ্গে নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘অসামাজিক কার্যকলাপে অভিযোগে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও বাসা-বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এসব অভিযানে গ্রেফতার করা হচ্ছে নারী-পুরুষদের। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে।’