শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু হাত ছুঁইয়ে আদর তো দিয়েছেনই, দলীয় পদও দিলেন তাঁকে

প্রকাশিতঃ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১০:০৯ অপরাহ্ন


শরীফুল রুকন : ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হাউজ টিউটর ছিলেন চট্টগ্রামের সন্তান ড. মাহফুজুল হক। সে সুবাদে ইকবাল হলে থেকে ওয়েস্টেন্ড হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন তাঁরই ছোটভাই এম. সামশুল হক।

সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে সে সময় ‘কার্জন হলে’-এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ড. মাহফুজুলকে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিকে মাল্যদান করার জন্য একটি ছেলে ও একটি মেয়ে শিশুর প্রয়োজন হয়। তখন সবার সম্মতিক্রমে ড. মাহফুজুলের ছোটভাই এম. সামশুল হক ও বিশিষ্ট নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখের বড় মেয়ে স্বপ্নাকে ঠিক করা হয়।

স্বপ্না মাল্যদান করলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান লম্বা হওয়ায় তাঁকে ফুলের মালা দিলেন সামশুল হক।

অনুষ্ঠানে ড. মাহফুজুল হক স্বাগত বক্তব্য রাখলেন। এরপর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়- শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য দেবেন। স্মৃতি রোমন্থন করে এম. সামশুল হক বলেন, ‘৫-৭ মিনিট বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার সময় দেখি মানুষের তুমুল করতালি। শুধু কার্জন হলে নয়, বাইরে রাস্তায় যে জনসমাগম হয়েছিল, সেখানেও দেখলাম তুমুল করতালি। বঙ্গবন্ধু যাওয়ার সময় মঞ্চের পাশে থাকা আমি আর স্বপ্নাকে গালে হাত দিয়ে একটু আদর করলেন। ছোটবেলার সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। হাত ছুঁইয়ে আদর দিয়েছিলেন- সেটা এখনও মনে আসছে, চোখে ভাসছে। এজন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।’

সেদিন শিশু সামশুল হককে বঙ্গবন্ধু আদর তো দিয়েছেনই, পরবর্তীতে তাঁকে আওয়ামী লীগের পদও দিয়েছেন। স্মৃতিচারণ করে এম. সামশুল হক বলেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামে জনসভা করতে এলেন বঙ্গবন্ধু, তারিখ সঠিক মনে নেই। ওই দিন রাতে চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা জানে আলম দোভাষ সাহেবের দোভাষ হাউজে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধু যখন সেখানে আসলেন, তখন লোকে লোকারণ্য পুরো ফিরিঙ্গিবাজার এলাকা। কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্তও মানুষের ভিড়।’

‘জানে আলম দোভাষের ছোটভাই বদিউল আলম দোভাষ ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে আমার বন্ধুত্ব। সেই সুবাদে বদিউল আলম দোভাষের সঙ্গে আমি জানে আলম দোভাষের বেডরুমে ঢুকে গেলাম। সেখানে দেখলাম, এমএ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, ডা. এমএ মান্নান ও আতাউর রহমান খান কায়সারসহ চট্টগ্রামের সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত আছেন।’

এম. সামশুল হক আরও বলেন, ‘আমরা দুইজন উঁকিঝুকি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু খেয়াল করলেন, দুইজন কমবয়সী ছেলে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? তখন হান্নান সাহেব বললেন, ওরা আমাদের জানে আলম দোভাষের ছোটভাই বদিউল আলম দোভাষ, আর সে হচ্ছে যুুক্তফ্রন্টের মাহফুজুল হক সাহেবের ছোটভাই। তখন বঙ্গবন্ধু জানতে চান, কোন মাহফুজ? হান্নান সাহেব বললেন, ১৯৬৪ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহফুজ।’

‘এ কথা শুনেই বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তখন ভয় পেয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু কাছে ডেকে বললেন, তুমি কী মাহফুজের আপন ভাই। আমি বললাম, জ্বী স্যার। এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমাকে তো সেরকম মনে হচ্ছে না। কিছু মনে করো না, তোমার ভাই তো খুব সুন্দর ছিল। আমি বললাম, স্যার আমি আমার বাবার মতো কালার পেয়েছি। বড় ভাই একটু ফর্সা ছিলেন। তখন দেখি বঙ্গবন্ধু মনে মনে কী যেন চিন্তা করলেন। এরপর বললেন, তুমি রাজনীতি করছো না? আমি বললাম, স্যার আমি রাজনীতি সরাসরি করি নাই। এ কথা বলার সময় আমার মুখ থেকে হান্নান সাহেব কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ও তো মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে গিয়েছিল।’

‘শুনেই বঙ্গবন্ধু বললেন, তাই নাকি। আমাকে আরও কাছে ডেকে পাশে বসালেন। এরপর বললেন, তোমাকে রাজনীতি করতে হবে। তুমি মাহফুজের ভাই। মাহফুজ ভালো বক্তা ছিল। আমার ভাইকে নিয়ে অনেক গুনগান করলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর জানে আলম দোভাষকে বললেন, তোমার ফিরিঙ্গিবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আনসার কই? জানে আলম দোভাষ জানালেন, ওনি তো অসুস্থ। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, আন্দোলনের সময় সেক্রেটারি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট, সেক্রেটারি থাকা দরকার। এক কাজ করো দোভাষ, তুমি ওকে (সামশুল হক) তোমার ইউনিটের দায়িত্ব দাও। সবাইকে বলবা, আমি বলছি। এরপর বঙ্গবন্ধু রাতে খেয়েদেয়ে চলে গেলেন। পরদিনই আমি জানলাম, দোভাষ সাহেব ফিরিঙ্গিবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভা ডাকলেন। মুরুব্বি সবাই গেলেন। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেব নামে পরিচিত। জানে আলম দোভাষ বললেন, শেখ সাহেব বলে গেছেন সামশুল হককে আমাদের সেক্রেটারি করতে। সেই থেকে আমার রাজনীতি শুরু।’ বলেন সামশুল হক।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় সামশুল হকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি পটিয়ার নিজ গ্রামে গিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে পটিয়ার জিরি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুইবার সহসভাপতি, ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন। ১৯৮৬ সালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৯১ সালে যুগ্ম সম্পাদক, ১৯৯৬ সালে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন হন। পরে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে ছিলেন এম. সামশুল হক।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম আর সিদ্দিকীর মাধ্যমে এ দেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেবা সংগঠন আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব সংগঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে এম. সামশুল হক এই সেবা সংগঠনে যোগ দিয়েও নিজেকে মানবসেবায় যুক্ত করেন। এম. শামসুল হক সেখানে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৭-৯৮ সালে।

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এম. সামশুল হক নিজের রাজনীতিতে আসার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৬৬ সালে লালদিঘীর মাঠে ৬ দফার সমর্থনে আয়োজিত জনসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানালেন ৬ দফার সমর্থনে হাত তুলতে। আমি এক হাত তুললাম। আমার এক বন্ধু মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী বললেন, দুই হাত তোল, ছয় দফার পক্ষে। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়।’

ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে যাওয়া এম. সামশুল হক বলেন, ‘১৯৬৩ সালে যখন কমার্স কলেজে ভর্তি হলাম, তৎকালীন কমার্স কলেজের ভিপি ছিলেন আবু সালেহ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আমলে এমএলএ ছিলেন। তখন নবীনবরণ অনুষ্ঠান করে আমাদের বরণ করে নেওয়া হয়। সে সময় অতি উৎসাহ সহকারে মানে জেলখাটা ছাত্রনেতা বলে মালা দিয়ে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল। সেখান থেকে আমি প্রেরণা লাভ করলাম, উৎসাহ পেলাম যে রাজনীতি অত্যন্ত সম্মানের জিনিস। আরও দেখেছি বড়ভাই মারা গেছেন ৬৪ সালে। তিনি মাত্র ৩৫ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি অল্প সময়ে যে ভালো কাজগুলো করেছেন, দেখলাম সেগুলো মানুষের মুখে মুখে। তখন আমি মনে মনে চিন্তা করলাম। আমিও রাজনীতি করবো, সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থাকবো। রাজনীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য- সেটি মনে-প্রাণে ধারণ করবো।’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে এম. সামশুল হক বলেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য। ১৯৬৪ সালে আমার বড়ভাই মারা যাওয়ার পর আমার মা-বাবা দুইজনই শয্যাশায়ী, অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৭১ সালের ১০ মে আমার বাবা মারা যান। মা-বাবা দুইজনকেই মৃত্যুশয্যায় রেখে ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে চট্টগ্রাম শহরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের জাল বুনেছিলাম।’

‘মৌলভী সৈয়দ আহমদ উলা পাশ করে মুসলিম হাই স্কুলে আমার সঙ্গে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। আমরা একই সঙ্গে মেট্রিক পাশ করেছি। মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে, আমি, আমার আরেক বন্ধু প্রয়াত মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বেপারী পাড়ার কমিশনার জালাল উদ্দিন, হারেস (এখনও জীবিত আছে), ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল ইসলাম (সিডিএর ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন), হারুন খানসহ আরও অনেকে ছিলেন, আমরা সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করেছি। চট্টগ্রামে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন, ওনাদেরকে আশ্রয় দেওয়া, ওনাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করা- এগুলোর দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম।’ যোগ করেন এম. সামশুল হক।

‘নৌ কমান্ডোদের কথা সবাই শুনেছেন, ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নৌ কমান্ডোদের সফল অপারেশন হয়েছিল। এতে ডা. শাহ আলম বীর উত্তম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ শাহ আলমকে আমার বাড়ি পটিয়ার কৈয়গ্রামে নিয়ে গিয়ে গ্রুপসহ আশ্রয় দিয়েছিলাম। ওনার অস্ত্রশস্ত্র ভুসির বস্তায় ভরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। আমার বাড়ি থেকে ৩ থেকে ৪ কিমি দূরে কর্ণফুলীর পাড়, সেখানে অপারেশন হয়েছিল। বহু অস্ত্রশস্ত্র আমরা পেয়েছিলাম। তৎকালীন পটিয়ার এমএলএ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং আমার নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইসহ আমাদের কৈয়গ্রাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে জনসভা করে অস্ত্রশস্ত্রগুলো জমা দিয়েছিলাম।’

এম. সামশুল হকের কথা, ‘শুনলে আশ্চর্য হবেন, চট্টগ্রামে যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে আমার কম-বেশি পরিচয় ছিল, নামও জানতেন। আমার দুর্ভাগ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লালবার্তা, মুক্তিবার্তায় নাম দিইনি। তখন অনেকেই আমাকে নাম দিতে বলেছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, নিজের মনের তাগিদে, দেশমাতৃকার টানে। ওই নাম দিয়ে কী হবে। সত্যি কথা বলতে, এখন কিন্তু খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার পাচ্ছেন, জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত হচ্ছেন, তাদেরকে স্যালুট দেয়া হচ্ছে, ভাতা দেয়া হচ্ছে।’