বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

একজন খালেদ মাহমুদ ও তাঁর ইডেন ইংলিশ স্কুলের গল্প

প্রকাশিতঃ ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ৮:৫৫ অপরাহ্ন


আবছার রাফি : ‘শিখিবার কালে, বাড়িয়া উঠিবার সময়ে, প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্য- ইহারা বেঞ্চি এবং বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয়।’ শিক্ষা সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধে এই উক্তিরই সদৃশভাব যেন বাস্তবে প্রতিফলন ঘটিয়েছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ইডেন ইংলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষ।

প্রবাদ আছে, ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন; নহে বিদ্যা, নহে ধন, হলে প্রয়োজন।’ অর্থাৎ মুখস্থ বিদ্যা এবং পুঁথিগত বিদ্যা যেমন কারও উপকারে আসে না, তেমনি অন্যের হস্তগত ধনও নিজের কোনও উপকারে আসে না। তাই কেবল মলাটবদ্ধ নির্জীব গ্রন্থনির্ভর পড়াশোনায় ছাত্র-ছাত্রীদের স্থিত না রেখে প্রাকৃতিক জ্ঞানভাণ্ডার থেকে যেন নানা উপকরণ আহরণ করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে, সে লক্ষ্যে মাটি ও মানুষের সাথে শিক্ষার্থীদের নিবিড়ভাবে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইডেন ইংলিশ স্কুলে রাখা হয়েছে ছোট কলেবরে কৃষিখামার এবং তাতে হাতেনাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

শিক্ষার্থীদের জীববৈচিত্র্যের প্রতি সহমর্মিতা-মানবিক আচরণ ও সহিংসতা প্রতিরোধের শিক্ষা এবং সুস্থ-শালীন বিনোদনের জন্য মিনি চিড়িয়াখানা, প্রকৃতি-পরিবেশের সাথে বৈরিতা ব্যতিরেকে সেতুবন্ধন রচনা করতে স্কুলপ্রাঙ্গণ ও ছাদে শোভাময় বাহারি বৃক্ষরাজির সমাহার ও বাগান, নিয়মিত সাঁতার অনুশীলনের জন্য নিজস্ব সুইমিং পুলে সাঁতারের ক্লাস, আত্মরক্ষা সংক্রান্ত শিক্ষা দিতে কারাতে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক, সৃজনশীল বিকাশে মনোরম পরিবেশের খেলার মাঠসহ সুবিশাল ক্যাম্পাসে ঘেরা ইডেন ইংলিশ স্কুল।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ইংরেজিতে বাড়তি জোর দেওয়ার কথা সবারই কমবেশি জানা। এমনকি অনেকাংশে বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে যে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বেশি, তাও একবাক্যে সকলে স্বীকার করেন। কিন্তু কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যদি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, আর সেটা যদি হয় সম্পূর্ণ ব্যবহারিক পদ্ধতি অবলম্বনে, তা বোধহয় শুনতে অনেকের কাছে একটু ব্যতিক্রম বলে মনে হতে পারে। হ্যাঁ, এমন এক ব্যতিক্রমী শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ইডেন ইংলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষ। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে গতানুগতিক ধ্যান-ধারণা পাল্টে দেওয়া ইডেন স্কুলের এই সৃষ্টিশীল-করিৎকর্মা প্রয়াসে মুগ্ধ সংশ্লিষ্ট অভিভাবকসহ চট্টগ্রামের শিক্ষিত-সচেতন মহল।

কথায় আছে, ‘সন্তানের জন্ম দেওয়া সহজ, কিন্তু মানুষ করা কঠিন।’ স্বভাবত শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়, তাই শিশু বয়সে সন্তানদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা ভুলভ্রান্তির আজীবন খেসারত দিতে হয় দেশ-জাতিকে। বিশেষত অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন- ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীরা বিপদগামী হচ্ছে। তাই ইডেন ইংলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষ ইসলামি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির বিকাশে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে উদ্বুদ্ধ করতে ইংরেজি পড়ুয়া মুসলিম ছেলে-মেয়েদের নুরানী পদ্ধতিতে বাধ্যতামূলক কুরআন শিক্ষা আর ব্যবহারিক পদ্ধতিতে নামাজ শিক্ষা দিচ্ছে। যেখানে প্রতিদিন দল বেঁধে জামায়াতে নামাজ আদায় করছে শিক্ষার্থীরা। নামাজের সময় হলে এক সহপাঠী ডেকে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীকে, তার মধ্যে কেউ করে নামাজের ইমামতি আবার কেউ বা দেয় নামাজের ইকামত।

ইডেন ইংলিশ স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হালিদা রশীদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমি আগে ইলিমেন্টারি স্কুলে ছিলাম। এখানে আসার সময় মনে হয়েছে, এখানকার শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাটা ঠিকমত হয়ে উঠবে না। কিন্তু স্কুলের ব্যতিক্রমী সব নান্দনিক-মানবিক আয়োজনে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। বিষাদিত হওয়ার বদলে আনন্দের সাথে পড়া চালিয়ে যাচ্ছে বাচ্চারা। অভিভাবকরাও প্রীত-সন্তুষ্ট। অভিভাবকরা যখন আমাদের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট হয়ে ফোনে বা সরাসরি উচ্চকিত প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তখন অবাক হই। আর বাচ্চাদের সাথে বিভিন্ন আয়োজনে আমরাও সুখানুভব করি। মা-সন্তানের মতো পরম মমতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি এবং ইনশাল্লাহ এই সাফল্য-প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে।

সম্প্রতি সরেজমিন হাটহাজারী শিকারপুর ইউনিয়নের চন্দ্রাবিল এলাকায় অবস্থিত ইডেন ইংলিশ স্কুল ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, সবুজ প্রকৃতি আর নান্দনিক পরিবেশের আধার যেন এই স্কুলক্যাম্পাস। শহরের যান্ত্রিকতা বা বড় বড় দালানকোঠার সংশ্রবশূন্য নির্জন জায়গা। প্রবেশ করলে যে-কারোরই যেন নির্জীব-নির্লিপ্তভাবে বসে থাকার সুযোগ নেই। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এই স্কুল ক্যাম্পাসে মিনি চিড়িয়াখানার খরগোশ, বানর যেন অতিথি বরণে মুখিয়ে থাকে। কেউ জোরপূর্বকভাবে চাইলেও শিশুদের শৈশবের আনন্দ আর খুনসুটি ছিনিয়ে নিতে পারবে না। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের উপর শুধু ক্লাস আর বইয়ের বোঝা না চাপিয়ে কীভাবে আনন্দের সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করানো যায়, সেই ভাবনা যেন এই স্কুলের প্রতিটি দেওয়াল-আঙিনায় গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।

দেখা গেছে, বাংলা-ইংরেজি (ন্যাশনাল কারিকুলাম) উভয় মাধ্যমেই পাঠদান করা হয় এই স্কুলে। এমনকি উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর প্রয়াসে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, প্রতি ৮ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাংলা বা অন্য মাধ্যম থেকে আগত শিক্ষার্থীদের ইংরেজি মাধ্যমে সমন্বয়ের জন্য বিশেষ ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা, প্রতি মাসে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, যাতায়াত ভোগান্তি লাঘবে নিজস্ব পরিবহনের সু-ব্যবস্থা, আধুনিক মানের অভিভাবক কক্ষ ও ক্যান্টিনের সুবিধা, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ-পর্যবেক্ষণ ও লোডশেডিং ঝামেলা পোহাতে ২৪ ঘণ্টা জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ইডেন ইংলিশ স্কুলে।

গ্রামে শহরের সুবিধাসম্পন্ন ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে কথা হয় ইডেন ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. খালেদ মাহমুদের সঙ্গে।

তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি যখন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার চিন্তা করেছি তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাচ্চাদেরকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবো নাকি একজন আদর্শবান ছাত্র বা একজন আদর্শবান নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো; সেই চিন্তাটাই আমার মাথায় বেশি ছিল। আদর্শ ছাত্র বলতে, একটা ছাত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা থাকতে হবে, ধর্মীয় শিক্ষা থাকতে হবে, পরিবারে প্রতি সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধটা তাদের কোমল মনে আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিতে হবে; এই চিন্তাভাবনাগুলো ছিল।’

‘ধর্মীয় শিক্ষাকে আমাদের স্কুলে অন্তর্ভুক্ত করার নেপথ্যে একটা ঘটনা কাজ করেছে। সেটা হলো, আমার রাঙ্গুনিয়া এলাকার একটা ছেলে শহরের চান্দগাঁও আবাসিকে থাকে। নাম ওসমান, সে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার একমাত্র সন্তানের বয়স ৭-৮ বছর হবে। ওসমানের ছেলে এক হুজুরের কাছে নিয়মিত পড়তো। কিন্তু প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পর হুজুরের কাছে পড়তে বসতে তার মন সায় দিত না। তার কোমল মনের মধ্যে একটা ব্যথা লাগতো, কষ্ট লাগতো যে সারাক্ষণ স্কুলে ছিলাম এখন আবার বাসায় হুজুর আসছে। তাই পড়তে মন চাইতো না তার। তারপরেও জোর করে পিতা-মাতা তাকে হুজুরের পড়ার টেবিলে পাঠাতো।’

‘একদিন হুজুর বাচ্চাকে পড়ার জন্য গেইট দিয়ে ঢুকেেছ, হুজুরকে দেখে সে দৌঁড়ে পালিয়ে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না, এদিকে হুজুর পড়ার রুমে গিয়ে ছাত্রের জন্য অপেক্ষা করছে। বাসার সবাই খোঁজাখুঁজি করছে, তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পরক্ষণে দেখা গেল, সিঁড়ির নিচে পানির একটা রিজার্ভ ট্যাংক ছিল এবং সেই রিজার্ভ ট্যাংকের ঢাকনাটা খোলা ছিল। সে হুজুরের কাছে না পড়ার জন্য দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে পানির রিজার্ভ ট্যাংকের ভেতরে পড়ে মারা গেছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক, খুবই মর্মস্পর্শী-বেদনাদায়ক। একটা পিতামাতার জন্য এর চাইতে বড় দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। এসবের একমাত্র কারণ হচ্ছে, বাচ্চার চিন্তা-চেতনার ওপরে পরিবার জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাচ্চাটা সেটা মানতে পারেনি, ফলে তার অকাল মৃত্যু হলো।’

‘এই ঘটনাটা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে। আমি তখন চিন্তা করেছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষক আর অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের। একটা ঘণ্টা যদি আমি ধর্মীয় শিক্ষার জন্য রাখি তাহলে একটা বাচ্চা বাসায় হুজুর রাখলে যে শিক্ষাটা নিতে পারতো, সে এক ঘণ্টায় তা কাভার করতে পারবে কিনা?- সবাই বলল, পারবে। একটা ঘণ্টা যদি আমি শুধু ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষার জন্য রাখি তাহলে কোনো সমস্যা আছে কি না-সবাই বলল, না। তাই প্রথম থেকে রুটিনের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাটাকে বাধ্যতামূলক করেছি।’ – বলেন ইডেন ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মো. খালেদ মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘আমি আগেও চেয়েছিলাম একটা পরিপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পায়। আমাদের স্কুলে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এক ঘণ্টা বাচ্চাদের কুকিংয়ের ক্লাস করানো হয়। একটা বাচ্চা বাজার থেকে কেক খাচ্ছে, বিস্কিট খাচ্ছে, আইসক্রিম খাচ্ছে, নুডলসসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র খাচ্ছে। বাজারের জিনিস আর ঘরে বানানো জিনিসের মধ্যে প্রার্থক্যটা কী? জিনিসগুলো কীভাবে বানানো হয়, সেই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাচ্চারা খুব উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে জিনিসগুলো দেখে এবং তারা নিজেরা নিজেরা বাসায় পরিবার বা গুরুজনের সহযোগিতায় অনুশীলন করে, আবার আমাদেরকে তা ভিডিও করে পাঠায়। তাহলে নিয়মিত ক্লাসের বাইরের একটা ক্লাস, অন্যরকম একটা ক্লাসে বাচ্চারা ঢুকে গেল। যেদিন কুকিং ক্লাস থাকে ওইদিনের উপস্থিতি অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি থাকে।’

‘আমাদের স্কুলে একটা সুইমিং পুল করা হয়েছে। আজকালকের বাচ্চারা তো সাঁতার জানে না। সাঁতার জানে না বললে ভুল হবে, তাদের সাঁতার শেখানো হয় না। পরিবারগুলো বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে উদ্যোগী হয় না। ফলে দেখা যায়, প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে অমুক জায়গায় নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে বাচ্চা মারা গেছে এত বছরের শিশু। পুড়ে গেছে বা পানিতে পড়ে মারা গেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে এ ধরনের অহরহ খবর আসে। এসবের একমাত্র কারণ হচ্ছে, মা-বাবা অথবা দায়িত্বশীল যারা আছে তাদের উদাসীনতা। বাচ্চাদেরকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেছনে দৌঁড়ানো। একটা বাচ্চাকে পরিপূর্ণভাবে শিক্ষিত করার জন্য আরও যে অন্যকিছুর দরকার হয় সেই জিনিসগুলো পরিবার অনেক সময় চিন্তা করে না। যার ফলে এই অঘটনগুলো ঘটে। সেজন্য আমি অন্তত পানিতে নামার ভয়-ভীতিটা দূর করতে এই সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করেছি। নূন্যতম একটা বাচ্চা যেন বলতে পারে, আমি সাঁতার পারি; সেই শিক্ষাটা দেওয়ার জন্য আমাদের এই ব্যবস্থা।’

সচরাচর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিড়িয়াখানা তো চোখে পড়ে না। যা পার্কে বা বিনোদন কেন্দ্রে থাকে, তা আপনি স্কুল ক্যাম্পাসের স্থাপন করেছেন। এর পেছনের উদ্দেশ্য কী- এমন প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিপেন্ডেট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মো. খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘সোজা কথা হচ্ছে রিফ্রেশমেন্ট। সকালবেলা বাচ্চারা স্কুলের গেইট দিয়ে ঢোকামাত্রই দৌঁড়ে চলে যায় চিড়িয়াখানার পাশে। অ্যাসেম্বলি শুরু হওয়ার আগে দুই মিনিট সময় পেলেও তা চিড়িয়াখানার আশপাশে খরচ করবে। বানর কী করে, পাখি কী করে, খরগোশগুলো কী করে এবং অন্যান্য জীবজন্তুগুলো কী করে; তা দেখে। এবং তাদের সাথে খুনসুটিতে জড়িয়ে পড়ে, খেলে; এই যে একটা মেন্টাল রিফ্রেশমেন্ট হয়ে গেল, এটা তাদের সারাদিনের পড়ালেখায় একটা উপজীব্য হিসেবে কাজ করে। শুধু পড়ালেখা, পড়ালেখা এমনটা না করে রিফ্রেশমেন্টের জন্য এটা করা হয়েছে।’

‘আমাদের স্কুলে জুডো (কারাতে) শেখার জন্য একজন ইনস্ট্রাক্টর আছে। জুডো শেখার অর্থ হচ্ছে- মারামারি শেখা না, জুডো শেখার অর্থ হচ্ছে আত্মরক্ষা কীভাবে করতে হয়; তা শেখা। তোমার হাত, পা, চোখ, মুখ দিয়েছে মহান আল্লাহ। তা তুমি কখন ব্যবহার করবা, কীভাবে ব্যবহার করবা, কেন ব্যবহার করবা, আর কেন ব্যবহার করবা না; এই শিক্ষাগুলো দেওয়া হয়। আত্মরক্ষামূলক কিছু দিকনির্দেশনা-শিক্ষা এখানে থাকে, যা শিক্ষার্থীরা পায়। বাচ্চারা জুডো ক্লাস করতে যখন ড্রেস পরে মাঠে চলে আসে তখন আলাদা একটা সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, যা অন্যান্য বাচ্চারা উপভোগ করে।’

ইডেন ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘আমার স্কুলের বাচ্চারা আজান দেয়, ইমামতি করে। এক বাচ্চা ইমামের পেছনে অন্যান্য বাচ্চারা লাইন ধরে নামাজ পরে। ছেলে-মেয়েরা আলাদা আলাদাভাবে নামাজ পড়ে। আমার ছোট ছেলের বয়স হচ্ছে ৮ বছর। আমি যখন আমার পরিবারের বাচ্চাদেরকে নিয়ে নামাজ পড়ি তখন আমার ৮ বছরের ছেলে একামত দেয়। আমি রুটিন করে দিয়েছি, সকালবেলা আমার মেঝ ছেলে ইমামতি করবে, মাগরিবের সময় আমার বড় ছেলে ইমামতি করবে। এভাবে প্র্যাকটিস করাই তাহলে তাদের তো যে কোনও পর্যায়, যে কোনও জায়গায় গেলে অন্তত এই জিনিসগুলোর প্রতি ভয়-ভীতি থাকবে না।’

মফস্বল এলাকায় ইংলিশ স্কুলের ক্যাম্পাস করেছেন। নিঃসন্দেহে এই এলাকার মানুষের জন্য তা অনেক বড় পাওনা। এই পর্যন্ত আপনি স্কুলের জন্য অনেক কিছু করেছেন, সামনে আর কী করার পরিকল্পনা আছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘স্বপ্ন দেখতে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি। স্বপ্ন যখন বাস্তবে রূপ পায় তখন আরো বেশি আনন্দিত হই। এক সময় আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখানে একটা স্কুল করবো। আমাকে যদি প্রথম দিন বলা হতো, আপনি যে স্কুল করতে চাচ্ছেন- এত ঘণ্টা সময় এখানে দিতে হবে, এত টাকা পয়সা এখানে দিতে হবে, এতগুলো মানুষের সাথে কথা বলতে হবে। সবগুলো একেকটা প্যাকেজ করে যদি আমাকে বলতো- এগুলোর ভার যদি আপনি বহন করতে পারেন তাহলে আপনি স্কুল করেন। না হয় করবেন না। তাহলে আমি প্রথমে সারেন্ডার করতাম। প্রথমদিন যদি জানতাম যে আমার এই এই কাজগুলো করতে হবে।’

‘সামনে এখানে যা কাজ আসে তাই করবো। যা কিছু প্রয়োজন হবে তাই করবো। আমি এখানে যে আধুনিক মানের স্কুল করেছি সেজন্য আমি মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। উনার দয়া না থাকলে হয়তো আমার দ্বারা এই কঠিন কাজটা করা সম্ভব হতো না। পাশাপাশি অত্র এলাকার অনেক জনগণ আছে, যারা আমাকে এই কাজ করার জন্য উদ্বুব্ধ করেছেন। এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। প্রত্যেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এবং ভবিষ্যতে আমার একটা ইচ্ছা আছে, আমাদের দেশটা হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একটা জাতির দেশ। আমাদের দেশে বর্তমান শিক্ষার হার প্রায় ৭৪ শতাংশ। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে আমাদের দেশে এই ৭৪ শতাংশ শিক্ষিত জাতিকে এফোর্ট করার মতো আমাদের সেই অফিস নেই, মিল-কারখানা নেই, ইন্ডাস্ট্রি নেই। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতায় তারা অনেক পেছনে আছে।’

মো. খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন চীন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল, শিক্ষাব্যবস্থা যখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল এবং মিল কারখানা, ইন্ডাস্ট্রি যা কিছু ছিল সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন তৎকালীন চীন সরকার চিন্তা করেছিলো- তাদের দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে সেগুলোতে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার। পুরো চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। যারা কলেজ পড়ুয়া বা উত্তীর্ণ হয়েছিল তাদের সবাইকে এলাকায় এলাকায় ছোট ছোট করে হাতে কাজ করার জন্য ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট করে দিয়েছিল। কলেজগুলোকে বানিয়েছিলো ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট। বাচ্চাদেরকে ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য প্রয়াস চালিয়েছেন। সেটা এক বছর না, একটানা ১২ বছর চীন দেশে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এই ১২ বছর কলেজপড়ুয়া, স্কুলপড়ুয়া ছাত্ররা ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং নিয়ে ঘরে বসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস বানানোর চেষ্টা করেছে। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে চীন আজ সারাবিশ্বে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ।’

‘শিক্ষার প্রসারে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন, নিচ্ছেন। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে কোন কোন জায়গায় কী করতে হবে তা তিনি চিন্তা করেন। বাংলাদেশের মতো একটা জায়গায় এখন হেল্থ সায়েন্সের উপরে ইউনিভার্সিটি আছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেল্থ সায়েন্সেস। সেটাতে কোনও ডাক্তার হয় না। সেখানে প্রায় ১২টা বিষয়ের উপরে অনার্স-মাস্টার্স করানো হয়। এমনকি সেখান থেকে পিএইচডি পর্যন্ত দেয়ো হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব ব্যাপারে খুবই সচেতন। অবস্থা, প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাচ্চাদের সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ সরকারের আছে। আর এটার অংশ হিসেবে আমিও চিন্তা করেছি, এই এলাকায় একটা ন্যাশনাল কারিকুলাম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাশাপাশি একটা ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট করে অত্র এলাকার বেকার, শিক্ষিত বেকার যুবক যারা আছেন তাদেরকে ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত করে অবদান রাখার জন্য, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য। স্বপ্ন আছে, আল্লাহ যদি কবুল করে ইনশাআল্লাহ সেটাও আমি করবো।’- বলেন ইডেন ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. খালেদ মাহমুদ।