চীন এবার নিজেই বেকায়দায়!


ফারুক আবদুল্লাহ : বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলার অভিযোগ উঠে চীনের বিরুদ্ধে। এবার এই প্রকল্পের কারণে চীন নিজেই বেকায়দায় পড়েছে!

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ যারা ইতোমধ্যে চীনা ঋণ গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, সেসব দেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন চীনা নাগরিকরা।

পাকিস্তানে গত এপ্রিলে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছে। আর শ্রীলঙ্কায় চীনপন্থি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর সেখানে থাকা নিজ নাগরিকদের হামলা থেকে বাঁচতে ও সাবধানে চলাচলের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বেইজিং।

এছাড়া বেলুচ লিবারেশন আর্মি চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোরের ঘোর বিরোধী (সিপিইসি)। সংগঠনটির একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী গত ২৬ এপ্রিল করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের একটি শাটল বাসে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন চীনা শিক্ষক নিহত এবং একজন আহত হয়েছেন।

২০১৯ সালে পাকিস্তানের দাসু হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্টে কর্মরত চীনা নাগরিকদের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এতে ৯ চীনা নিহত হন। এ জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাকিস্তানকে ১১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হয়েছে।

এসব পরিস্থিতির পর চীনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সাম্প্রতিক সফরের সময় বেইজিং বেলুচিস্তানে সামরিক ঘাঁটির দাবি করেছে।

জানা গেছে, চীনা কর্তৃপক্ষ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এবং পাকিস্তানে তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে আপত্তি প্রদর্শন করেছে। পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের বারবার হামলার খবরের পর ইসলামাবাদ পুলিশ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় পুলিশ অফিসে (সিপিও) প্রয়োজনীয় কর্মী এবং রসদ সহ একটি বিদেশী নিরাপত্তা সেল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাকিস্তানের একটি ঊর্ধ্বতন স্তরের ট্রাই সার্ভিস সামরিক প্রতিনিধি দল ৯ থেকে ১২ জুন ২০২২ পর্যন্ত চীন সফর করেছে। প্রতিনিধি দল চীনা সামরিক এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বিস্তৃত আলোচনা করেছে।

সামরিক সূত্রের মতে, চীনারা বেলুচিস্তানে বিশেষ করে গোয়াদরে সামরিক ফাঁড়ি চায়। পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ঘাঁটিগুলির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে দেশটির সাথে দাবিগুলি বিবেচনা করার জন্য কিছু সময় অনুরোধ করেছে।

বেলুচ বিদ্রোহীরা সিপিইসি প্রকল্প এবং কর্মীদের আক্রমণ করছে, কারণ তারা চীনকে একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলে মনে করে যে পাকিস্তান সরকারের সাথে বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সফরকালে, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব বেইজিংকে সিপিইসি প্রকল্প এবং দেশে চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে।

উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান ও চীন চ্যালেঞ্জিং সময়ে তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বের পুনর্নিশ্চিত করেছে এবং পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়ে নিয়মিত দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।

উভয় পক্ষই তাদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং ত্রি-পরিষেবা স্তরে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইতিহাসে দেখা গেছে, পরাশক্তি হয়ে ওঠার কালে কোনো কোনো দেশের বিশেষ কোনো সুবিধা বা মতার জন্ম হয়েছে, তা দিয়ে ওই সব দেশ বিশ্বকে দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রভাবিত করতে পেরেছে। ব্রিটেন জাহাজ নির্মাণ ও নৌচালনা জ্ঞান দিয়ে সাম্র্রাজ্য গড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজি ও ব্যবস্থাপনা দতা দিয়ে ইউরোপ পুনর্গঠন করে পাশ্চাত্যের নেতা হয়েছিল। পাশ্চাত্য তার অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক মতা দিয়ে বিশ্বায়নের প্রথম পর্বের বাস্তবায়ন করেছিল। চীনের সেই বিশেষ সুবিধার দু’টি দিক হলো- অবকাঠামো নির্মাণে চীনের বিশ্বসেরা দতা এবং বিরাট অঞ্চলজুড়ে অবকাঠামো নির্মাণে তাদের আর্থিক সামর্থ্য।

দণি চীন সাগরে জাপান ও আমেরিকার সাথে বিরোধ থাকায় চীনের দরকার সামুদ্রিক বাণিজ্যের নতুন জলপথ। এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী হলো বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর। ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরের কাছে শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা ও জিবুতি এবং আরব সাগরের তীরে পাকিস্তানের গদর বন্দর নির্মাণের কাজ চীন চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারত মহাসাগর হলো একবিংশ শতাব্দীর কেন্দ্রীয় মঞ্চ। এর কিনারে রয়েছে সাহারা মরুভূমি থেকে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ; রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরান ও পাকিস্তান। এ সাগর ঘিরেই চলছে গতিশীল বাণিজ্য। আবার একে ঘিরেই দানা বেঁধেছে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, জলদস্যুতা ও মাদক চোরাচালান। এর পূর্ব প্রান্তে বাস করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার শত কোটি মুসলমান।

অন্য দিকে, এর তীরেই বসবাস করে বিশ্বের বড় জনসংখ্যার কয়েকটি দেশ- ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। এর ভেতর দিয়েই গেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান জলপথ। এর তীরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো। এই সমুদ্র প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ। বর্তমানে বছরে এই জলপথে ৯০ হাজার জলযান দিয়ে ৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন টন বাণিজ্যিক পণ্য পরিবাহিত হয়। বিশ্বের ৬৪ শতাংশ তেলবাণিজ্য এই জলপথের ওপর নির্ভরশীল।
বিআরআইয়ের মূল চাবিশব্দ হলো কানেকটিভিটি। এর উদ্দেশ্য এশিয়াকে বিশ্ব-বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় ইঞ্জিন করে তোলা। এ পরিকল্পনায় থাকছে সমুদ্রপথে একগুচ্ছ আন্তর্জাতিক বন্দর, ভূমিতে আন্তসীমান্ত সড়ক, উচ্চগতির রেলপথ, বিমানবন্দর এবং ডিজিটাল যুক্ততার অবকাঠামো নির্মাণ। এর সমান্তরালে থাকবে বিদ্যুতের গ্রিড, গ্যাসের পাইপলাইন এবং বাণিজ্য-সহায়ক আর্থিক কার্যক্রম। এই বাণিজ্যপথ এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় জালের মতো ছড়িয়ে থাকবে, এশিয়াকে ভূমি-সমুদ্র-আকাশ ও ডিজিটাল মাধ্যমে ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে যুক্ত করবে।

কেউ কেউ বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে চীনের অর্থনীতিতে দেড় লাখ কোটি ডলারের অবদান রাখবে এই নেটওয়ার্ক। আর এই নেটয়ার্কের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে।

আসলেই কী তাই?

লেখক: সাংবাদিক।