শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

‘হাই সাহেব, আপনি এটা করলেন কী?’

| প্রকাশিতঃ ২৮ নভেম্বর ২০২১ | ৪:৪৯ অপরাহ্ন


ঢাকা : হাসনাত আবদুল হাই। তিনি একাধারে সাবেক সচিব, ঔপন্যাসিক, শিল্পসমালোচক এবং কলামিস্ট। লেখাপড়া করেছেন কলকাতা, ঢাকা, ওয়াশিংটন, লন্ডন ও কেমব্রিজে। উচ্চতর শিক্ষার বিষয় অর্থনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করার পর যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদ থেকে অবসর নেন।

চট্টগ্রামে একাধারে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন প্রজাতন্ত্রের একনিষ্ঠ কর্মচারী হাসনাত আবদুল হাই। লেখালেখিতে দারুণ সমুজ্জ্বল, সপ্রতিভ, চৌকস এ আমলাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার আলোচনাও হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টা হননি তিনি। কী কারণে এমনটা হলো সেই গল্প শোনালেন হাসনাত আবদুল হাই।

বলেন, ‘অবসরে যাওয়ার পর আমি প্রায় বছর দুয়েক রেগুলার হোটেল সোনারগাঁওয়ে গেছি। ওখানে সাদেক খান এক টেবিলে বসে লিখতেন। তারপর উনার দেখাদেখি বিএনপির তৎকালীন এমপি আবু হেনাও আসা শুরু করলেন। প্রথমে আমরা আলাদা বসলেও একসময় তিনজনই একই টেবিলে বসতাম। কফি খেতাম আর তিনজন যে যার মত লেখালেখি করতাম। এর কিছুদিন পরেই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে।’

স্মৃতিচারণ করে হাসনাত আবদুল হাই বলেন, আমাকে জিল্লুর রহমান স্যার (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) ডেকে প্রশ্ন করলেন- হাই সাহেব, আপনি এটা করলেন কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার তালিকায় আপনার নাম এক নম্বরে ছিল। আমি বললাম, তারপর কী হলো? তিনি বললেন, আপনি নাকি সাদেক খান, আবু হেনাদের সাথে এক টেবিলে বসে আড্ডা দেন, লেখালেখি করেন। তাই কেউ কেউ বিরোধিতা করলেন। তাই আপনার নামটা বাদ পড়লো।’

২৩ নভেম্বর ঢাকার পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে এক আড্ডায় হাসনাত আবদুল হাই এসব কথা বলেন। এ সময় সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সচিব, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হোসেন আবদুল মান্নান, একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার ও চট্টগ্রাম সিটির প্রাক্তন কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্মৃতিচারণ করে হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ‘তিমি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। বলতেন- হাই সাহেব আপনাকে দেখলে আমার ব্রিটিশ আমলের আইপিএস অফিসারের কথা মনে আসে। আসলে তিনি একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। গল্প করার জন্য আমার রুমে চলে আসতেন। আমি বলতাম- স্যার আপনি আমার রুমে আসবেন না, আপনি ডাকলে আমি আপনার রুমে চলে আসবো। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতেন না। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে আমার রুমে চলে আসতেন, আড্ডা দিতেন।’

জিল্লুর রহমানের সাথে নিজের মজার ঘটনার কথাও স্মরণ করেন আবদুল হাই। বলেন, ‘স্যারের সাথে আমার মজার কিছু ঘটনা আছে। একবার জিল্লুর রহমান স্যারের সাথে আমি নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে এতো মানুষ থাকতে স্নাইফার ডগ জিল্লুর স্যারের স্যুটের পাশে ঘোরাঘুরি করছিলো। তিনি আমাকে বললেন- হাই সাহেব, কুকুর আমার পাশে ঘোরাঘুরি করে কেন? আমি মজা করে বলেছিলাম- স্যার হয়তো আপনার স্যুট দেখে কুকুরের সন্দেহ হচ্ছে।’

‘উনার (জিল্লুর রহমান) সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। আমার চাকরির ২ বছর এক্সটেনশন শেষ হওয়ার পর উনি ফাইল নিয়ে আমার কাছে আসলেন। বললেন- হাই সাহেব, আপনাকে ছাড়া তো আমি পারবো না। আপনাকে আমার লাগবে।’

প্রয়াত জিল্লুর রহমানের কথায় একটি প্রকল্পের টেন্ডার বাতিল করতে গিয়ে বেশ ঝামেলায়ও পড়তে হয়েছিল হাসনাত আবদুল হাইকে। সেই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন- ‘তখন গ্রীষ্মকাল, ওয়াটার লেবেল অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল, পানি পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন ওয়াসার এমডি বলেছিলেন- স্যার জরুরি ভিত্তিতে ওয়াটার পাম্প আনতে হবে। না হলে ঢাকায় পানির জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। আমি বললাম ঠিক আছে টেন্ডার করুন। শর্ত ছিল পাম্পগুল্লো প্লেনে আনতে হবে। শর্ত মেনে এক ব্যক্তি টেন্ডার পেলেন।

‘পরবর্তীতে একদিন জিল্লুর রহমান স্যার বললেন- হাই সাহেব, ওই লোক তো খারাপ লোক। উনার টেন্ডার বাতিল করে দিন। নিয়মানুযায়ী যে কাজ হয়েছে তা আমি বাতিল করি কীভাবে। আমি বললাম স্যার, এতে বড় সমস্যা হতে পারে। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যাবে। তিনি আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। স্যার বললেন- আপনি একটু দেখুন না, আপনি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন।’

‘এরপর আমি ওয়াসার এমডিকে ডেকে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি জানান- সেই ব্যক্তি একটি দরখাস্ত দিয়েছেন, যেখানে তিনি প্লেনে না এনে জিনিসগুলো জাহাজে আনতে চান। যেহেতু শর্ত লঙ্ঘন করে এই কাজ তিনি করতে চান তাই আমিও আইনের মধ্যে থেকেই তার টেন্ডার বাতিল করতে পারি। বললাম- এক্ষুণি উনার টেন্ডার বাতিল করুন। পরবর্তীতে জিল্লুর স্যার বললেন- হাই সাহেব, আমি জানতাম আপনি পারবেন। আর তা যে আইনের মধ্যে থেকেই করবেন সেই বিশ্বাসও আমার ছিল।’

‘যদিও ওই ব্যক্তির টেন্ডার বাতিল করার পর তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠলেন। হাইকোর্টে রিট করে বসলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আমাকে ফোন করে বিষয়টা নিয়ে জানতে চাইলেন। পরে পার্লামেন্টের স্পেশাল কমিটি আমাদের শুনানির জন্য ডাকলো। মন্ত্রী মহোদয় (জিল্লর রহমান) আমাকে বললেন- আমি কিছু বলতে পারবো না, যা বলার আপনি বলবেন।’

‘সেসময় পার্লামেন্টের স্পেশাল কমিটি কত কথা শুনিয়েছেন। বলেন- আপনারা কী মনে করেছেন? ধরাকে সরা মনে করেন! প্রথমে কন্ট্রাক করবেন, আপনাদের মনমত না হলে বাতিল করবেন। আমরা কি বুঝি না কেন এগুলো করেন? আমি তাঁকে আর্জেন্সির বিষয়টা বুঝিয়ে বলি, পাশাপাশি শর্ত ভঙ্গের কথাটাও বলি। আরও বলি, এখন টেন্ডার বাতিল হয়েছে পরে রি-টেন্ডার হলে তিনি আবার শর্ত মেনে আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু শর্ত লঙ্ঘন করে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য তো আমরা মানহানির মামলা করতে পারি। তারপর সবাই একদম চুপ হয়ে গেলেন।’

কবি ও ঔপন্যাসিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের জন্ম ১৯৩৯ সালে, কলকাতায়। পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামে। স্কুলশিক্ষা কলকাতা, যশোর, ফরিদপুর শহরে। কলেজ শিক্ষা ঢাকায়।

শিল্প-সাহিত্যের বহুমাত্রিক শাখায় বিচরণ হাসনাত আবদুল হাইয়ের। ছাত্রজীবন থেকেই লেখা শুরু। ১৯৫৮ সালে ছোটগল্প রচনার মাধ্যমে। ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ-কাহিনী, শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনা এবং নাটক এই সব শাখায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন চার দশকের অধিককাল। বাংলা এবং ইংরেজিতে একটি কবিতার বই লিখেছেন জাপানে প্ৰবাস জীবনে।

এ পর্যন্ত লিখেছেন ৬টি গল্পগ্রন্থ’, ৩০টি উপন্যাস, ৭টি ভ্রমণ কাহিনী, ৪টি প্রবন্ধসংগ্রহ। বাংলা ছাড়াও ইংরেজিতে সমাজ বিজ্ঞান ও উন্নয়ন বিষয়ে লিখেছেন। ছোটগল্পের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৭ সালে।

সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন অলক্ত পুরস্কার, মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। তাঁর লেখা উপন্যাস সুলতান ডাবলিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।