মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

১৯ বছর পর সম্মেলন, সৎ নেতৃত্বের প্রত্যাশা

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগ

প্রকাশিতঃ ২৪ মে ২০২২ | ৯:০৮ পূর্বাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সম্মেলন হচ্ছে দীর্ঘ ১৯ বছর পর। সম্মেলন ঘিরে দলের ঝিমিয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। শীর্ষ পদ কারা পাচ্ছেন, তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। যোগ্যতার পাল্লায় নিজেদের এগিয়ে রাখতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা পদ-প্রত্যাশী নেতারা চালাচ্ছেন। সকলের চাওয়া, দায়িত্ব দেওয়া হোক স্বচ্ছ ইমেজের কাউকে।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের শীর্ষ নেতারাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যুবলীগের নতুন কমিটির নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার বা তদবিরে কাজ হবে না। সম্পূর্ণ ক্লিন ইমেজ, সক্রিয়, ত্যাগী এবং সাবেক–বর্তমান যুবনেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতাদের মধ্য থেকেই যুবলীগের ৩ ইউনিটের নেতৃত্ব বাছাইয়ের আভাসও দিয়েছেন যুবলীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা।

গত ১২ মে উত্তর জেলা যুবলীগের সম্মেলন প্রস্তুতি সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ ফজলে নাঈম বলেছেন, ‘বায়োডাটা দেখে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। গোপনে কোন কিছু করা হবে না। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। কোনো সন্ত্রাসী, মাস্তান, চাঁদাবাজদের স্থান যুবলীগে হবে না। কোনো কিছুর বিনিময়েও যুবলীগের নেতৃত্বে আসা যাবে না।’

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের কমিটির শীর্ষ পদ পেতে বেশিরভাগ প্রার্থী তদবিরে ভরসা করলেও আছে ব্যতিক্রম। কোনো লবিং-তদবির নয় বরং নিজ যোগ্যতায় উঠে আসতে চান তারা। এদের মধ্যে আছেন- সভাপতি পদে বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল আলম, সাধারণ সম্পাদক পদে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ, উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবু তৈয়ব, সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি এস এম আল নোমান ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য রাশেদ খান মেনন প্রমুখ।

সভাপতি প্রার্থী এস এম রাশেদুল আলমের দাবি, কোনো প্রকার তদবির ছাড়াই হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হয়েছেন তিনি। উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতি পদেও ‘তদবির’ ছাড়াই বাজিমাত করতে চান এ নেতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যের পর বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন এস এম রাশেদুল আলম। নিজের পদপ্রাপ্তির ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি।

একুশে পত্রিকাকে এস এম রাশেদুল আলম বলেন, ‘নেতৃত্ব বাছাইয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই আমার কাছে চূড়ান্ত। তবে কাউন্সিলর ভোট এবং সমঝোতার মধ্যে আমি কাউন্সিলর ভোটকেই বেছে নেব। ভোটাভুটি হলে কোনো বিতর্কিত লোক দলে আসতে পারবে না। এতে স্বচ্ছতা আসবে। আর ‘মাই ম্যান’ রাজনীতি আমি কখনো সমর্থন করি না। এবারের কমিটিতে যদি এমনটা হয় তাহলে তা দলের জন্যই ক্ষতিকর হবে। ত্যাগীরা রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আশা করছি, এমন কিছু উত্তর জেলা যুবলীগে হবে না।’

অন্যদিকে, সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার শেখ ফরিদ রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ইউনিয়নের টানা দুবারের চেয়ারম্যান। ক্লিন ইমেজ ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে অনেক বাঘা বাঘা প্রার্থীকে টপকে বাগিয়েছেন নৌকার মনোনয়ন। তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি করা ফরিদ ছিলেন জেলা ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য। দীর্ঘ ১২ বছর যুবলীগের রাজনীতি করা শেখ ফরিদ চান যোগ্যতার মূল্যায়ন।

জানতে চাইলে শেখ ফরিদ বলেন, ‘নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। আশা করি, কেন্দ্র এমন একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে, যেখানে সকলের মত প্রকাশের মাধ্যমে যোগ্যরা উঠে আসবেন। এছাড়া নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যারা জেলার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন, দলের জন্য কাজ করেছেন তাদের মূল্যায়নের সময় এসেছে। অনেক দখলবাজ, টেন্ডারবাজ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তি শীর্ষ পদে আসতে নেতাদের কাছে তদবির করছেন। আমি চাই, পেশিশক্তি ব্যবহার করে যাতে কেউ নেতৃত্বে আসতে না পারে।’

সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী আরেক প্রার্থী উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবু তৈয়ব। দীর্ঘ ৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন কোনো রকম বিতর্ক ছাড়াই। একারণে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে দলের সিনিয়র নেতাদের গুডবুকে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করে যুবরাজনীতিতে পদার্পণ করেও কেড়েছেন সকলের নজর। নিজের অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে যুবলীগকে করেছেন সুসংগঠিত। বৃহত্তর পর্যায়ে যুবলীগের সুনাম ছড়িয়ে দিতে আসন্ন সম্মেলনে সুযোগ চান তিনি।

একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে উত্তর জেলা যুবলীগের কাউন্সিল করার পরিবেশ নেই। যেহেতু ১৯ বছর পর সম্মেলন হচ্ছে সেক্ষেত্রে কাউন্সিলর নির্বাচন করাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। মানবিক যুবলীগে বিতর্কিত কেউ আসুক সেটা আমি চাই না। আর অনেক সময় ভাইলীগ প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্যদের অবমূল্যায়ন করা হয়। এসব বিষয় আমাদের খুবই পীড়া দেয়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ইউনিটে এ ধরনের কিছু হবে না।’

সাধারণ সম্পাদক পদের আরেক দাবিদার এস এম আল নোমান (সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পীকার প্রয়াত আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে)। ওমর গণি এম ই এস কলেজ ও সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমান সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আল নোমান।

একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি চাই দলে যাতে কোন বিতর্কিত ব্যক্তি অনুপ্রবেশ করতে না পারে। এজন্য ডোপ টেস্ট হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। আর কাউন্সিলর ভোট কিংবা সমঝোতা যেভাবেই নেতৃত্ব বাছাই করা হোক না কেন আমার আপত্তি নেই। কারণ কাউন্সিলর ভোটে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে যারা অভিভাবক আছেন তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তাতে কারো দ্বিমত পোষণ করার কথা নয়। কারণ তারা কেউই মাইম্যান রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। দলের নীতি নির্ধারকরা অবশ্যই যোগ্যদের মূল্যায়ন করবেন।’

আরেক সাধারণ সম্পাদক পদ-প্রত্যাশী রাশেদ খান মেননও উঠে এসেছেন তৃণমূলের রাজনীতি করে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্যও। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিচারে নিজেকে এই পদের জন্য অপরিহার্য মনে করছেন মেনন।

একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘স্বচ্ছ ইমেজের নেতৃত্ব আনতে ডোপ টেস্ট হওয়া উচিত। বিতর্কিতরা দলে আসলে তারা অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলকেও বিতর্কিত করবে। আর নেতৃত্ব নির্বাচনে কাউন্সিলর ভোট অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন্দ্রের একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, দীর্ঘ ১৯ বছর সম্মেলন হয়নি। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলর ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সমঝোতায় কমিটি গঠন ভালো হবে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া থাকবে যোগ্যতার মূল্যায়ন যাতে হয়।’

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন যুবলীগ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর সৈয়দ মফিজ উদ্দীন আহম্মদকে সভাপতি ও এস এম শফিউল আজমকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন।

এরপর সম্মেলন করে নিয়মিত কমিটি করার কথা বলা হলেও গত ১৯ বছরেও কমিটি হয়নি। পরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সভাপতি সৈয়দ মফিজ উদ্দীন আহম্মদ পদত্যাগ করলে কয়েক বছর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সহ-সভাপতি জাফর আলম।

২০১২ সালে ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ২০০৩ সালে করা কমিটির সহ-সভাপতি এস এম আল মামুনকে সভাপতি ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক করে পুরাতন কমিটি বহাল রাখা হয়। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে উত্তর জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে যুবলীগের কমিটি আছে।