বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

হাটহাজারী ভূমি অফিস: গালাগাল ও অপমান সইতে না পেরে মৃত্যু? (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ ২ অক্টোবর ২০২২ | ১১:৩২ পূর্বাহ্ন

একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি ল্যান্ড) অফিসের দুই কর্মচারীর গালাগাল ও অপমান সইতে না পেরে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। পেশায় দিনমজুর ওই বৃদ্ধের নাম আবদুল মোনাফ (৬২)।

মোনাফের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার উত্তর ফতেয়াবাদ পশ্চিম খাগড়িয়া ছড়ারকুল এলাকায়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর মোনাফ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এসি ল্যান্ড অফিসে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনাটি ঘটে।

মোনাফের মেয়ে আইরিন আক্তারের অভিযোগ, বিজয় নন্দন বড়ুয়া এবং নিউটন বড়ুয়া নামে দুই কর্মচারীর গালাগাল ও অপমানের ধকল সইতে না পেরে তার বাবা মারা গেছেন।

আইরিন জানান, তার প্রয়াত সৎ মা নুর বেগমের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু জমি হাটহাজারী উপজেলা এসি ল্যান্ড অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি পৃথক নামজারি খতিয়ান (২৬৫৭ ও ২৮৯১) করে নেন। জমাভাগ মামলা নম্বর যথাক্রমে গ-২৩৯/১১ এবং গ-২১৪৯/১২৷ জমির পরিমাণ ০০৩০০ শতাংশ।

উক্ত জমি ২০১৭ সালে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করে সরকার৷ উক্ত খতিয়ান দুটি বাতিলের জন্য ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এসি ল্যান্ড বরাবর আবেদন করেন তার বাবা আব্দুল মোনাফ ও বড় বোন মিনু আক্তার। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এসি ল্যান্ড অফিসে ঘুরলেও সেই খতিয়ান বাতিল না করে উল্টো তাদের আবেদনটি খারিজ করে দেন এসি ল্যান্ড আবু রায়হান। সাড়ে তিন বছরেও মামলা নিষ্পত্তি তো হয়নি, অনৈতিক দাবি পূরণ না করায় এবং জসিমের সাথে আঁতাত করে আবদুল মোনাফকে চরম হয়রানি করেন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী বিজয় নন্দন বড়ুয়া।

আইরিনের আরও অভিযোগ, গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহের একদিন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ জানতে গিয়ে বিজয় নন্দন বড়ুয়া এবং তার আরেক সহকর্মী নিউটন বড়ুয়ার হাতে লাঞ্চিত এবং অপমানিত হন আবদুল মোনাফ। এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মচারী বিজয় বড়ুয়া এবং নিউটন বড়ুয়া গালাগাল এবং অপমান করার পর তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করাতে হয়। ডাক্তাররা জানান, তিনি হঠাৎ হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ২৫টি ইনজেকশন দেওয়া হয়। এক প্রকার সুস্থ হয়ে তিনি ঘরেও ফিরে আসেন। কিন্তু এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার তিনি ভুলতে পারছিলেন না। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে তার শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি হয়। তখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা তার বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আইরিন বলেন, এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মচারী বিজয় নন্দন বড়ুয়া ও নিউটন বড়ুয়ার দুর্ব্যবহারের ধকল সইতে না পেরে আমার বাবা মারা গেছেন। আমি বিজয় নন্দন বড়ুয়া ও নিউটন বড়ুয়ার শাস্তি চাই।

আবদুল মোনাফকে দুর্ব্যবহার করার একটি ভিডিও ফুটেজ একুশে পত্রিকার হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, বৃদ্ধ মোনাফের সাথে তুমুল বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত বিজয় নন্দন বড়ুয়া ও নিউটন বড়ুয়া৷ তাদের কথোপকথন কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-

বিজয় নন্দন বড়ুয়া: ‘বেয়াদবের বাচ্চা থাপড়াইয়্যা গাল ফাটায় দেব। ওকে লাথি দিয়ে বের কর।’

আব্দুল মোনাফ: ‘আমার কাজ শেষ না করে বছরের পর বছর ঘুরাস কেন?’

বিজয় নন্দন বড়ুয়া: ‘তোকে কোন… (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গালি দিয়ে) ঘুরায়? শুয়োরের বাচ্চা একদম ফুটবলের মতো মারব। পা দিয়ে পিষে দেব।’

আব্দুল মোনাফ: ‘মানুষকে এত কষ্ট দাও কেন?’

বিজয় নন্দন বড়ুয়া: ‘শালার পুতকে বাঁধ’

আব্দুল মোনাফের দিকে তেড়ে এসে আংগুল উঁচিয়ে নিউটন বড়ুয়া: ‘গালিগালাজ করবা, না। গালিগালাজ করলে পিঠের চামড়া তুলে ফেলব।’

জানা গেছে, ভূমি অফিসে সেবাগ্রহীতার সাথে দুইজন সরকারি কর্মকর্তার এমন আচরণ দেখে সেদিন বিস্মিত হন উপস্থিত সবাই।

আইরিন জানান, ২০১৭ সালের আগে হাটহাজারীর মীরেরহাট মধ্য পাহাড়তলী মৌজায় তার সৎ মা নুর বেগমের বাবার (মৃত বাচা মিয়া) সূত্রে পাওয়া জমি আনোয়ারা বেগম নামে এক নারীর কাছে নিজের অংশসহ বিক্রি করেন নুর বেগমের ভাই রফিক মিয়া। পরে সেই জসিম উদ্দিন নামে আরেক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন আনোয়ারা বেগম। জসিম উদ্দিন নুর বেগমের প্রাপ্ত অংশসহ নামজারি খতিয়ান সৃজন করেন। এর আগে নামজারি খতিয়ান সৃজন করেন আনোয়ারা বেগম।

এদিকে ২০১৭ সালে ওই জমি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করে সরকার৷ নুর বেগমের প্রাপ্ত অংশের ক্ষতিপূরণ পেতে তৎপরতা শুরু করেন জসিম উদ্দিন। বিষয়টি জানতে পেরে খতিয়ান দুটি বাতিলের জন্য ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হাটহাজারী উপজেলার তৎকালীন এসি ল্যান্ড সম্রাট খীসার কাছে আবেদন করেন (নামজারি পুনর্বিবেচনা মামলা নং-১৫৭/২০১৯) আবদুল মোনাফ এবং তার মেয়ে মিনু আক্তার। তিন বছরের বেশি সময় ধরে আব্দুল মোনাফ এসি ল্যান্ড অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও তার মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। বিভিন্ন কর্মকর্তার হাত ঘুরে দেড়বছর ধরে তার মামলার ফাইলটি দেখাশোনা করছিলেন বিজয় নন্দন বড়ুয়া। কিন্তু তিনি নানা অজুহাতে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা না করে ফাইলটি আটকে রাখেন বলে অভিযোগ মিনু আক্তারের।

‘বাবার সাথে দুর্ব্যবহারের পরের দিনই এসি ল্যান্ড স্যারকে ভুলভাল বুঝিয়ে খতিয়ান বাতিলের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে আমার বাবা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত হক ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে হেরে যান বাবা। দুর্ব্যবহারের ঘটনার দেড়মাস পরে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বাবা।’ বলেন মিনু আক্তার।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বিজয় বড়ুয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ওনার সাথে খারাপ আচরণ করিনি। ওনি উল্টো আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন। আমাকে গালি দিলে আমিও রাগের মাথায় তাকে বেয়াদব বলেছি। আর তাকে অফিস থেকে বের করে দিতে বলছি। বাঁধার কথা, মারার কথা বলিনি।’

জানতে চাইলে হাটহাজারীর সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি ল্যান্ড) আবু রায়হান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। কেউ আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দেননি। যে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তারা আমার দপ্তরের স্টাফ। ইতিমধ্যে তাদের বদলি আদেশ হয়েছে। আগামী সপ্তাহে হয়তো কার্যকর হবে। যারা অভিযোগ দিচ্ছেন তাদের উচিত জেলা প্রশাসক স্যার অথবা আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া৷ তখন আমরা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারব।’