মোহাম্মদ রফিক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগে ধাপে ধাপে অনিয়ম হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। কাস্টমসে অবৈধ লেনদেনে ব্যবসায়ী ও কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মুখ্য সহায়তাকারীর দায়িত্ব পালন করফ আসছে কথিত ‘বদি আলম’ ও ‘ফালতু’। এরা মূলত দালাল। আর তারা মূলত কমিশনের ভিত্তিতে কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়ে কাজ করে। কাস্টমস হাউসে অটোমেশন চালুর পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিও বিদ্যামান থাকায় অবৈধ অর্থ আদায়ের সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, পণ্য আমদানিতে পণ্যমূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই ধরনের পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণ কাস্টম হাউসগুলোর ব্যাপক প্রচলিত অনিয়ম। উচ্চকর আরোপযোগ্য পণ্যগুলোর ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে কম এবং নি¤œহারে কর আরোপযোগ্য পণ্যের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে বেশি দেখানো হয়। এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুসারে শুল্কায়ন করে ওই সব পণ্য খালাস করা হয়।
রেয়াতসংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন বা এসআরওর শর্ত অমান্য এবং আমদানিনীতি, পরিবেশনীতি, অন্য বিধিবিধান ও নীতিমালার শর্ত/নির্দেশনা ভঙ্গ করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়। কাস্টমস আইন-১৯৬৯-এর বিধান অনুসারে আমদানি করা পণ্য এবং খালাস করা পণ্যের চালান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায়ই সমন্বয় করা হয় না। আমদানি করা মালামাল নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খালাস না হলে ওই সব মালামাল নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে তা হয় না।
বিশ্বব্যাপী কাস্টমসের জন্য অটোমেটেড পদ্ধতি চালু থাকলেও বাংলাদেশে কাস্টমস বিভাগ সার্বিকভাবে এখনো এটি চালু করতে পারেনি। এ কারণে কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াগুলো এখনো অস্বচ্ছ এবং সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। এ কারণে তা দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আমদানিসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো আমদানিকারক বা এজেন্সিগুলো কর্তৃক প্রায়ই সঠিকভাবে প্রস্তুত করে না। এ কারণে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
কাস্টম হাউসের বন্ডগুলোর (শতভাগ রপ্তানি বন্ড/চামড়া খাতের বন্ড/আমদানি বিকল্প বন্ড/কূটনৈতিক বন্ড শিপ/স্টোরস বন্ড ইত্যাদি) ব্যবস্থাপনা মানসম্মত নয়। এতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভোগান্তি, কর ফাঁকি, দুর্নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্র তৈরি হয়।সমজাতীয় বা প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ট্যারিফ কাঠামোর কারণে কাস্টমস সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে এবং দুর্নীতি বাড়ছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের অপ্রতুলতা (অপর্যাপ্ত ওজন নির্ধারক/স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা, ফর্ক লিফট, সমন্বিত স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন), কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ তৎপরতা, গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পণ্য খালাসের নিরীক্ষা সম্পাদনে অনীহা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।
অস্থায়ী আমদানি বিধির আওতায় বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা গাড়িসহ অন্য পণ্যাদি, বিলম্বিত শুল্ক ব্যবস্থার আওতায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানি করা মালামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং এ প্রক্রিয়ায় আমদানি করা কোনো কোনো মালামাল পুনঃ রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়।
ভ্যাট আইন ও বিধিমালায় অসংগতি, যথা: বিবিধ রেয়াত, মূল্য ও ট্যারিফের নি¤œ ভিত্তি আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিদ্যমান ভ্যাট পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো এখনো সনাতন পদ্ধতির। এ ধরনের পদ্ধতি উত্তম চর্চাভিত্তিক ভ্যাট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অনেক সময় রেয়াত নেওয়ার বিপরীতে সঠিক দলিলাদি থাকে না।
পণ্যের শুল্কায়ন চূড়ান্তভাবে সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট আইনে সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক পণ্য ছাড় দেওয়ার বিধান রয়েছে। ফলে, শুল্ক কর্তৃপক্ষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য চালান সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক ছাড় দেয়। কিন্তু পরে অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত শুল্কায়ন করা হয় না। এভাবে দেশের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়।
কাস্টম হাউসগুলোয় ওজন পরিমাপক যন্ত্র, স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা প্রতিনিয়তই অকেজো থাকে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অকেজো করে রাখা হয় মর্মে অভিযোগ আসে। এই সুযোগে অনেক উচ্চ শুল্ক হারের পণ্য কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য খালাস করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকিসহ আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম বিনষ্ট হয় এবং দুর্নীতি হয়। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সঠিকভাবে তদারকি ও নজরদারি না করার ফলে দুর্নীতিবাজ শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টেদের অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ফলে, দেশের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি সুবিধাভোগী দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়।
বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত অডিট সম্পন্ন করা হয় না। বন্ড লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়নে দুর্নীতি হয়। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্যতা বাড়িয়ে বা মূল্য কমিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোতে শুল্কমুক্ত মদ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি করে তা ভুয়া প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামে বিতরণ দেখিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। এ কারণে দেশের রাজস্ব ক্ষতি হয়। একইভাবে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রকৃত প্রাপ্যতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি প্রাপ্যতা দেখানো হয় এবং বেশি প্রাপ্যতাকে ধরেই লাইসেন্সে নবায়ন করা হয়।
আমদানি–রপ্তানিতে কিছু অংশ বাদে বন্ড ওয়্যারহাউস কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি করা হয়। নতুন লাইসেন্স ছাড়া আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সমন্বয় কিংবা অডিট প্রক্রিয়াটি অত্যধিক কাগুজে দলিলনির্ভর, যার অনেক তথ্য যাচাই–বাছাই করার অবকাশ থাকে। ফলে, এ পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন অডিট করা প্রায় অসম্ভব। যার সুযোগ বন্ড প্রতিষ্ঠান এবং অসাধু কর্মকর্তারা গ্রহণ করে।
বর্তমান মূসকব্যবস্থায় আদর্শ হারে ১৫ শতাংশ হারে মূসক, ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত মূল্যে মূসক পরিশোধের বিধান রয়েছে। ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত ভিত্তি মূল্যে পণ্য/সেবা প্রদানকারীর রেয়াত গ্রহণ করতে না পারায় তারা কাঁচামালের ওপর ভ্যাট পরিশোধ হয়েছে কি না, তা যাচাই করে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কাঁচামাল ক্রয় রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি না করে মূসক ফাঁকি দিয়ে থাকে।
উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয়ের ফলে ভ্যাটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত শ্রম দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, তাদের লক্ষ্যমাত্রা উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হওয়ায় তারা ভ্যাটের পরিধি বাড়িয়ে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন না করে দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে যায়। এ ছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ যোগসাজশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালান (মূসক-১১) জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহককে প্রতারিত করার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়। শুল্ক ও ভ্যাট অনুবিভাগের শুল্ক ও ভ্যাট আদায়সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকা এবং নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতিতে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইনের অভাবে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ঘিরে ‘ফালতু’দের দাপুটে বিচরণ চলছেই। সরকারি স্পর্শকাতর এ ভবনের বিভিন্ন দপ্তরে বহিরাগত এসব কর্মী আবারও সদর্পে ফিরে এসেছেন। সম্প্রতি অভিযান চালানোর পর ‘ফালতু’রা কিছুটা আত্মগোপনে চলে গেলেও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস, কাস্টমস এক্সসাইজ এন্ড ভ্যাট দপ্তরে তারা বেশ দাপটের সঙ্গেই কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবৈধ পণ্য পাচারে গোপন কাগজপত্র নিজেদের হেফাজতে রাখে এ ফালতুরা। একশ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তা তাদের ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপরীতে ফালতুরাও পান মোটা অঙ্কের টাকা। তারা প্রত্যেকেই বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের অত্যাচারে ব্যবসায়ীরাও অতিষ্ঠ।
মূলত ‘দুর্নীতিবাজ’ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তারা। সেকশন টু সেকশনে ঘুর ঘুর করেন। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকিসহ বিভিন্ন অজুহাতে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। সম্প্রতি কাস্টমস হাউস ও কাস্টমস এক্সসাইজ ভ্যাট অফিস থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ‘ফালতু’ বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা আবার ফিরে এসে ঘিচ ঘিচ করছে কাস্টম হাউসে। এরা ‘বদি আলম’ হিসেবেও পরিচিত।
অভিযোগ আছে, এ ফালতুদের ‘দুর্নীতিবাজ’ কাস্টমস কর্মকর্তারা অবৈধ কার্যকলাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফালতুরা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন। তারা দাপটের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে কাজ করে থাকেন। কাস্টমস কর্মকর্তারাও এদের ওপর নির্ভরশীল। সব অবৈধ লেনদেন হয় এদের মাধ্যমে। তারা কাউকেই পাত্তা দেন না। তাদের আছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
নগরের সদরঘাট কাস্টমস এক্সসাইজ এন্ড ভ্যাট অফিসে এরকমই এক সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন বজলুর রহমান। তার বাড়ি ভোলার ধুনিয়া গ্রামে। বজলুর লোকজনকে পরিচয় দেন কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে। সদরঘাট চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের আগ্রাবাদ বিভাগীয় দপ্তরে চেয়ারে বসে নিয়মিত করেন তিনি। অভিযোগ উঠায় তাকে ওই অফিস থেকে কিছুদিন আগে বের দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন।
বজলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যবসায়ি অফিসে ডেকে নিয়ে ভ্যাট ফাঁকির ফাঁদ পাতেন। আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। মূলত ব্যবসায়িদের ফাঁদে ফেলে মোটা অংকের ঘুষ আদায় করাই তার কাজ। তার নিয়ন্ত্রণে আছে ‘ফালতুদের’ বড় একটি সিন্ডিকেট। সম্প্রতি দপ্তরে বসে একা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা আদায়ের একটি ভিডিও চিত্র হাতে এসেছে একুশে পত্রিকার কাছে।
এই ভিডিও সম্পর্কে বজলুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সেটা ছিল ট্রেজারি চালানের টাকা। আমি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ট্রেজারিতে জমা দিই।’ গ্রাহকই ট্রেজারি চালানের টাকা ব্যাংকে জমা দেবেন আপনি কেন টাকা নেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে বজলুর রহমান বলেন, ‘আল্লাহর কসম করে বলি ভাই আপনি তদন্ত করে দেখেন।’
অভিযোগ আছে, বজলুর অনৈতিক কর্মকা-ে সহযোগিতা করতেন একই দপ্তরের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন আজ শুক্রবার দুপুরে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বজলুর রহমান নামে এক ‘ফালতু’ আমাদের অফিসে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন। বজলুরকে সহযোগিতা করার অভিযোগ সঠিক নয়।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের ইপিজেড থানাধীন কলসিরদীঘির মুখ, হালিশহর বড়পোল ও জেলার পটিয়ার শান্তিরহাট এলাকায় বজলুর মালিকানাধীন ওয়ালটনের ৭টি শোরুম আছে। ভোলার ধনিয়ার নিজ গ্রামে এবং ঢাকার মিরপুরে গড়ে তুলেছেন দুটি বহুতল ভবন তিনি। এ প্রসঙ্গে বজলুর রহমান বলেন, ‘ভাই মানুষের ক্ষতি করা সহজ। আমাকে তো কাস্টমস এক্সসাইজ ভ্যাট অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এখন আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। ৭টি ওয়ালটন শো-রুমের মালিক আমি নই। খবরটি মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।’
গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম কাস্টস হাউসে গিয়ে দেখা গেছে, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনের বিভিন্ন দপ্তরে অন্তত শতাধিক ‘ফালতু’ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। তারা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সেবা দেয়ার নামে কাস্টম হাউস এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ফালতুদের নিয়ন্ত্রণে থাকে কাস্টমস কর্মকর্তাদের গোপন ফাইল। তাদের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তারা। শুধু চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস নয়, দেশের সব কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে এসব ‘ফালতুদের’ দাপুটে বিচরণ রয়েছে বলে জানা গেছে।
সারাদেশে ফালতু’র সংখ্যা প্রায় এক হাজার। ফালতুদের ভাল চোখে দেখেন না কাস্টমস হাউসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা। ফালতুদের ‘বিদায়’ করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট তৃতীয় শ্রেণির নির্বাহী কর্মচারী সমিতি (বাকাস)।
তবে ‘ফালতু’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল হয়নি বলে অভিযোগ করে বাকাসের এক নেতা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একুশে পত্রিকাকে বলেন, সারাদেশের কাস্টমস দপ্তরগুলোতে ‘ফালতুরা’ দাপুটের সঙ্গে কাজ করছেন। মাঝেমধ্যে কর্তৃপক্ষ অভিযান চালালেও কিছুদিন পর কৌশলে তারা আবার বিভিন্ন দপ্তরে ঢুকে পড়েন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিসে ফালতুদের একাধিক সিন্ডিকেট আছে। তারা টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়িদের ভ্যাট ফাঁকির মামলার ফাইল ‘গায়েব’ করে দেন। অভিযোগ আছে, কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার সহযোগিতায় আলোচ্য বজলুর রহমান ছাড়াও আকমল, নিজাম, বরকত, সুবিমল, অরুন শীল, আজমত উল্লাহ, কামাল উদ্দীন, সোহেল, এমদাদসহ শতাধিক ‘ফালতু’ বিচরণ চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস এবং এক্সসাইজ এন্ড ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে।
ফালতুরা বিভিন্ন ব্যবসায়িদের হিসাব সংক্রান্ত খাতাপত্র এবং ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্টার বিনা রশিদে জব্দ করে অফিসে নিয়ে যান। পরে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অফিসে ডেকে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করেন তারা। ঘুষ দিতে রাজি না হলে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের দিকে কাস্টম হাউস থেকে ‘ফালতু’দের বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সেসময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে ১৪২ জন ফালতুকে বিদায় করে কর্তৃপক্ষ। ফলে কয়েকবছর আমদানি-রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরা ‘ফালতু’দের সহায়তা ছাড়াই শুল্কায়ন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।
অভিযোগ রয়েছে, শুল্ক কর্মকর্তাদের একাংশ নিজেরা সরাসরি ঘুষের অর্থ না নিয়ে এসব বদি আলম বা ‘ফালতুুদের মাধ্যমে নেয়। কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে এ বহিরাগতদের দাপুটে বিচরণ রয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে বর্তমানে এদের সংখ্যা শতাধিক হবে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সসাইজ এন্ড ভ্যাট কমিশনার আকবর হোসেন বলেন, ‘আমাদের দপ্তরে কোন কর্মকর্তা বহিরাগত কর্মী বা ‘ফালতু’ দ্বারা অবৈধ কোন কর্মকা-ের অভিযোগ পেলে ছাড় দেওয়া হবে না।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে বহিরাগত কেউ কাজ করার অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে কাস্টমসে দুর্নীতি প্রতিরোধে ২০১৮ সালে বেশ কিছু সুপারিশমালা দিয়েছিল দুদক। সুপারিশগুলো হচ্ছে- রাজস্ব গুরুত্বসম্পন্ন এবং উচ্চ ট্যারিফ হারযুক্ত বাণিজ্যিক পণ্য যাদের ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার প্রবণতা রয়েছে—এমন পণ্যসমূহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টম অনুবিভাগের সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ও অংশীজনদের সহযোগিতায় যথাশিগগির সম্ভব চিহ্নিত করে যথাযথ ঘোষণার তথ্য/বিবরণ নির্ধারণ করা যেতে পারে। ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট প্রস্তুত এবং বিল অব এন্ট্রি প্রণয়নের সময় যথাযথ ঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
দুদক বলছে, আমদানি–রপ্তানিতে যথাযথ ঘোষণাভুক্ত উপাত্তগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনলাইন সিস্টেম এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণাকেন্দ্রিক দুর্নীতি কমে যাবে। অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়নপ্রবণতা রোধে ‘ন্যূনতম মূল্য’সংক্রান্ত বিদ্যমান প্রজ্ঞাপন বাতিল যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ঘোষিত পণ্যের পরিমাণ/মূল্য এবং বাস্তব পরিমাণ/মূল্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া গেলে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
দুদকের সুপারিশমালায় বলা হয়, শুল্ক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষেত্রে অবারিত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রয়েছে। ওই ক্ষমতা পরীক্ষা করে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এরূপ কাজের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করা এবং নির্ধারিত সময়ে কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পর আগে এলে আগে মূল্যায়ন ভিত্তিতে মূল্যায়ন শেষ করতে হবে। মূল্যায়ন কার্যক্রম থেকে কোনো বিল অব এন্ট্রিকে সাইড লাইনে পাঠাতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা জরুরি।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বন্ডের ভেতরে ও বাইরে এবং পাসবইয়ের তথ্য ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ এবং এসব তথ্যে আলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অডিট কার্যক্রম সম্পাদন করা উচিত। পণ্য আমদানির নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পণ্য খালাসের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বিধান অনুযায়ী ওই সব মালামাল নিলামের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার মেশিন স্থাপন নিশ্চিত করা এবং আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমার বিষয়টি নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। পণ্য আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর প্রভৃতি মিলে তৈরি ট্যারিফ পণ্যের মিথ্যা ঘোষণাকে প্রভাবিত করে বিধায় তা যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে শূন্য, ৫, ১০, ২৫ শতাংশ শুল্ককাঠামোতে যেসব পণ্য আছে, তাও যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন।
দুদকের সুপারিশে বলা হয়, কাস্টমস বিভাগের সোর্স মানি ব্যয় এবং বিভিন্ন উদ্দীপনা পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সব দপ্তরে একই নীতি অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। সোর্স মানি ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি ইউনিটে রেজিস্ট্রার সংরক্ষণসহ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে আর্থিক অব্যবস্থাপনা দুর্নীতির একটি বড় উৎস। এটি রোধকল্পে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা মোতাবেক স্বচ্ছতার সঙ্গে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এনবিআরের আওতাধীন কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেটসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেক সময় দুর্নীতি হয়। রাজস্ব কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদায়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। সৎ, মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেটসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়ন করা উচিত।
কাস্টমস ও ভ্যাট উভয় বিভাগের গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ই-নথি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে দ্রুত নথি নিষ্পত্তির পাশাপাশি যেকোনো প্রয়োজনে ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে নথির অবস্থান জানা যাবে।
প্রতিটি কাস্টম হাউসের চোরাচালান দমন বিভাগ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কাস্টমসসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। এনবিআর প্রদর্শিত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের সঙ্গে অডিট অধিদপ্তর প্রদর্শিত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের পার্থক্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমদানিকারকদের একটি ডেটাবেইস তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে আমদানিকারকদের বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এর ফলে শুল্কায়ন শেষ হলে (শুল্ক-করাদির পরিমাণ) আমদানিকারক ই-মেইল, এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারবেন।
যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম অটোমেটেড সম্পাদনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেকেন্ড অ্যাপ্রেইজমেন্ট পুরোপুরি বন্ধ করে পিসিএ বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। হাতে হাতে কিংবা সশরীরে উপস্থিত হয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে অনলাইন পদ্ধতি এবং কাস্টমসের হলরুমে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করলে দুর্নীতি কমে যাবে। কোনো চালান যে কর্মকর্তা বন্ধ করবেন, তা ওই একই কর্মকর্তা কর্তৃক খোলার বিধান পরিবর্তন করে খোলার ক্ষমতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
বন্ড প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার বন্ধ করতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করার বিকল্প নেই। এর ফলে বন্ডসংক্রান্ত তথ্যে সহজে প্রবেশ করা যাবে। সব তথ্যের ভান্ডার থাকলে এবং সেখানে সহজে প্রবেশাধিকার থাকলে দুর্নীতি কমবে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট তদারকি করতে হবে। মানসম্পন্ন অডিট নিশ্চিত করতে পারলে বন্ড প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার কমবে, যার ফলে অসাধু কর্মকর্তাদের অবৈধ কর্মকা- কমানো সম্ভব হবে।
দুদকের সুপারিশমালায় উল্লেখ করা হয়, নতুন বন্ড লাইসেন্স দেওয়ার সময় এবং নবায়নে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করা যেতে পারে। বন্ড ব্যবস্থায় আমদানি করা পণ্য যথাযথভাবে বন্ড গুদামে প্রবেশ এবং ইন টু বন্ড হয়েছে কি না, সে বিষয়ে বন্ড কর্মকর্তা মাসিক প্রতিবেদন দেবেন। সব ক্ষেত্রে আদর্শ হারে মূসক প্রযোজ্য হবে এবং রেয়াত গ্রহণের সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ট্যারিফ বা সংকুচিত ভিত্তিমূল্য থাকবে না। প্রয়োজনে নিট প্রদত্ত টাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ রিফান্ড দেওয়া যাবে-এমন বিধান রাখা যেতে পারে।
যদিও দুদকের এসব সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। অনিয়ম ও জটিলতা কমাতে গত বছরের ২৭ অক্টোবর ই-অকশন (অনলাইন নিলাম) চালু করেও পিছু হটল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। উদ্বোধনের পর একটি নিলাম অনলাইনে অনুষ্ঠিত হলেও ওয়েবসাইটে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় এরপর থেকে আবারও পুরোনো পদ্ধতিতেই নিলাম করে যাচ্ছে কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। ফলে ই-অকশনের সুবিধা এখনই পাচ্ছেন না নিলামে অংশগ্রহণকারীরা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার (নিলাম) ফয়সাল বিন রহমান বলেন, অনলাইন নিলামের জন্য কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। ইতিমধ্যে সেই প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব অনলাইন নিলামে ফেরার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, অনলাইন নিলামে অংশগ্রহণকারীরা পণ্যের দর, তালিকা, ছবি দেখতে পাবেন নিজ কর্মস্থলে বসে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পূরণ করে ঘরে বসেই নিলামে অংশ নেয়া যাবে। দেখতে পাবেন কোন ক্যাটালগের সর্বোচ্চ বিডার বা দরদাতা কে হয়েছেন। এতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই অল্প সময়ে নিলামকাজ সম্পন্ন হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার নিলামযোগ্য পণ্য পড়ে আছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, নিলাম প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে নিলামযোগ্য বিপুল পরিমাণ পণ্য পড়ে রয়েছে। এতে আমদানি ও রপ্তানি কনটেইনার রাখতে প্রায়ই স্থান সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণ ও সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই মিথ্যা ঘোষণায় আসছে শত শত কোটি টাকার পণ্য। একের পর এক আটকা পড়েছে মিথ্যা ঘোষণার চালান। গত ডিসেম্বর মাসে মিথ্যা ঘোষণায় আনা অন্তত চারটি চালান আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এসব চালানে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কাস্টমসে ঘুষ বাণিজ্যের ফলে সরকারের প্রাপ্য হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন অসাধু আমদানিকারকরা। কারণ কাস্টমস যেখানেই আপস করে সেখানেই দুর্নীতি হয়। কাস্টম দুর্নীতি না করলে কারো সাধ্য নেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করার। এসব অনিয়মের সঙ্গে কাস্টমসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গত ২৯ ডিসেম্বর ভুয়া কাগজ দেখিয়ে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক এপ্রেইজার (আমদানি শাখা) বর্তমান রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) মো. সালাউদ্দিন তালুকদার, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক সহকারি রেভিনিউ কর্মকর্তা (রপ্তানি শাখা) মো. মফিজুল্লাহসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে ব্যাংকের প্রায় ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলছেন, একটি চক্র পণ্য আমদানিতে মূল্যের অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন, পরিমাণ, গুণগতমান প্রভৃতিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন রিজভী বলেন, বর্তমানে কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরদার করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের অনিয়মের দায়ে আমদানিকারকসহ সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া জরিমানা বাড়ানোর পর মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি কমেছে। এরপরও যারা এসব অনিয়মের সাথে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।