শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

অভিযোগ সত্য, তবুও ঔষধ প্রশাসন ও পুলিশের যোগসাজশে ‘দায়মুক্তি’

প্রকাশিতঃ ২৭ মার্চ ২০২৩ | ১:৫১ অপরাহ্ন


শরীফুল রুকন : অনুমোদিত মোড়কসামগ্রী ও লেবেল ব্যবহার না করে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী স্বনামধন্য ওষুধের মতো মোড়কসামগ্রী ও লেবেল ব্যবহার করে বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাত করার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফার্মিক ল্যাবরেটরিজের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল র‌্যাব। উক্ত অভিযোগের সত্যতা থাকলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যোগসাজশে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। ফলে আসামিদের খালাস দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করেছেন আদালত।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ২০২২ সালের ৪ আগস্ট ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক সফিকুল ইসলামের কার্যালয়ে যান এ প্রতিবেদক। প্রসঙ্গটি তুলে ধরার পর তিনি ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক সাখাওয়াত হোসেন রাজু আকন্দকে ডেকে এনে প্রতিবেদকের কাছে থাকা কাগজপত্র দেখতে বলেন। তিনিও সব ছবি তুলে নেন। যদিও ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর খুলশী থানায় মামলাটি দায়ের হওয়ার সময় ও পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় এই দুই কর্মকর্তার কেউই চট্টগ্রামে দায়িত্বরত ছিলেন না।

অভিযোগের স্বপক্ষে নথিপত্র তুলে ধরার পর অবাক হয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক সফিকুল ইসলাম বলে উঠলেন, ‘আপনি এই কাগজপত্র পেলেন কীভাবে?’ এসব কাগজপত্র তদন্তকারী কর্মকর্তা ‘হয়তো ভুলে’ আদালতে জমা দিয়েছেন, যার কারণে অনিয়মটি ধরা পড়েছে- বলার পর তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো।’ ঔষধ প্রশাসনের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে যাওয়ার দুইদিন পর ৬ আগস্ট বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটে ফার্মিকের জিএম পরিচয়ে ফিরোজ রনি নামের এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে ফোন করেন। তিনি বলেন, ‘আপনি ঔষধ প্রশাসনে গিয়েছিলেন, কোনো তথ্য কী লাগবে বা অন্যকিছু।’ অর্থ্যাৎ অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, উল্টো ফার্মিকের কাছে সোর্সের পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

অনুমোদিত লেবেল ব্যবহার না করে অন্য কোম্পানির ওষুধের মত মোড়কসামগ্রী-লেবেল ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করা এবং এই অভিযোগের সত্যতা থাকার পরও এ সংক্রান্ত মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্মিকের জিএম পরিচয় দেওয়া ফিরোজ রনি সদুত্তর দিতে পারেননি। একই ঘটনায় খুলশী থানায় দায়ের হওয়া সেই মামলার এক নম্বর আসামি ফিরোজ রনি জানান, সামনাসামনি দেখা হলে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারবেন তিনি। দেখা করার জন্য ২০২২ সালের ১১ আগস্ট ঠিক করা হয়। সেদিন দুপুর ১টায় নগরের চেরাগি পাহাড় মোড়ের ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে দেখা হওয়ার পর ফিরোজ এ প্রতিবেদককে ঘুরেফিরে বলতে থাকেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের ওষুধ কোম্পানি, আমাদের সহায়তা করুন। যেকোনো সহযোগিতা লাগলে আমাকে বলতে পারবেন। অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক। আমরা যা করেছি, আইন অনুযায়ী করেছি।’ আইন দেখাতে বললে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবেন এবং পরে আবার দেখা করবেন বলে জানান।

উক্ত ঘটনার শুরু যেভাবে– ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের খুলশী ৩ নং রোডে ফার্মিকের কারখানায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ঔষধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক সালমা সিদ্দিকাও উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের অভিযানে ফার্মিকের দুই কর্মী ফিরোজ রনি (৩৪) ও বাসু নাথকে (৩৩) গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় ৮ নভেম্বর খুলশী থানায় দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় গ্রেপ্তার দুইজন ও প্রতিষ্ঠানটির মালিক আহমেদ রবিন ইস্পাহানির বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, “জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করে যে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত ওষুধের মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে থাকা লেবেল ব্যবহার না করে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ওষুধের মোড়কের উপর এবং ওষুধের পাতার উপর দেশের স্বনামধন্য সুনাম অর্জনকারী ওষুধের ন্যায় লেবেল ব্যবহার করে উক্ত ওষুধ বাজারজাত করে জনসাধারণকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে।”

মামলার বাদী র‌্যাবের এসআই মো. মনিরুজ্জামান এজাহারে আরও লিখেছেন, “গ্রেপ্তারকৃতরা ঔষধ প্রশাসনের লোকজনসহ আমার সামনে কিছু ওষুধের কাগজপত্র উপস্থাপন করে। এগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওমিপ্রাজল লেখা নাম মূলত মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে লেবেলে বাণিজ্যিক নাম ‘সিটো’ নামে বড় অক্ষরে লিখে তার নিচে ক্ষুদ্রাক্ষরে ‘ওমিপ্রাজল ইউএসপি’ লেখাযুক্ত ওষুধ প্রস্তুত করে বাজারজাত করার অনুমোদন থাকলেও গ্রেপ্তার আসামিরা তা না করে মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে ‘ওমিপ্রাজল’ লেখা ওষুধ বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করে। ‘প্যারাসিটামল এক্সট্রা’ লেখা ওষুধ মূলত মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে লেবেলে বাণিজ্যিক নাম ‘এনাপল প্লাস’ নামে বড় অক্ষরে লেখাযুক্ত ওষুধ প্রস্তুত করে বাজারজাত করার অনুমোদন থাকলেও গ্রেপ্তার আসামিরা তা না করে মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে ‘প্যারাসিটামল এক্সট্রা’ লেখা ওষুধ বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করে। ‘মেট্রোনিডাজল ৪০০’ লেখা ওষুধ মূলত মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে লেবেলে বাণিজ্যিক নাম ‘মীনাজল’ নামে বড় অক্ষরে লেখাযুক্ত ওষুধ প্রস্তুত করে বাজারজাত করার অনুমোদন থাকলেও গ্রেপ্তার আসামিরা তা না করে মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে ‘মেট্রোনিডাজল ৪০০’ লেখা ওষুধ বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করে। ‘প্যান্টোপ্রাজল-২০’ লেখা ওষুধ মূলত মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে লেবেলে বাণিজ্যিক নাম ‘প্যান্টোপ্রাক্স-২০’ নামে বড় অক্ষরে লেখাযুক্ত ওষুধ প্রস্তুত করে বাজারজাত করার অনুমোদন থাকলেও গ্রেপ্তার আসামিরা তা না করে মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে ‘প্যান্টোপ্রাজল-২০’ লেখা ওষুধ বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করে। ‘রিবোফ্লাবিন’ লেখা ওষুধ মূলত মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে লেবেলে বাণিজ্যিক নাম ‘রিবোফোলসিন’ নামে বড় অক্ষরে লেখাযুক্ত ওষুধ প্রস্তুত করে বাজারজাত করার অনুমোদন থাকলেও গ্রেপ্তার আসামিরা তা না করে মোড়ক ও ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে ‘রিবোফ্লাবিন’ লেখা ওষুধ বাজারজাত করে জনসাধারণের নিকট থেকে অবৈধ লাভবান হওয়ার আশায় প্রতারণার মাধ্যমে জনসাধারণের টাকা আত্মসাৎ করছে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।”

র‌্যাবের দায়ের করা উক্ত মামলায় মোড়ক নয়-ছয় করে তৈরি করা ৪ লাখ ১ হাজার ৫০০টি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল জব্দ করার বিবরণও দেওয়া হয়। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সেই ওষুধগুলোর মোড়ক ও পাতা অনুমোদনের কপি উপস্থাপন করে ফার্মিক; যা আদালতে জমা দিয়েছেন তিনি। মোড়ক ও পাতা অনুমোদনের সেই কপিগুলোর সঙ্গে র‌্যাবের মামলায় করা অভিযোগের পুরোপুরি সত্যতা রয়েছে। অর্থ্যৎ অনুমোদিত মোড়ক ও লেবেল ব্যবহার করেনি ফার্মিক। এমনকি এখনও অনুমোদিত মোড়ক ও লেবেল ব্যবহার করছে না ফার্মিক। যে ওষুধগুলোর জন্য র‌্যাব মামলা করেছে, সেগুলো এখনও বাজারে দেখতে পেয়েছেন এ প্রতিবেদক।

এরপরও ফার্মিকের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হয়নি উল্লেখ করে ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও খুলশী থানার এসআই জাহেদ পারভেজ তালুকদার। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সালমা সিদ্দিকা ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তাসহ বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি যে, ওষুধের মোড়কে এবং ওষুধের পাতার পেছনে বড় অক্ষরে জেনেরিক নাম এবং ছোট অক্ষরে বাণিজ্যিক নাম লিখে ওষুধ বাজারজাত করায় জনগণ প্রতারিত হচ্ছে না। এমনকি এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোন অভিযোগ কিংবা আইনগত কোন বিধি নিষেধ নাই।”

অথচ ওষুধ আইন, ১৯৪০ এর ৯(ঙ) ধারায় উল্লেখ আছে, “ওষুধে অনুমোদিত লেবেল না থাকলে সেটি ‘মিসব্রান্ডেড’ ওষুধ বলে গণ্য হবে। একই আইনের ১৩(ক) ধারায় ‘মিসব্রান্ডেড’ ওষুধের শাস্তি হিসেবে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত ও জরিমানা করার বিধান আছে।” অথচ ফার্মিকের বেলায় এই আইন মানা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই জাহেদ পারভেজ তালুকদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলাটির বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের মতামত চেয়েছিলাম, তারা তখন বলেনি যে ফার্মিক আইনভঙ্গ করেছে। তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।’ ঔষধ প্রশাসন না বললেও মোড়কসামগ্রী অনুমোদনের কাগজপত্র দেখেই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়- প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ের জন্য ঔষধ প্রশাসন হচ্ছে এক্সপার্ট। তারা আইনভঙ্গের বিষয়টি বলেনি। তাই এটা হয়ে গেছে।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্মিকের বিষয়ে মতামত প্রদানকারী ঔষধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক (বর্তমানে ফেনীতে কর্মরত) সালমা সিদ্দিকা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলাটি মনে হয় এখনো শেষ হয়নি। আমি জানি না, খবর নিচ্ছি।’ আপনার মতামতের উপর ভিত্তি করে অপরাধের প্রমাণ না পাওয়ায় পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ায় মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে জানালে সালমা সিদ্দিকা বলেন, ‘পুলিশ আমার কাছ থেকে মতামত চায়নি, আমাদের অফিস থেকে চেয়েছে, তাই অফিস থেকে মতামত দেয়া হয়েছিল। পুলিশের কিছু কোয়ারি ছিল, সেই কোয়ারি অনুযায়ী আমরা উত্তর দিয়েছিলাম। আর এটা আমাদের অভিযান নয়, র‌্যাব একটা অভিযোগ পেয়েছিল, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানটা তারা করেছিল। আমাদের কাছে ফার্মিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, সেটা পুলিশকে বলা হয়েছিল আরকি। আচ্ছা, আমি দেখতেছি, কোম্পানিকে ফোন দিয়ে মামলা শেষ হয়েছে কিনা দেখছি।’

জানতে চাইলে মামলাটির বাদী র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের এসআই মো. মনিরুজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কিনা আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে কিছু করার থাকলে করবো।’

অভিযোগের সত্যতা থাকার পরও দায়মুক্তি দেওয়া ও এ বিষয়ে খবর নিতে যাওয়ার তথ্য কোম্পানির কাছে পাচার করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক আইয়ুব হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো। এ ধরনের আর কোনো খবর থাকলে সরাসরি আমাকে জানাতে পারেন। আমি ব্যবস্থা নেব।’

শুধু এই অভিযোগই নয়, ফার্মিকের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকে অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, সিরাপ পুনরায় প্যাকেট ও বোতলজাত করা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং অনুমোদনহীন ওষুধ উৎপাদনের দায়ে ফার্মিক ল্যাবরেটরিজের কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কারখানার প্ল্যান্ট ব্যবস্থাপক সাধন বিশ্বাসকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি ওই ওষুধ কারখানাকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সে সময় কারখানায় মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছিল। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক ওষুধ তৈরি করা ওষুধের সঙ্গে সংরক্ষণকক্ষে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আবার একই ব্যাচ নম্বরের ওষুধের প্যাকেটের গায়ে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের ভিন্ন ভিন্ন তারিখ লেখা ছিল। এ ঘটনার পর ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট ফার্মিকের এন্টিবায়েটিক বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফার্মিকের ওষুধ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয় উচ্চ আদালত। আরও বিভিন্ন সময় ওই ওষুধ কারখানায় প্রশাসনের অভিযানে জরিমানা-মামলা হয়েছে। এতকিছুর পরও ফার্মিকের ‘ওষুধ’ উৎপাদন থেমে নেই। তাদের উৎপাদন লাইসেন্স ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নবায়ন করা রয়েছে। এই সুযোগে অন্য প্রতিষ্ঠানের মোড়ক সামগ্রী নকল করে ওষুধ তৈরি করে আসছে ফার্মিক।

অবৈধ ওষুধ তৈরির কারখানার হোতাদের বিরুদ্ধে গাছাড়া তদন্ত, দায়সারা চার্জশিট

ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে কর্মরত চিকিৎসক দম্পতিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পাহাড়তলী থানা পুলিশ। ওই দিন বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলীর মুনসিপাড়া এলাকায় কথিত লেক্সিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের কারখানায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কারখানাটি থেকে ভেজাল ওষুধ, ওষুধ তৈরির ৬ কেজি কাঁচামাল পিলেট ও যন্ত্রপাতি জব্দ করে পুলিশ ও ওষুধ প্রশাসন। পরে কারখানাটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।

সেদিন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন ওষুধ কারখানার তিন পরিচালক আবদুল জলিল, এ এইচ এম নজিরুল হক ও তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া এবং কারখানার কর্মচারী দুই ভাই আল আমিন ও রুহুল আমিন। তাদের মধ্যে নজিরুল হক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উত্তর কাট্টলী আলিমউল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এবং তার স্ত্রী উত্তর কাট্টলী মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। এ ঘটনায় কারখানার মালিক ও কর্মচারীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-গ(১)(ঘ) ধারায় চার্জশিট দেন পাহাড়তলী থানার এসআই মো. মতিউর রহমান।

কিন্তু আদালত চার্জশিট গ্রহণ না করে ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর এসআই শহিদুল ইসলাম। উক্ত চার্জশিটও গ্রহণ না করে ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর পিবিআইকে আবার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। একই বছরের ২৯ অক্টোবর পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক নুর আহমদ তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি ট্রেনিংয়ে গেলে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী। তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবৈধ কারখানাটির মালিক, বিভিন্ন সময় শেয়ার হস্তান্তর করা ১৫ ব্যক্তি ও ২ কর্মচারীসহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন পরিদর্শক এনামুল।

মামলার অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনার দিন চিকিৎসক দম্পতিসহ গ্রেপ্তার হওয়া ৫ জন ও ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর আব্দুর রউফ নামের একজন ছাড়া আর কোনো আসামিকে থানা পুলিশ ও পিবিআইয়ের চার তদন্তকারী কর্মকর্তার কেউই গ্রেপ্তার করতে পারেননি। রউফকে দুইদিনের রিমান্ডে চাইলে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। গ্রেপ্তার চিকিৎসক দম্পতিসহ বাকি ৫ জন আদালতে জবানবন্দি দেওয়া দূরে থাক, তাদেরকে রিমান্ডে নিতে আবেদনও করা হয়নি। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ওই অবৈধ কারখানা থেকে উদ্ধার করা হলেও সেগুলোর উৎস চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়নি। আসামিরা কীভাবে ওষুধ তৈরির এসব কাঁচামাল পেয়েছে, তাও উঠে আসেনি তদন্তে। চার্জশিট প্রদানের পর সাড়ে ৪ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত বিচার দূরে থাক আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন পর্যন্ত হয়নি।

আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, ওই কারখানা থেকে জব্দকৃত ‘ইসোলেক্স’ ওষুধ, ১০০ গ্রাম কাঁচামাল, ৫টি খালি ক্যাপসুল ও ৫০ গ্রাম ক্যাপসুল পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠান প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মতিউর রহমান। কিন্তু এসব আলামত পরীক্ষা না করেই ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ পুলিশকে প্রতিবেদন দিয়ে দেয়া হয় সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরী থেকে; এতে মন্তব্য করা হয়, “প্রেরিত নমুনাগুলো আনরেজিস্ট্রার্ড বিধায় নমুনাগুলো অবৈধ। পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে না।” যদিও কাঁচামাল রেজিস্ট্রার্ড করার কিছু নেই, রেজিস্ট্রার্ড করা হয় ওষুধ।

এছাড়া জব্দ করা ৬ কেজি ‘কাঁচামাল পিলেট’ এর সুনির্দিষ্ট নাম মামলার নথিতে পুলিশও উল্লেখ করেনি। এমন অবস্থায় পরীক্ষা না করেই ‘আনরেজিস্ট্রার্ড’ বলা দূরে থাক, কাঁচামালের নাম জানা গেল কীভাবে- জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরীর পরিচালক এমডি কাইয়ুম বলেন, ‘আমার অফিস থেকে প্রতিবেদন দিলেও আমি তখন দায়িত্বে ছিলাম না। তবে কাঁচামালের নাম উল্লেখ করে জমা দিলে তখন সেটা বাংলাদেশে আমদানির অনুমতিপ্রাপ্ত কিনা আমরা জানতে পারি। ওই কাঁচামালের নাম পুলিশ দেয়নি হয়তো, তাই আনরেজিস্ট্রার্ড বলা হয়েছে। আর কাঁচামাল কী সেটা পরীক্ষা করে দেখার সুবিধা এখানে তখন ছিল না।’

ওষুধ ও কাঁচামাল পরীক্ষা যথাযথভাবে না হওয়া ও আসামিরা জবানবন্দি না দেওয়ায় এই মামলার ভবিষ্যৎ কী জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘আদালত সাজা দেয় সাক্ষ্য ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। প্রমাণ উপস্থাপন করা না গেলে ও আসামিরা জবানবন্দি না দিলে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন।’

অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানাধীন লালখান বাজার হাই লেভেল রোডে ‘একুয়ারা ফার্মা’ নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। সেখান থেকে ২৮ ধরনের ভেজাল ওষুধ, কৌটা ও ওষুধের লেবেল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় মো. সাইদুল ইসলাম (৩৮) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় সাইদুলের বিরুদ্ধে খুলশী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এ মামলায় সাইদুলকে দুইদিন রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি আদালতে জবানবন্দি দেননি। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর সাইদুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া। এছাড়া চার্জশিট দেওয়ার পর ৪ পার হলেও এখনও মামলার চার্জগঠন হয়নি। ৭ম যুগ্ম মহানগর জজ আদালতে মামলাটি রয়েছে।

আসামির জবানবন্দি থাকলে এই মামলার অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা সহজ হতো বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘নকল-ভেজাল ওষুধ উদ্ধারের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হলেও চূড়ান্তভাবে এসব মামলার ফল ভালো পাওয়া যায় না। আসামিদের জবানবন্দি থাকে না, অনেকেই সাক্ষ্য দিতে হাজির হয় না। তাই আসামিরা পার পেয়ে যায়। নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে দায়ের করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। অনেক সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ছোটখাটো সাজা ও জরিমানা হয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে এরাই আবার অপরাধে জড়ায়।’

এক ট্রাক নকল-অবৈধ ওষুধের জন্য সাজা দুই মাস জেল

১৪ জুলাই, ২০২২। সময় বেলা ১২টা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. সফিকুল ইসলামের কার্যালয়ে যান এ প্রতিবেদক। গত এক বছরে আপনাদের সাফল্য কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নকল, ভেজাল, আনরেজিস্টার্ড ও আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির দায়ে গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চট্টগ্রামে ৭৪টি মোবাইল কোর্ট মামলা হয়েছে। জরিমানা হয়েছে ২১ লাখ টাকার বেশি। জব্দ করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকার মালামাল বা ওষুধ।’ এর মধ্যে কী কী নকল ওষুধ, কী সংখ্যক ধরা পড়েছে জানতে চাইলে উপপরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নকল-ভেজাল ওষুধ বলি না। নকল-ভেজাল পরীক্ষা ছাড়া বুঝা যায় না। তাই আমরা বলি, আন রেজিস্টার্ড, মিসব্র্যান্ডেড- টেকনিক্যাল ভাষা হচ্ছে এটা। মিসব্যান্ডেড মানে হচ্ছে, যা বানানোর কথা তা বানানো হয়নি। এটাই নকল। আইনের ভাষায় বলে মিসব্র্যান্ডেড। ফেইক মেডিসিনের ব্যাপারে আইনটা সেভাবে লেখা নেই, লেখা আছে মিসব্র্যান্ডেড ওষুধের কথা।’

‘গত নভেম্বরে এক ট্রাক নকল ওষুধ পেয়েছি। বায়েজিদ লিংক রোড ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে টোল রোডে শাহপিন নামক স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা আছে। সেখানে এলোপ্যাথিক, ইউনানি- সব মিলে এক ট্রাক অবৈধ ওষুধ পেয়েছি। এসব ওষুধ সেখানে তিনটি গোডাউনে স্টোর করেছিল হারুন নামের এক লোক। তাকে ২ মাস কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ২০ লাখ টাকার মত ওষুধ ছিল। এক ট্রাক। বলতে গেলে আমার গলায় ফাঁস। এই মাল উঠাবে কে? তিন গোডাউন থেকে মাল, বিশেষ করে তরল জাতীয় ওষুধের তো ওজন বেশি। শেষে আবার লেবার নিলাম চারজন। জব্দ করা ওষুধের লিস্ট করে রাত ১টায় পুড়িয়ে আমরা এসেছি। অপারেশন শুরু হয়েছে বিকাল সাড়ে ৩টায়। রাত ১টায় শেষ হয়েছে। আলামত হিসেবে কিছু স্যাম্পল রেখে দিয়েছি, বাকিগুলো পুড়িয়ে ফেলেছি। সেখানে ওষুধ ছিল, শতাধিক পদের।’ ওই মামলার কাগজপত্র চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলার কাগজ দেওয়া যাবে না। এগুলো কনফিডিন্সিয়াল।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে অনেক ঘোরাঘুরির পর মোবাইল কোর্টের সেই মামলার কাগজ তুলে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের বিবিরহাট এলাকায় উক্ত মোবাইল কোর্ট চালানো হয় বলে উল্লেখ আছে। অথচ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. সফিকুল ইসলামের দাবি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে টোল রোডে শাহপিন নামক স্থান থেকে এক ট্রাক ওষুধ জব্দ করা হয়। যদিও এক ট্রাক ওষুধ জব্দের কথা মামলায় উল্লেখ করা হয়নি; সেখানে ৫৪ ধরনের ‘মিসব্র্যান্ডেড’ ওষুধ জব্দের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

মোবাইল কোর্টের ওই মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, অপরাধ স্বীকার করায় মো. হারুনকে ২ মাস কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন হারুন। কিন্তু মোবাইল কোর্টের রায় যথাযথ হয়েছে উল্লেখ করে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আপিল নাকচ করে দেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এখন প্রশ্ন উঠছে, ‘এক ট্রাক ভেজাল ওষুধসহ’ ধরা পড়া হারুনের শাস্তি ২ মাস সাজা ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কী যথেষ্ট? যেখানে ইভটিজিং করলেই ৬ মাস-এক বছর কারাদণ্ড দেওয়ার নজির অহরহ।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-২০২১ অনুযায়ী, গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ঔষধ প্রশাসনের সহযোগিতায় ১ হাজার ৭১৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে ৭ কোটি ৫৮ লাখ ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার ১৫৩ টাকার অবৈধ ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে ৪৯ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ১৮টি ফার্মেসি সিলগালা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এখনো এই আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে কেউ শাস্তি পেয়েছেন এমন নজির নেই। এই আইনে মামলা হয় খুবই কম। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়। তাই নকল ও ভেজাল ওষুধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ঔষধ প্রশাসনও তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আইনি দুর্বলতার কারণে নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ হচ্ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রস্তুতকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম যে, তাতে অপরাধ এবং অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

চট্টগ্রামের ড্রাগ আদালতে ৩৩ বছরে ১০ মামলা

১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের একমাত্র ড্রাগ আদালত ভেজাল ও নকল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর গত ৩৩ বছরে ওই আদালতে ১৯৮২ সালের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে মাত্র ১০টি। ২০১৪ সালের পর ড্রাগ আদালতে আর মামলা হয়নি।

ড্রাগ আদালতের মামলার রেজিস্ট্রার দেখে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ড্রাগ আদালতে পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে প্রথম মামলায় ৫০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়; দ্বিতীয় মামলায় ৪০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মামলাটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয়।

১৯৯০ সালে কোন মামলা হয়নি। ১৯৯১ সালে একটি মামলা হয়; তবে মামলাটিতে সাক্ষী হাজির করতে পারেননি বাদী, তাই খারিজ করে দেন বিচারক। এরপর ১৯৯২, ৯৩ ও ৯৪ সালে কোন মামলা হয়নি ড্রাগ আদালতে। ১৯৯৫ সালে একটি মামলা হয়; কিন্তু মামলার ফলাফল কী হয়েছে তা রেজিস্ট্রারে উল্লেখ নেই। ১৯৯৬ সালে একটি মামলা হয়; মামলাটি ১৯৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি মামলাও হয়নি চট্টগ্রামের ড্রাগ কোর্টে।

২০১৪ সালে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে প্রথম মামলায় এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর। দ্বিতীয় মামলাটি প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয় ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর।

ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং ওই ওষুধ সেবনে কারও মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ১০ বছর জেল ও দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কেবল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ ড্রাগ আদালতে মামলা করতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নকল-ভেজালকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না।

চট্টগ্রামের ড্রাগ আদালতে মামলা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসনের চট্টগ্রামের উপরিচালক সফিকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ড্রাগ কোর্টে মামলা না করলেও গত বছর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দুটি মামলা হয়েছে।’ ড্রাগ আদালতে আরও মামলা করা যেত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইল কোর্টে মামলা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।’ বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলার নাম্বার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কনফিডিন্সিয়াল তো তাই মামলার নাম্বার দেওয়া যাচ্ছে না।’ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে চলা মামলাগুলোর নাম্বার চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলার নাম্বার দেওয়া যাবে না। এগুলো কনফিডিন্সিয়াল!’

কোর্টে বিচারাধীন মামলার নাম্বার ‘কনফিডিন্সিয়াল’ হয় কী করে প্রশ্ন করলে সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোর্ট থেকে নিয়ে নেন। আমার কাছে মামলার নাম্বার নেই। আমাদের সহকারী পরিচালক সালমার কাছে ছিল। তিনি এখন ফেনী বদলি হয়ে গেছেন।’ আপনার অধীনস্ত সহকারী পরিচালক, ঔষধ তত্ত্বাবধায়কের কাছেও তো মামলার তথ্য থাকবে বললে, তিনি বলেন, ‘ওনার আলমারিতে থাকবে।’ আবার পরক্ষণে বলেন, ‘যার মামলা তার কাছেই তথ্য থাকবে। এখানে সিস্টেম হলো আমি যদি মামলা করে যাই, আমি চলে গেলেও আমাকে স্বাক্ষী দিতে আসতে হবে।’ কিন্তু মামলার নাম্বার তো অফিসেই থাকবে বললে তিনি বলেন, ‘না, মামলার নাম্বারও থাকবে না। এটা খুব জটিল! যিনি মামলা করবেন, তিনিই জানবেন, এসব তার হেফাজতেই রাখতে হবে। অন্য কেউ কিছুই করতে পারবে না। মামলা ছাড়া অন্য কোন কথা থাকলে বলুন।’

অভিযোগ রয়েছে, ঔষধ প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশে নকল ও ভেজাল ওষুধের সঙ্গে জড়িতরা ড্রাগ আদালতের মামলার আওতায় আসছে না। আবার বিষাক্ত ওষুধ সেবনে মৃত্যুর ঘটনায় ড্রাগ আদালতে মামলা হলেও সবক্ষেত্রে শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তদন্তে দুর্বলতার কারণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের পার পেয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। আদালতের রায়েও এ পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। বিষাক্ত প্যারাসিটামল সেবন করে ২০০৯ সালের জুন থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ২৮ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সব আসামিই খালাস পেয়ে গেছেন। ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকার বিভাগীয় ড্রাগ আদালত আসামিদের খালাস দেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। তাই আসামিদের খালাস দেওয়া হলো।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে অপরাধীরা শাস্তি থেকে রেহাই পায় বলে অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’