এম কে মনির : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচিতে যুক্ত চট্টগ্রামের ১ হাজার ৪০ জন শিক্ষক চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না।
নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে শিশু জরিপ ও কক্ষ ভাড়া নিয়ে শিখন কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছেন এই শিক্ষকরা। সেই খরচও পাচ্ছেন না তারা। এ কারণে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যদিও কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে পরিচয় প্রকাশ করে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেন না এসব শিক্ষকরা।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো চট্টগ্রাম কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার লক্ষ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো একটি প্রকল্প নিয়েছে। সরকারের অংশীজন হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আহছানিয়া মিশন চট্টগ্রামে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এর অংশ হিসেবে গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের ১২টি উপজেলায় (সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, বোয়ালখালী, কর্ণফুলী) ৮৪০ জন ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২০০টি শিখন কেন্দ্রে একজন করে মোট ১ হাজার ৪০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে ৮ থেকে ১৪ বছরের ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া শিখন কেন্দ্রে সপ্তাহে ৬ দিন ৩ ঘন্টা করে ক্লাস করানোর নিয়ম আছে। পৌর এলাকার স্কুলশিক্ষকের বেতন ১০ হাজার ও উপজেলার অন্যান্য স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন পরিশোধ করা হবে বলে শিক্ষকদের দিয়ে ব্যাংকে নিজ নিজ হিসাব খোলানো হয়েছে। কিন্তু চার মাস ধরে শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
সীতাকুণ্ডের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘শিখন কেন্দ্রের জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম বড় কোন চাকরি পেতে যাচ্ছি। ৫ হাজার টাকা বেতন ধার্য হলেও শিখন কেন্দ্রের কক্ষের ভাড়া আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। প্রথমে বলেছিল কেন্দ্রের ভাড়া আলাদা দেয়া হবে। পরে বলা হচ্ছে বেতনেই সেটি যুক্ত। তবে ৪ মাসেও আমাদের বেতন দেয়া হয়নি। জানুয়ারিতে আমাদের নিয়োগ দেয়া হলেও আমরা কাজ করছিলাম, এক বছর আগে থেকে। স্কুল শুরুর আগে শিশু জরিপ করানো হয় আমাদের দিয়ে। সে বাবদ প্রাপ্য সম্মানী এখনো পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আহছানিয়া মিশনের সীতাকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফ উদ্দিনকে বেতনের কথা বললে তিনি বারবার আমাদের ভরসাই দিয়ে যান। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আশা দেন। আজ বেতন হবে, কাল হবে বলতে থাকেন। সরকারের কাছ থেকে তারা টাকা পাচ্ছে কি না নাকি টাকা নিয়ে আমাদেরকে দিচ্ছে না জানি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহছানিয়া মিশনের সীতাকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফ উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলে, ‘বেতন না আসলে তো আমার কিছু করার নেই। স্বতন্ত্র যাচাই সংস্থা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভ্যারিফিকেশন এজেন্সি মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি যাচাই করবে। যেহেতু এটি স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সেহেতু প্রতিটি শিখন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সেটি সঠিকভাবে হয়েছে কি না সেটি তদন্ত হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ঈদের পরই শিক্ষকরা বেতন পাবেন বলে আশা করছি।’
শাখা ব্যবস্থাপক আশরাফ উদ্দিন তদন্তের পর বেতন পরিশোধের নিয়মের কথা জানালে শিক্ষকরা বলছেন নিয়োগের পরে ভেরিফিকেশন করে বেতন দেয়া হবে এমন বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। তাছাড়া এসব তালিকা বারবার সরেজমিন ভেরিফিকেশন করেই শিখন কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন পুনরায় ভেরিফিকেশনের কথা বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে আহছানিয়া মিশনের চট্টগ্রাম জেলার প্রোগ্রাম অফিসার তাইজুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘উক্ত কর্মসূচির অধীনে চট্টগ্রামে ১ হাজার ৪০ জন শিক্ষক রয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে ৮৪০ জন ও শহরে ২০০ জন। তারা কেউই বেতন পাননি। সরকার আমাদের ফান্ড দেয়নি, তাই বেতন দেয়া হয়নি। বিষয়টি শিক্ষকদের বলা হয়েছে। তারা কেন অভিযোগ করবে? আমি নিজেও টাকা পাইনি। আমাদের অনেক কর্মকর্তা আছেন না পাওয়ার তালিকায়।’
‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচিতে যুক্ত কতজন কর্মকর্তা বা সুপারভাইজার আছেন, সে সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাইজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘কেউ যদি সবকিছু জেনেও মিডিয়ায় অভিযোগ করেন তাহলে তার চাকরি থাকবে না। এটা তার বোঝা দরকার যে মিডিয়ায় বলার বিষয় নয় এটি। আমাদের শিখন কেন্দ্রগুলোর ভ্যারিফিকেশন এখনো হয়নি। আইভিএ ভ্যারিফিকেশন করবে। যেটি সবাইকে মিটিং করে বলা হয়েছে। যে উপজেলায় সমস্যা, সেখানে ম্যানেজার আছে, আপনি তার বিরুদ্ধে লিখুন। সে সেখানকার শিক্ষকদের ব্যাপারটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ তার দায়। এখানে অনেক বড় প্রোগ্রাম এটি। আমরা চুরি করতে আসিনি। সরকার টাকা না দিলে আমরা কী করবো? কোন শাখার ম্যানেজার বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা করে থাকলে তার চাকরি নট করা হবে।’
জানতে চাইলে আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রামের সীতাকুণ্ডের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন একুশে পত্রিকাকে তার দপ্তরে বলেন, ঈদের আগে বেতন না দেয়া সত্যিই দুঃখজনক। আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষকদের বেতনগুলো নিয়ে দেয়ার জন্য।’
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিনহাজুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কেন শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছে না, বিষয়টি আমি দেখব। এই মুহুর্তে বিস্তারিত বলতে পারছি না। তাদের সাথে আলোচনা করে সমস্যাটির সমাধান করব। ফান্ড সংকট থাকার কথা নয়।’
জানতে চাইলে আহছানিয়া মিশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ইডি) ড. এহসানুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি সত্য যে বারবার ভ্যারিফিকেশন করা হয়েছে। ভ্যারিফিকেশন করেই এসব শিখন কেন্দ্র চালু হয়েছে। তবে শিক্ষকদের নিয়োগ পাওয়ার পর আবারও ভ্যারিফিকেশন করা হবে, এটি সরকার আমাদের জানায়নি। তাই আমরা শিক্ষকদের জানাতে পারিনি। পুনরায় ভ্যারিফিকেশনের বিষয়টি এখন জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে একটি সরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে শিখন কেন্দ্রে কোন স্কুলের শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাইয়ে।’
সরকারের অংশীজন হিসেবে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন জেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাদের কেউ কেউ শিক্ষকদের বেতন দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. এহসানুর রহমান বলেন, ‘কোন কোন সংস্থা নিজেদের ফান্ডে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেছে। আমরা আমাদের ফান্ড সংকটের কারণে করতে পারছি না। সরকার প্রোগ্রাম ঘোষণা করলেও এখনো ফান্ড দেয়নি। আমরা তো নিজে থেকে করতে পারবো না সরকার না দিলে। সারাদেশেই একই চিত্র বেতন পরিশোধের।’
এ বিষয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক জুলফিকার আমিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ঈদের পর সব বেতন দিয়ে দেয়া হবে। তবে প্রোগ্রামটিতে কথা ছিল শিক্ষকদের ১ মাসের বেতন আহছানিয়া মিশন তাদের ফান্ড থেকে দিয়ে দিবে। কিন্তু তারা প্রকল্পে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করেছে এবং এখন তাদের তহবিল সংকটের কথা বলে সেটাও দেয়নি। তাছাড়া সরকার অর্থায়ন করেনি এখনো, তাই এরকম সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটি শিখন কেন্দ্রের ভ্যারিফিকেশনের জন্য সরকার একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কোন কেন্দ্রে শতভাগ শিক্ষার্থী পেলে অর্থাৎ প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া শতভাগ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়া হলে সেই শিখন কেন্দ্রের শিক্ষক বেতন পাবেন। অন্যথায় ব্যতিক্রম হলে পাবেন না। ঈদের পর এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’