সেন্টমার্টিনে সরকারি জমিতে ইউএনও’র রিসোর্ট!


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : দেশের একমাত্র প্রবালস দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন পরিবেশ সংকটাপন্ন ও ঝুঁকিতে রয়েছে এমন কথা বার বার বলা হলেও দ্বীপরক্ষায় এ পর্যন্ত সরকারের নেওয়া কোনও উদ্যোগ বা নির্দেশনা বাস্তায়ন করতে পারেনি প্রশাসন। এমনকি দ্বীপরক্ষায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালের ১৩ দফা নির্দেশনাকেও কৌশলে এড়িয়ে উল্টোপথে হাঁটছে প্রশাসন।

ফলে সেন্টমার্টিনে আগের মতোই চলছে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ কাজ। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পরিবর্তে লোক দেখানো’ কয়েকটি ঝুপড়ি উচ্ছেদ করে উল্টো সর্বত্র সমালোনার মুখে পড়েছে প্রশাসন।

পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে, টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজেই সেখানে সরকারি খাস জমি দখল করে রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। যদিও ইউএনও পারভেজ চৌধুরীর দাবি, ভবিষ্যৎ অভিযানের কথা মাথায় রেখে কাঠ-বাঁশের বিশ্রামঘর ও টয়য়েট নির্মাণ করা হচ্ছে।

গঅত শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সেন্টমার্টিনের চিহ্নিত ও আলোচিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য ডাকডোল পিটিয়ে অভিযানে নামে প্রশাসন। অভিযানে নেতৃত্ব দেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী।

ওইদিন বিকেলে সাংবাদিকদের জানানো হয়, দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। পরদিন শনিবার দেশের প্রায় সব মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের সংবাদও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা! এতগুলো স্থাপনা উচ্ছেদের কথা বলা হলেও যার কোনও অস্থিত্বই মিলছে না!

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের দাবি, সেন্টমার্টিনের উত্তর পূর্ব, পশ্চিম ও কোনাপাড়া সৈকত দখল করে বসানো হয়েছে আড়াই শতাধিক অবৈধ দোকানপাট। এগুলো বসিয়েছে প্রভাবশালীরা। কিন্তু ওইদিন অভিযানে উচ্ছেদ করা হয়েছে অসহায় স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী ৬ ঝুপড়ি দোকান ও ৩টি ফিশারিজ। এ কারণে এই উচ্ছেদ অভিযানকে প্রভাবশালীদের রক্ষায় আই-ওয়াশ’ ও ‘আয়নাবাজি’ হিসেবেও অবহিত করেছে স্থানীয়রা।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, শুক্রবার অভিযানে অসহায় হিসেবে পরিচিত স্থানীয়দের কয়েকটি দোকান ও কয়েকটি মাছের ফিশারিজ উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রভাবশালীদের যেসব স্থাপনা রয়েছে এবং নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেনি প্রশাসন। অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।

উচ্ছেদ অভিযানের সমালোচনা করে টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী তার ফেসবুকে লিখেছেন, সেন্টমার্টিন এ উচ্ছেদ! প্রশাসন, প্রভাবশালী ও জামায়াতী, স্থাপনাকারীদের ত্রিমুখী পৃষ্ঠ হচ্ছে গরীব দ্বীপবাসী? বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব!

উচ্ছেদ হওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ সেন্টমার্টিন বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণাধীন অবৈধ স্থাপনা অক্ষত রেখে লোক দেখানো তাদের ছোট ছোট টং ত্রিপলের দোকান, বাঁশের বেড়ার ভাসমান স্থাপনা উচ্ছেদগুলোই উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। সেখানেও প্রভাবশালীদের একটি স্থাপনা উচ্ছেদ করা করা হয়নি। অন্যদিকে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর কাজ চলছে পুরোদমে।

মিজান নামে অপর এক ঝুপড়ি চায়ের দোকানদার অভিযোগ করেন, সেন্টমার্টিনে বড় রিসোর্ট নির্মাণ চলছে আজও। অথচ তাদের স্থাপনা না ভেঙে অসহায় গরীব লোকদের দোকানপাট ভেঙে দিচ্ছে। এ সময় তিনি প্রশ্ন তুলেন উচ্ছেদ অভিযান কি শুধু গরীব এবং ছোট স্থাপনার বিরুদ্ধে, নাকি সবার জন্য।

এসব ভুক্তভোগি ও স্থানীয়দের দাবি, সেন্টমার্টিনে জেটির উত্তর পাশে ব্লু মেরিন রিসোর্ট এর দক্ষিণ পাশে সরকারি খাস জমি দখল করে টেকনাফ ইউএনও নিজেই অবৈধভাবে একটি রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। সেখানে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকরাও স্বীকার করেছেন। নির্মাণাধীন স্থাপনা অন্যদিকে চিহ্নিত ২৫টির মতো নির্মাণাধীন ভবন না উচ্ছেদ না করে উচ্ছেদ দেখাতে গরীবের ক্ষুদ্র স্থাপনাগুলোই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল এর প্রধান নির্বাহী রাসেদুল মজিদ বলেন, সেন্টমার্টিনে উচ্ছেদ অভিযানের নামে আইওয়াশ চলছে। প্রভাবশালীদের নির্মাণাধীন ভবনগুলোর ঠিকই কাজ চলমান রয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে সেখানে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন রিসোর্ট নির্মাণ করছেন। ওই রিসোর্ট নির্মাণে দখলে রয়েছে সরকারি জমিও। এই রিসোর্ট উচ্ছেদ করতে পারলে বোঝা যাবে প্রশাসন আসলে কতটা আন্তরিক।

ব্যক্তিগত রিসোর্ট নির্মাণের অভিযোগ প্রসঙ্গে টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, আমি কোনও রিসোর্ট নির্মাণ করছি না। সেন্টমার্টিনে অভিযানের সুবিধার্থে কাঠ-বাঁশের বিশ্রামঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। কাঠ-বাঁশের বিশ্রামঘরের পাশে নির্মাণাধীন ভবনটি টয়লেট দাবি করে তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে সেটাও ভেঙে ফেলা যাবে।

মাত্র ৯টি ঝুপড়ি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও গণমাধ্যম অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের তথ্য প্রসঙ্গে টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, হয়তো নিউজটা গণমাধ্যম ওইভাবে ছাপিয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া লোকজনকে অন্য কোনো জায়গায় পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

চিহ্নিত ও আলোচিত নির্মাণাধীন ভবন উচ্ছেদ না করার বিষয়ে ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, প্রস্তুতির একটা বিষয় রয়েছে। আগামীতে ধীরে ধীরে সব উচ্ছেদ করা হবে।

নির্মাণাধীন ভবনগুলো উচ্ছেদ না করা ও খাস জমি দখল করে টেকনাফ ইউনএও ব্যক্তিমালিকানাধীন রিসোর্ট নির্মাণ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, সেন্টমার্টিনে অভিযান করতে গেলে বসার –বিশ্রাম নেওয়ার কোনো স্থান না থাকায় কাঠ এবং বাঁশ দিযে অস্থায়ী বিশ্রামাগার দুই একটা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। তার পাশে কোনও দালান নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা এবং সেটা টেকনাফ ইউএনও’র কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য আরো যারা সংশ্লিষ্ট সংস্থা রয়েছে আমরা সমন্বয় করে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবো।