বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

স্বীকৃতি না পাওয়া একজন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ কথা

প্রকাশিতঃ ৩০ মার্চ ২০২২ | ৯:৪১ অপরাহ্ন


পলাশ বড়ুয়া : আমার বাবা স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া বারবার একটি কথাই বলতেন ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি দেশের জন্য, সনদ বা কোন সুবিধা পাওয়ার জন্য নয়’। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যেসব দলিল, প্রমাণাদি ছিল তিনি সেগুলো সব সময় লুকিয়ে রাখতেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমার বারবার আকুতির পর দলিলপত্রগুলো তিনি আমাকে দেন। দলিলপত্রগুলো দেখে আমি নিজেই হতবাক।

মিজো জেলার দেমাগ্রীতে মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থী ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের ভারত সরকারের সব দলিলই রয়েছে। আমার অনেক অনুরোধের পর ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন।

দুর্ভাগ্যবশত আবেদন করার এক বছর ৫ মাস পর ২০১৮ সালের ২৬ মে আমার বাবা স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সে মাতৃভূমির লাল সবুজের পতাকা তাঁর কফিনে স্থান পায়নি। একমাত্র কারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি না থাকা।

জানি না আমার বাবার মতন স্বীকৃতি না পাওয়া দেশে অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। কেউ মারা গেছেন বা কেউ জীবিত রয়েছেন। তাঁদের ভাগ্যেও হয়তো লাল-সবুজের পতাকা কফিনে স্থান পাবে না। দেশে আবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও কম নয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার দাপট আরও অনেক বেশি। জানি না প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা (যারা এখনো স্বীকৃতি পাননি) কখন স্বীকৃতি পাবেন। তবে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই স্বীকৃতি পাওয়া প্রয়োজন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে।

আমার বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গল্প শুনেছিলাম। যা শুনেছি তা তুলে ধরলাম। স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া, পিতা- মৃত বিশ্ব নাথ বড়ুয়া, মাতা-মৃত সুপ্রভা বড়ুয়া, গ্রাম-কাঁঠালতলী পাড়া, পোস্ট ও উপজেলা: দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঠিকানা: মহামুনি পাহাড়তলী, পোস্ট ও উপজেলা: রাউজান, জেলা: চট্টগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধাকালীন সময়ের বয়স ২২ বছর।

১৯৭১ সালে রাঙামাটি জেলার বরকল থানায় ম্যালেরিয়া অধিদপ্তরের সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমার বাবা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য টেগামুখ পাহাড় পার হয়ে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল দেমাগ্রী যুব ক্যাম্পে পৌঁছান। এবং তৎকালীন আসাম রাজ্যের মিজো জেলার দেমাগ্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী ডেপুটি কমিশনার সি নাগের কাছে রিপোর্ট করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন বরকল থানার তৎকালীন সার্কেল অফিসার, পুলিশের কর্মকর্তা, ফরেস্ট রেঞ্জার, পুলিশ সদস্য জবরদস্ত খাঁন, সুনীল বড়ুয়াসহ আরও অনেকে। তাঁর ভারতের রেজি নং-১৫০৮৫০। সে সময় তিনি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাঁকে একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি শরণার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ক্যাম্পের দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়।

তিনি দেমাগ্রী ইয়ুথ ট্রানজিট ক্যাম্প ও সহকারী ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশনাক্রমে দেমাগ্রী ডিসপেনসারীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী সার্জন ডা. কে. এন শর্মার অধীনে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দেমাগ্রীতে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দীঘিনালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের হারুণ অর রশিদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধা মিলন বড়ুয়ার সাথে তাঁর নিয়মিত দেখা সাক্ষাত ও কথা হতো। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের নির্দেশনায় পুনরায় রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া অধিদপ্তরে কাজে যোগদান করেন। এবং সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদেরকে ৯ মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। তিনিও নয় মাসের সরকারি বকেয়া বেতন পান। তিনি দীর্ঘ বছর চাকরি করার পর অসুস্থতাজনিত কারণে ২০০২ সালে সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসেবে দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ ও সুযোগ-সুবিধা নেননি।

ওপরের কথাগুলো বললাম এই কারণে, আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর দলিল দস্তাবেজ আমি মিলিয়ে দেখেছিলাম। ওনার স্মৃতিচারণগুলো ছিল দালিলিক প্রমাণসহ। আমার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য দীঘিনালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদনও পাঠায়৷ কিন্তু কোন স্বীকৃতি মেলে না৷

আমার এই লেখার একটিই কারণ। তা হলো যারা প্রকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদেরকে যাচাই-বাছাই করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেন রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত না হয়। আমার বাবা স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া হয়তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় মৃত্যুকালে সস্মান পাননি। আমার বাবার মতন অসংখ্য স্বীকৃতি না পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাঁরা যেন কোনভাবেই মৃত্যুকালে রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত না হন। জয় বাংলা, বাংলার জয়।

লেখক : সাংবাদিক