শান্তনু চৌধুরী : ভাইরালের যুগ, সারা দুনিয়া এই মুহূর্তে মেতে আছে অস্কারের মঞ্চে ঘটে যাওয়া চড়-থাপ্পড় নিয়ে। বাঙালি চড়-থাপ্পড়কে খুবই গুরুত্ব দেয়। কারও ওপর রেগে গেলে বলে ওঠে, ‘এক চড় মেরে বত্রিশ দাঁত ফেলে দেব।’ তবে চড় খেয়ে দাঁত পড়ে গেছে এমনটি নাটক সিনেমায় দেখা গেলেও বাস্তবে বিরল! কিন্তু কানের বারোটা বেজেছে বহু মানুষের। চড় অনেক প্রকার। মায়ের হাতের চড়ের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে চড় ভয়ংকর। পুলিশ বিনা কারণে চড় থাপ্পড় মারতে চায় সেটা অন্য জিনিস।
জনপ্রতিনিধির চপেটাঘাত, ছাত্র-যুবনেতার চড়ের স্বাদ আলাদা। কিন্তু প্রেমিকার হাতের চড় অতি মিষ্টি। স্বামীর হাতের চড় যে একেবারেই তা নয়, তা বাঙালি নারী যেমন জানেন তেমনি জানেন বিদেশিরা। তবে বৌয়ের হাতের চড় নাকি বেশ মিষ্টি। গানে আছে, ‘চিনি মিঠা, মিষ্টি মিঠা/মিঠা দুধের সর/তাহার চাইতে অধিক মিঠারে, বৌয়ের নরম হাতের চড়’। কিছু চড়ের স্মৃতি পুরুষ আমৃত্যু ভুলতে পারে না। কোনো নির্জন জায়গায় কোনো তরুণীকে একাকি পেয়ে অযাচিত প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে যুবতীর হাতের চড় কাকপক্ষী না দেখলেও তার ব্যথা যতোটা নয়, সে চড়ের জ্বালা সারাজীবন জ্বলতে থাকে। শহরে হাঁটলে নিশ্চয়ই প্রায়ই চোখে পড়ে, ‘পড়াতে চাই’। কিন্তু অনেকে মজা করার জন্য পড়াতে চাই এর আগে একটা ‘থা’ লাগিয়ে দেন। মানে ‘থাপড়াতে চাই’। নিচে বিজ্ঞাপনদাতার মোবাইল নাম্বারসহ বিস্তারিত ঠিকানা দেয়া।
আরেকটি বিজ্ঞাপনে লেখা- পাড়াতে চাই। তাহলে দাড়ায় এমন যে বিজ্ঞাপনদাতা পা দিয়ে মাড়ানোর জন্য এই বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এই চড় থাপ্পড় নিয়ে এতো কথা বলার কারণ হচ্ছে, অন্তত আজ সারা দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল উইল স্মিথের পক্ষে, আরেক দল বিপক্ষে। সঙ্গে থাকা স্ত্রী বা বান্ধবীকে অপমান করায় নায়কের হাতে ভিলেনের বেধড়ক মার খাওয়া এত দিন সিনেমায় দেখা গেছে। এবার দেখা গেল বাস্তবে, কোটি কোটি মানুষ ঘরে বসে সরাসরি এর সম্প্রচার দেখেছেন। ৯৪তম অস্কারের আসর ইতিহাসে স্থান করে নিল একটি ঘটনার কারণেই। মঞ্চে তখন ছিলেন মার্কিন কমেডিয়ান ক্রিস রক। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন পুরস্কার দিতে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে উইল স্মিথের স্ত্রী জাডা পিংকেট স্মিথকে নিয়ে ঠাট্টা করেন ক্রিস। সবাই কমবেশি হেসে দিলেও গম্ভীর হয়ে যান জাডা।
এরপরই ঘটনাটি ঘটে সবার চোখের সামনে। মঞ্চে এসে ক্রিস রককে সপাটে চড় কষান উইল স্মিথ। পরে অবশ্য মঞ্চে উঠে ক্ষমা চান স্মিথ। যদিও সরাসরি তিনি ক্রিস রকের নাম উচ্চরণ করে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেননি। তবে সেই ক্ষমা চাওয়ার উপলক্ষটাও ছিল স্মিথের জন্য বড় ঘটনা। তিনি সেরা অভিনেতার অস্কার নিতে তখন আবারও মঞ্চে এসেছিলেন। ‘কিং রিচার্ড’ ছবিতে রিচার্ড উইলিয়ামস চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ৯৪তম অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন উইল স্মিথ।
এর আগে ১৯৭৪ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে পুরুষ ফটোগ্রাফার ও শিল্পী রবার্ট ওপেল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অস্কার মঞ্চে উঠেছিলেন। উপস্থাপক ডেভিড নিভেন খুব ভালোভাবে ঘটনাটি সামাল দিয়েছিলেন। থাপ্পড় নিয়ে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন পরিচালক অনুভব। তার ছবির নাম, ‘থাপ্পড়’। অভিনেত্রী তাপসী পান্নুর অভিনয় সে ছবিটিকে নতুন মোড় দিয়েছিল। শুধুমাত্র একটাই থাপ্পড়। জীবনের কাছে সুখ এবং সম্মান একসঙ্গে চাওয়া অমৃতার গল্পে এই প্রশ্নটাই হয়তো পরিচালক গেঁথে দিতে চেয়েছেন সবার মাঝে। কারণ, ছবির এই থাপ্পড়টা পর্দায় দেখা গৃহবধূর গালে নয়, থাপ্পড়টা আসলে আধুনিকতার পথে হাজার পা বাড়িয়েও সমাজের উঁচু থেকে নিচুতলা, বড়লোক থেকে গরিব, মেয়ের বাবা-মা বা ছেলের বাবা-মা, রক্ষণশীল থেকে উদারমনস্ক-প্রত্যেকটা মনে গেঁথে থাকা ভাবনাগুলোয়। আদিকাল থেকে চলে আসা যে ভাবনা এখনও লুকিয়ে থাকে মগজের কোণে। সুযোগ মতো বেরিয়েও পড়ে সেই প্রশ্ন, স্রেফ একটা থাপ্পড়ের জন্য ডিভোর্সের বাড়াবাড়ি কেন? থাপ্পড়টা তাই আসলে আমাদেরই চেতনার মূলে।
যে রাশিয়া এখন যুদ্ধের জন্য আলোচিত সেই রাশিয়ায় একবার থাপ্পড় প্রতিযোগিতাও হয়েছিল। রাশিয়ায় সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম চড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল সেদিন। কে কতো জোরে চড় মারতে পারে এবং তা সহ্য করার ক্ষমতার ওপর এক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় সে দেশে। সেই চড়-থাপ্পড় প্রতিযোগিতার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। রুশ দেশের বিয়ারস নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ওই ভিডিওটি প্রচারিত হয়। চড়ের ঠাস ঠাস শব্দ যে দর্শকেরা খুবই উপভোগ করছে, তা ভিডিওতে দেখা যায়। এই নতুন খেলায় প্রথমে এক প্রতিযোগী তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে সর্বশক্তি দিয়ে একটি চড় মারেন। চপেটাঘাতপ্রাপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রত্যুত্তরে তাকে মারেন আরেক চড় কষে। চলছে সশব্দে চড় মারামারি। প্রতিযোগিতায় একপর্যায়ে একজনকে হার মানতেই হয়। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল পার হয়ে ফাইনালে একজন শিরোপা পান। ২০০৬ সালে টেলিভিশন রিয়্যালিটি শো ‘ইন্ডিয়ান আইডল’এ অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন নেহা কক্কর। তিনি সেই প্রতিযোগিতার মাঝামাঝি পর্যায়ে এলেও শেষ আটে ওঠার আগেই ছিটকে যান। কারণ তার বেসুরো গলায় এলোমেলো গানে ক্ষেপে যান বিচারক অনু মালিক। সে অনুষ্ঠানে ফারহা খান এবং সনু নিগামও বিচারকের আসনে ছিলেন। তারাও খুশি হতে পারেননি নেহার গানে।
এমন তাবড় তাবড় বিচারকের সামনে ‘রিফিউজি’ সিনেমার ‘আয়সা লাগতা হ্যায়’ গানটি গাচ্ছিলেন নেহা। পরের সময়গুলোতে অবশ্য নেহা নিজেকে তৈরি করে এখন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তবে প্রতিযোগীরা কোনও গান বাজে গাইলে অনু মালিক এমন করে থাকেন। হয়তো এভাবে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেন। যার জন্য অনেকের কাছে মজার খোরাকও হন অনু মালিক। ‘শরারত’ মুক্তির পর দর্শকের প্রতিক্রিয়া জানতে একটি সিনেমা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন অভিষেক বচ্চন। আর তখন হঠাৎ এক নারী এসে সপাটে থাপ্পড় মারেন তাকে। এ প্রসঙ্গে জুনিয়র বচ্চন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন যে আমি আমার পরিবারের নাম নষ্ট করছি। তাঁকে (অমিতাভ) লজ্জিত করছি। তাই আমার অভিনয় ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশে অবশ্য চড় থাপ্পড় মারার ঘটনা নতুন নয়। বড় কাউকে তা মারা না হলে অবশ্য আলোচনায় আসে না। নারী দিবসের দাওয়াত দিতে দেরি হওয়ায় পাবনা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে থাপ্পড় দিয়ে পাবনা ছাড়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পাবনা-সিরাজগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলির বিরুদ্ধে। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) মো. জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে বাজারে সাধারণ মানুষকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ গেছে জেলা প্রশাসকের কাছে। পুরান ঢাকার বংশালে একজন রিকশাচালককে থাপ্পড় মারার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তবে থাপ্পড় মারাও কোনো কোনো সময় চাকরি হতে পারে। পড়ুন তবে সেই ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি দূর করতে একটি অভিনব কায়দা বের করেন ইন্দো-আমেরিকান যুবক মনীশ শেঠি। তিনি একজন কর্মী নিয়োগ করেন যিনি ফেসবুকে ঢোকা মাত্রই তাকে থাপ্পড় মারবেন। শুধু তাই নয়, অদ্ভুত এই চাকরির জন্য কর্মী খুঁজতে রীতিমতো বিজ্ঞাপনও দেন মনীশ। তাতে লেখেন, ‘আমি সময় নষ্ট করলেই আমার ওপর চিৎকার করবে। প্রয়োজনে চড়-থাপ্পড় মারতেই হবে।’ বিজ্ঞাপনটিতে ব্যাপক সাড়াও পান তিনি। এরপর একজন নারীকে এই কাজে নিয়োগ করেন এবং এজন্য প্রতি ঘণ্টায় ৮ মার্কিন ডলার পারিশ্রমিকও দেন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক