মোহাম্মদ রফিক : আবু রায়হান চৌধুরী (৬৭)। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য লড়েছেন গেরিলা যুদ্ধে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন কর্ণফুলী কন্টিনজেন্ট-৩ এর সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে কীভাবে পাকহানাদার, আলশামস ও আলবদরবাহিনীর দুর্গে আঘাত করেছিলেন- সেই গল্পই একুশে পত্রিকাকে শুনিয়েছেন আবু রায়হান চৌধুরী।
গেরিলাযোদ্ধা আবু রায়হান চৌধুরী জানান, মেট্রিক পাশ করে আগ্রাবাদ কমার্স কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন তিনি। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তখন তিনি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন বন্ধু তাওহীদুল করিম কাজল ‘কিছু কথা আছে’ বলে তাঁকে নিয়ে যান নগরের রহমতগঞ্জ মাছুয়া ঝর্ণা লেইনে আবুল মনসুরের বাসায়। আবুল মনসুর তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর বাসায় আগে থেকে ছিলেন তাওহীদুল করিমের বড়ভাই রেজাউল করিম বাচ্চু, মোস্তাফিজুর রহমান, দেলোয়ার হোসেন মন্টু, আমান উল্লাহসহ ৯-১০জন। সবাই বৈঠকে মিলিত হলেন। এর সমন্বয়ক ছিলেন আবুল মনসুর। বৈঠকে ১১জন তরুণ নিয়ে গেরিলা কমান্ডো বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনী ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এর আওতায়। বৈঠকে কমান্ডো বাহিনীর গ্রুপ লিডার করা হয় রেজাউল করিম বাচ্চুকে। বিএলএফ’র নিয়ন্ত্রণে ছিল তিনটি গেরিলা গ্রুপ। এগুলোর নাম ছিল ‘কর্ণফুলী কন্টিনজেন্ট ওয়ান বা কেসি-ওয়ান, কেসি-টু এবং কেসি-থ্রি। প্রত্যেক গ্রুপে ছিল ১০-১১ জন করে গেরিলা যোদ্ধা।
কেসি-থ্রি’র গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন ডা. মাহফুজুর রহমান। এ গ্রুপের দায়িত্ব ছিল বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরণ, গ্রেনেড ছুড়ে পাকবাহিনী, রাজাকার আল বদর, আল শামসকে ‘ডিমোরালাইজড’ বা হতাশ করা।
গেরিলা যুদ্ধের নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবু রায়হান জানান, নগরের মোমিন রোডে ছিল ইউনাইটেড স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিস (ইউএসআইএস) অফিস। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একদিন এ অফিসে ইউএস স্টেট সেক্রেটারি পরিদর্শনে আসার সংবাদ পান কেসি-থ্রি’র গেরিলারা। সেদিনই ওই অফিসের ফটকে গ্রেনেড ছোড়ার পরিকল্পনা করেন আবু রায়হানসহ অন্যরা। ইউএস স্টেট সেক্রেটারি আসার আগে ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা রেকি করেন গেরিলারা। পরিকল্পনা হয় স্টেট সেক্রেটারি আসার পর ইউএসআইএস অফিসের ফটকে গ্রেনেড ছোড়া হবে।
ইউএসআইএস ফটকে গ্রেনেড হামলার জন্য প্রস্তুত গেরিলারা। দুটি বেবিট্যাক্সি আনা হলো। ট্যাক্সিতে ছিলেন শুধু গ্রেনেড নিক্ষেপকারী গেরিলা। ঠিক দুপুর ১২টা। আন্দরকিল্লা থেকে চেরাগীর মোড়ে এসেই একটি ট্যাক্সি থেকে ইউএসআইএস ফটক লক্ষ করে গ্রেনেড ছুড়লেন এক গেরিলা। কিন্তু সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। এরপর পেছনে থাকা ট্র্যাক্সি থেকে একই ফটক লক্ষ করে গ্রেনেড ছুড়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করলেন হামলাকারী গেরিলা। মুহূর্তেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। এসময় ইউএসআইএস এ অবস্থানরত মার্কিন সেক্রেটারি ও অন্যান্য কর্মকর্তারা ছোটাছুটি করতে থাকেন। তাদের মাঝে বেশ আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন গেরিলাযোদ্ধা আবু রায়হান চৌধুরীসহ অন্যরা।
রাকিবুল হোসেন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে এসে কেসি-থ্রিসহ অন্যান্য গেরিলাদের অস্ত্র চালনা, গ্রেনেড ছোড়া, বিস্ফোরক তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এই রাকিবুল চট্টগ্রামেরই সন্তান বলে জানান আবু রায়হান। গেরিলা যোদ্ধাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, পেট্রল স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া এবং যেখানে পাক মিলিশিয়ারা জমায়েত হতো সেখানে চোরাগুপ্তা হামলা করা। জামালখান, কোরবানিগঞ্জ, চন্দনপুরা এলাকায় বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গেরিলা আক্রমণ চালায় তারা।
‘প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ’ দিয়ে নগরের জামালখান পাওয়ার ফিডারের ট্রান্সফরমার জ্বালিয়ে দেওয়ার কৌশলের বর্ণনা দেন আবু রায়হান চৌধুরী। তিনি বলেন, একদিন প্লাস্টিক বিস্ফোরক নিয়ে হাজির হই জামালখান বৈদ্যুতিক পাওয়ার ফিডারের কাছে। একজন বিস্ফোরক নিয়ে উঠে গেলেন ট্রান্সফরমারে (কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে)। ডেটোনেটরের সাথে সেফটি ফিউজ কানেক্ট করে তিনি নেমে পড়েন। সেফটি ফিউজের তার ছিল দশ ফুট দূরত্বের। আমরা কিছুটা দূর থেকে চারপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ওই বন্ধু সেফটি ফিউজের তারে আগুন ধরিয়ে দেন। পাঁচ মিনিট পর ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। দ্রুত আমরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাই।’
১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ভোরবেলায় চট্টগ্রামের শহরের সব গেরিলা যোদ্ধা একসঙ্গে পাকবাহিনী, রাজাকার আল শামস ও আল বদরের ওপর ব্যাপক হামলা চালায় বলে জানান আবু রায়হান। তিনি বলেন, ‘সেদিনের মুহূর্মুহু গেরিলা হামলায় নাস্তানাবদু হয়ে যায় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। গেরিলা আক্রমণ দেখে তারা সেদিন হতাশ হয়ে পড়েছিল।’
২৩ নভেম্বর আবু রায়হানের সহযোদ্ধা আবুল মনসুরকে তার মাছুয়া ঝর্ণা লেইনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাবাহিনী। পরে তার আর খোঁজ মিলেনি। তাকে মেরে ফেলে হায়েনার দল। তার লাশ পাওয়া যায়নি। তিনি এলাকায় খুব পরিচিত ছিলেন। তিনি যে গেরিলাযোদ্ধা এ সংবাদ পাকবাহিনী পেয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আগের রাতে আবুল মনসুরসহ অন্যান্য সহযোদ্ধারা আবু রায়হানের বাসায় একসঙ্গে রাতের খাবার খান। এসময় আবুল মনসুরকে সতর্ক হয়ে চলাফেরার তাগিদ দিয়েছিলেন তারা।
নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা জানিয়ে আবু রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘২৬ নভেম্বর রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত) আলশামস বাহিনী ও পাক মিলিশিয়ারা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। সেদিন তারা এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমার মা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। আমার মা উর্দু ভালো জানতেন। এসময় তিনি পাক মিলিশিয়াদের সাথে তর্কাতর্কি করেন। তখন আলশামস বাহিনীর একজন আমার মাকে চিনে ফেলেন। পরে তারা আমাকে ধরে না নিয়ে ফিরে যান।’
চূড়ান্ত বিজয় তথা ১৬ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবু রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের খবরটি মূলত আমরা ১৫ ডিসেম্বর টের পাই। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে চলে যাই দেওয়ান বাজার এলাকায়। এসময় নাসের নামে ১০ বছরের এক শিশু আমাদের জানায় যে, দুটি বাসে করে রাজাকার আলবদর ও পাক মিলিশিয়ারা দেওয়ান বাজারের দিকে আসছে। এর কিছুক্ষণ পর পাক মিলিশিয়া ও আলবদর বাহিনী নিয়ে দুটি বাস আমাদের অতিক্রম করছিল। আমরা তাদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করি। পাক মিলিশিয়ারা পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এসময় ১০ বছরের শিশু নাসের পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। সে এখন পেশায় সাংবাদিক বলে জেনেছি।’
আবু রায়হানসহ আরও কয়েকজন গেরিলাযোদ্ধা ১৬ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কোতায়ালী থানার দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও জানান তিনি। মুক্তির জন্য আবু রায়হানসহ তার সহযোদ্ধা ১১জন জীবনবাজি রেখে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিলেও আমান উল্লাহ ও ডা. মাহফুজ ছাড়া বাকি ৯ জন আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। এক বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার কথা জানিয়ে আবু রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘এদেশ কখনো মুক্তি পেত না, যদি না স্বাধীনতাকামী মানুষ সহায়তা না করতেন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে আবু রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘আসলে অস্ত্র যুদ্ধ করে না। অস্ত্রের পেছনের মানুষ যুদ্ধ করে। আবার পেছনের মানুষ যুদ্ধ করে না। একটা আদর্শকে সামনে রেখে যুদ্ধ হয়ে থাকে। একজন গেরিলাযোদ্ধা ১০০ জন আর্মির সমান। গেরিলাযুদ্ধ হল কৌশল। আমরা পাকবাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীকে রাতে ঘুমাতে দিতাম না। রাতের পর রাত পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমাতে না পেরে কাহিল হয়ে পড়ত।’
বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এর আওতায় চট্টগ্রাম শহরে ‘কেসি-থ্রি’ এর সদস্য হিসেবে গেরিলাযুদ্ধ করেছেন আবু রায়হান চৌধুরী। তিনি গেরিলা যুদ্ধে অংশ আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্র থাকা অবস্থায়। তাঁর বাবার নাম সুলতানুল আলম চৌধুরী। পৈতৃক বাড়ি নগরের বহদ্দারবাড়ি। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে জামালখান নানার বাড়িতেই। তারা চার বোন, তিনভাই। ১৯৭০ সালে মেট্রিক পাশ করেছেন মুসলিম হাইস্কুল থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন আগ্রাবাদ কমার্স কলেজে। ১৯৭৭ সালে উচ্চ শিক্ষায় পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। সম্প্রতি এসেছেন দেশে।
আবু রায়হান চৌধুরী জানান, তার বড়ভাই প্রফেসর মাসুদুল আলম চৌধুরী। ছোটভাই আশরাফুল আলম চৌধুরী। তার নানা ডা. আতাউল হাকিম ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আবু রায়হান চৌধুরীর সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তার স্ত্রীর নাম আয়েশা কুদমী চৌধুরী। তার শ্বশুরের নাম তারেক মঈনুল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের ভাই।
পড়াশোনার পাশাপাশি ১৯৮০ সালে জার্মানির একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘দোভাষী’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আবু রায়হান। ১৯৮৪ সালে ‘বস’ নামে একটি কোম্পানিতে চাকরি পান। এ কোম্পানিতে ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালে ‘ডিপ্লম’ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ‘জনসন কন্ট্রোল’ নামে একটি কোম্পানিতে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি পান। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে তিনি পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে ‘প্রাইস ওয়াটার হাউস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি নেন।
১৯৯৯ সালের শেষের দিকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান শহরে। সেখানে ‘টিআরডব্লিউ’ নামে একটি কনসালটিং কোম্পানিতে সিনিয়র কনসালটিং পদে চাকুরি পান। ছিলেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। এরপর আবার ফিরে যান কানাডায়। কানাডায় থাকা অবস্থায় জার্মানভিত্তিক ‘ইন্ডিপেনডেন্ট কনসালটিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি চলে যান জার্মানিতে। ২০০৩ সালে জার্মানি থেকে ফেরৎ এসে কানাডায় ‘ওরপুল’ নামে একটি কোম্পানিতে সিনিয়র বিজনেস অ্যানালিস্ট পদে চাকরি নেন আবু রায়হান চৌধুরী।