শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘর সাজিয়ে রাখার জন্য হলেও বই কিনুন!

প্রকাশিতঃ ৭ মার্চ ২০২২ | ৬:২৯ অপরাহ্ন


শান্তনু চৌধুরী : অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতিবছর চার থেকে সাড়ে চার হাজার বই প্রকাশ হয়। এর বেশিরভাগেরই খবর আসলে পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। আবার কিছু কিছু বইয়ের হয়তো যিনিই লেখক তিনিই পাঠক। এর মধ্যে আবার অনেক ভালো বইও প্রচারের অভাবে হয়তো হারিয়ে যায়। আবার এটাও ঠিক যে, বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য মানদণ্ড তৈরিতেও আগ্রহী নন এদেশের প্রকাশক। এছাড়া আপনি যাকে আপাত মানহীন বলছেন সেটিও হয়তো একসময় সাহিত্যের ভাণ্ডারে রতন হিসেবে পরিচিতি পে পারে। হুট করে দুটি উদাহরণের কথা মনে পড়লো।

জীবনানন্দ দাশকে কিন্তু তাঁর সময়ে কবি বলেই স্বীকার করা হতো না। তাই তিনি সেই সময়ে প্রতিষ্ঠাও পাননি। তাঁর কবিতাও কোথাও ছাপা হতো না সেভাবে। এ নিয়ে যে তাঁর মধ্যে হতাশা ছিল না তা নয়। কবি হিসেবে তাঁকে যে অসন্মান করা হতো তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর বুদ্ধদেব বসু গিয়েছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে, গিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের ওপরে স্মরণসংখ্যা পত্রিকা বের করব, লেখা দেবেন।’

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘যিনি কবি নন, তাঁর ওপরে স্মরণসংখ্যা বের করার দরকার কী!’ আবার জে কে রোলিং এর হ্যারি পটারের কথাই যদি বলি। বাইশ জন প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তাঁর বই যখন প্রকাশ হলো, বাকিটাতো ইতিহাস। তাই বই প্রকাশ সে ভালো হোক মন্দ হোক খারাপ কিছু মনে হয় না। সেটা সমাজের অন্তত চুরি, ডাকাতি খুন বা দুর্নীতির চেয়েতো ভালো। তবে পাঠের অভ্যাসটা গড়ে তোলাও জরুরি। দিনে অন্তত এক পাতা বই পড়ুন, নিদেনপক্ষে এক লাইন পড়ুন। কারণ মনোজগতকে সমৃদ্ধ করার জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। পুরো বিশ্বে কে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন, সেটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব না। তবে ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন সেখানকার ৯১ বছর বয়সী নারী লুইজ ব্রাউন। এক হাজার নয়, দুই হাজার নয়, পুরো ২৫ হাজার বই পড়েছেন এই নারী। তা-ও কেবল গ্রন্থাগার থেকে নিয়েই। আর এর বাইরে কতগুলো বই পড়া হয়েছে, সেটা তার জানা নেই সঠিক।

শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৪৬ সালে। এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ডজনখানেক করে বই পড়ে শেষ করেছেন লুইজ। আর কখনো তার বইগুলো ফিরিয়ে দিতে একটুও দেরি হয়নি। ঠিক সময় আর নিয়ম মেনেই বই শেষ করেছেন এই নারী। পড়ার ক্ষেত্রে সব সময় একটু বড় অক্ষরের বইগুলোকেই বেছে নিয়েছেন লুইজ। বই পড়া শুরু হয় তার মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে। এর পর থেকে আর পড়াশোনা থামাননি তিনি। পড়াশোনার ক্ষেত্রে খুব একটা বাছবিচার নেই লুইজের। তবে পারিবারিক কাহিনি এবং ঐতিহাসিক বই পড়তে বেশি ভালো লাগে বলে জানান লুইজ। পাশাপাশি হালকা মেজাজের, যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই পড়ে থাকেন তিনি। লুইজের জন্ম ওয়েলসে। সেখানে ক্যাসল ডগলাস নামক একটি গ্রন্থাগার থেকে নিয়মিত বই পড়া শুরু করেন তিনি। তবে সেটা খুব কম সময়ের জন্য। কিছুদিন বাদেই বিয়ে হয়ে যায় তার। আর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য অন্যত্র বদলি হন তিনি।

লুইজ ব্রাউনের মেয়ে লুইজ প্রাইড মায়ের ব্যাপারে বলতে গিয়ে জানান, সারাদিন এত বই পড়ার পরও মা অনেক বেশি পড়তে চান। ফলে খবরের কাগজ পড়তে এবং টেলিভিশন দেখতেও দেখা যায় তাকে। আমাদের দেশে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেভাবে বই পৌঁছে দিয়ে পাঠক গড়ে তোলার অবদান রাখছে তা প্রশংসার যোগ্য। একটি বিষয় বেশ কয়েকবছর ধরে শোনা যাচ্ছে। সেটি হলো পুরস্কার হিসেবে বা উপহার হিসেবে যেন বই দেয়া হয়। থালা বাসন বা প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রীর চেয়ে বই অনেক উপকারী। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি লেখক আনিসুল হকের একটি লেখার অংশ বিশেষ তুলে ধরছি। ‘ক্রেস্ট নয়, বই। ট্রফি নয়, বই। কাপ-পিরিচ, বদনা নয়, বই। আমাকে যদি কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যান, দয়া করে ক্রেস্ট দেবেন না। আমার বাসায় এবং অফিসে ক্রেস্ট রাখার জায়গা নেই। ওই পয়সা দিয়ে যেকোনো একটা বই কিনে আমাকে উপহার দিন। ভয় নেই, ভালো বই যদি ডুপ্লিকেট হয়ে যায়, তবুও আমি বাসায় রাখি। না হলে প্রিয়জনকে উপহার দিই। সব স্কুলে কলেজে যে কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দিন। এমনকি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবেও বই দেয়া হলে তা হবে সবচেয়ে ভালো উপহার। বই একজন পুরস্কার-বিজয়ীর জীবন চিরদিনের জন্য আলোর দিকে ভালোর দিকে পাল্টে দিতে পারে’।

রুজভেল্ট প্রতিদিন বই পড়তেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও, বই পড়ার সময় বের করে নিতেন। বই পড়া ছাড়া তিনি ভালো থাকতে পারতেন না। উইস্টন চার্চিল বই পড়তেন। তিনি লিখতে পছন্দ করতেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। জগৎখ্যাত ধনী ওয়ারেন বাফেটকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, সফলতার চাবিটা কি? তিনি উত্তর দিয়েছেন-প্রতিদিন পাঁচশ পৃষ্ঠা পড়ো। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে বলে জানি। এবার বলি বই সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য। ভিক্টর ভুগোর লা মিজারেবল বইয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য আছে। বেশি না, মাত্র ৮২৩ শব্দের! সর্বাধিক দামে বিক্রিত বই হলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কোডেক্স লেইচেষ্টার। ভাবুন তো বইটা কে কিনেছে? কে আবার! বিল গেটস!

আপনি যদি নরওয়েতে কোন বই প্রকাশ করেন তাহলে সরকার ১০০০ কপি কিনে নিবে। শিশুতোষ বই হলে ১৫০০ কপি। তারপর তারা বইগুলো দেশের লাইব্রেরিতে ছড়িয়ে দেয়। আইসল্যান্ডের একটি নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। ক্রিসমাসে সেখানের মানুষ নিজেদের মধ্যে বই অদলবদল করে এবং বাকি রাত সেসব বই পড়ে এবং চকলেট খেয়ে কাটায়! নরডিক অঞ্চলের এক ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ড। দ্বীপদেশটির দুই পাশে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরাংশ আর আর্কটিক সাগর। শীতপ্রধান দেশটির আয়তন বাংলাদেশের কাছাকাছিই। ৪০ হাজার বর্গমাইলের মতো। তাতে বাস করে মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি মানুষ। বই পড়ার হারে বিশ্বের সবচেয়ে এগিয়ে এই ছোট্ট বরফের দেশটিই। এখানকার মানুষই গড়ে সবচেয়ে বেশি বই পড়ে।

গ্রীকরা একসময় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের জন্ম দিয়েছে। গ্রীকদের কাছ থেকে ধার করেছে আরবের স্কলাররা। তারা গ্রীকদের বই অনুবাদ করেছে। ভারতীয় গণিতবিদদের বই অনুবাদ করেছে। তারা চীনাদের অনুবাদ করেছে। বাগদাদকে বলা হতো “হাউজ অব উইজডম”। রেঁনেসার সময়, শিল্প বিপ্লবের সময় ইউরোপে সূচনা হয় আধুনিক জ্ঞান-গবেষণা, বিজ্ঞান, দর্শনের। ইউরোপিয়ানরা আরবের বিজ্ঞানীদের পড়েছেন। আরবের বিজ্ঞানীদের ল্যাটিনাইজড নাম দিয়েছেন। ইবনে সিনার নাম হয়ে গেছে আভিসিনা। মানুষ তার জীবনে উৎসাহ জাগায় বই পড়ে। অন্যের কথা শুনে। কেউ উৎসাহ পান অপরকে দেখে। কাজেই মুঠোফোন বা কম্পিউটার স্কিন থেকে খানিকটা চোখ সরিয়ে হলেও বই পড়েন। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আর আপনাকে দেখে অপর একজনও বই পড়বে, বই কিনবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক