রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

থামানো যাচ্ছে না পাহাড় ও ফসলি জমির মাটি কাটার মহোৎসব

প্রকাশিতঃ ২৫ মে ২০২৩ | ১০:৫৬ অপরাহ্ন


কাউছার আলম, পটিয়া (চট্টগ্রাম) : পটিয়ায় কোনোভাবেই থামছে না পাহাড় ও ফসলি জমির মাটি কাটার মহোৎসব। পরিবেশ আইন অমান্য করে দেদারছে মাটি কেটে বিক্রি করা হলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা আদায় করলেও তা আমলে নিচ্ছেন না মাটি ব্যবসায়ীরা। আর বিভিন্ন স্থানে মাটি সরবরাহে রয়েছে ড্রাম ট্রাক। মাটিবাহী এসব ভারী যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলে বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে।

উপজেলার শোভনদন্ডী এলাকায় একটি চক্র রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার কৃষকের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ছনহরা, হাইদগাঁও, বড়লিয়া, ভাটিখাইন, ধলঘাট, কচুয়াই, খরনা, কেলিশহর এলাকার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাটি কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে।

জানা যায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বিভিন্ন পাহাড় ও কৃষিজমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে দুর্বৃত্তরা। মাঝে মধ্যে জরিমানা করে এবং পাহাড় ও কৃষি জমির মাটি কাটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এরা রাতের আঁধারে এসব অবৈধ কাজ করে। পরিবেশ আইন অমান্য করে প্রতিবছর এ মৌসুমে পটিয়ার বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে কৃষিজমির উর্বর মাটি কেটে সরবরাহ করা হচ্ছে ইটভাটায়, পুকুর ভরাট, বাড়ি ভিটা ভরাটের কাজে। এতে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। প্রতিদিন সন্ধ্যা হতেই চলাচল শুরু করে মাটিভর্তি শতাধিক ট্রাক, চলে রাতভর।

মাটিবাহী ট্রাকের প্রভাব পড়ছে সড়কগুলোতেও। কৃষিজমিগুলো থেকে রাতের আঁধারে মাটি কাটার এ প্রবণতা বছর দশেক ধরে চলছে পটিয়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে তা বেড়েছে বহুগুণ। এতে করে মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আইন অমান্য করে এস্কেভেটর কিংবা শাবল-কোদালে দিবা-রাত্রি চলছে ফসলি জমির মাটি ও পাহাড় কাটার মহোৎসব। পাহাড় কাটায় ছোট বড় ৮-১০ এস্কেভেটর দিয়ে বড় বড় পাহাড়গুলো কাটা হয়। ৫০ থেকে ৬০টি ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরযোগে এসব পাহাড়ি টিলার মাটি। সরকারের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে উপজেলার সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি মাটি কাটার সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরও কয়েকটি সিন্ডিকেট।

সিন্ডিকেটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও নেতারা। মূলত এ জনপ্রতিনিধি ও নেতারাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ মাটির ব্যবসার সুযোগ করে দেন। আর এর বিনিময়ে তাদের পকেটে ঢুকছে লাখ-লাখ টাকা।

স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর শত শত একর ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। যার কারণে পটিয়ায় দিন দিন আবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে। বেপরোয়া মাটি খেকোদের না রুখলে পটিয়ার আশপাশের পাহাড়গুলো অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ রয়েছে প্রাণহানীর আশংকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি জমির মালিকেরা বলেন, তাদের কৃষি জমি থেকে প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের চক্র মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তাতে তাদের জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি জমির মধ্যে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি
হওয়ায় তারা চলতি বোরো মৌসুমেও চাষাবাদ করতে পারেননি। চক্রটির লোকজনকে মাটি কাটতে নিষেধ করা হলেও তাঁরা শোনছেনা। বাধা দিতে গেলে তাঁদের বাহিনী দিয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

আরও জানা যায়, প্রতি ড্রাম ট্রাক পাহাড় কাটা মাটি বিক্রি করা হয় ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায়। আর কৃষি জমির মাটি বিক্রি হয় এক হাজার ৮৫০ টাকা। মাটি খেকো সিন্ডিকেট ইটের ভাটায় সরবরাহ করা এক ড্রাম ট্রাক মাটি বিক্রির এক হাজার ৮৫০ টাকার মধ্যে পায় ১৪শ টাকা আর ৪৫০ টাকা যায় সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক নেতাদের কাছে।

দলের নাম ভাঙ্গিয়ে পাহাড় ও কৃষি জমির মাটি কাটার বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ বলেন, কারও ব্যক্তিগত দায় আওয়ামী লীগ নেবে না। যারা এ বেআইনি কাজে নিয়োজিত আছে তারা নিজ দায়িত্বে এসব করছে। দল কাউকে এসবে সমর্থন বা সহযোগিতা দেয় না এবং দেবেও না।

মানবাধিকার ও পরিবেশ আইনজীবী জাফর হায়দার বলেন, ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনে টপসয়েল বা কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ আইনে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার
জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতিকুল মামুন বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মাটি কাটা ও পাহাড় কাটা বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা করা হয়েছে। গত রবিবার রাতেও পাহাড় কাটার অপরাধে একমাসের জেল জরিমানা করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্পনা রহমান বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা তাই
বেআইনি। মাটি কাটার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

চট্টগ্রাম পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতা সাংবাদিক আলিউর রহমান বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ফেলায় এর উর্বরতা হারিয়ে যায়। তবে ভূমিদস্যুরা যেভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছে, তাতে ওই সব এলাকার কৃষক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভূমি আইনে বলা আছে তিন ফসলি জমির কাঠামো পরিবর্তন, ভরাট কিংবা টপ সয়েল কাটা যাবে না। বিষয়টি স্থানীয়রা যদি লিখিতভাবে আমাদেরকে জানান তাহলে আমরা জেলা প্রশাসককে জানিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে পারব বলে জানান এ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতা।

পরিবেশ অধিপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, পাহাড় কাটা গুরুতর অপরাধ। তথ্য পেলে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওকে জানানো হবে। তবে কৃষি জমির মাটি কাটা সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে।