কমিশন বাণিজ্যে দ্বিগুণ রোগ নির্ণয়ের খরচ


রোগী! শব্দটা শুনলেই মমতায় ভরে ওঠে মন। আর যদি সেই রোগী হন সাধারণ কোনো মানুষ, তবে তার চেয়ে অসহায় মানুষ পৃথিবীতে আর নেই! একে তো রোগের যন্ত্রণা; তার ওপর চিকিৎসার খড়্গ। প্রথমেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে পান এক প্রেসক্রিপশন। তাতে লেখা কিছু ওষুধ আর টেস্ট। ওষুধ কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস; টেস্ট করাতে গিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। এর নেপথ্যে যে একশ্রেণীর চিকিৎসকের লোভ ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতিমুনাফার কালো অধ্যায় লুকিয়ে, তা ওই অসহায় রোগীর অজানাই থেকে যায়। জানা যায় সাংবাদিকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে। তিন পর্বের প্রতিবেদনের শেষ পর্ব আজ…।

শরীফুল রুকন : চিকিৎসকরা রোগীর প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লেখার জন্য শুধু যে ওষুধ কোম্পানি থেকেই টাকা পান তা নয়; রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ লিখে দিলেও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে পান মোটা অঙ্কের কমিশন। আবার ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের সূত্র ধরে রোগী ভাগিয়ে আনা দালালদের জন্যও থাকে কমিশন। এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই অশুভ কমিশন বাণিজ্যের লোভ থেকে যদি ডাক্তার-দালাল চক্রকে দূরে রাখা যেত, তাহলে রোগ নির্ণয় খরচ কমপক্ষে অর্ধেক কমে যেত। কিন্তু এই টাকার লোভ এতটাই সর্বগ্রাসী যে, চট্টগ্রামের কার্ডিয়াক চিকিৎসকদের সংগঠন রীতিমতো ‘বিদ্রোহ’ করে কমিশনের অংশ আরও বাড়িয়ে দিতে বাধ্য করেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে।

এসব অশুভ কমিশনের আবার গালভরা নামও রেখেছেন তারা; যেমন, হৃদরোগের নানান পরীক্ষার কমিশনকে বলা হয় ‘কনসালট্যান্ট ফি’। আর প্রেসক্রিপশন লেখা ডাক্তারদের কমিশনের নাম ‘রেফারেল ফি’। যে নামেই ডাকা হোক, এই কমিশনের টাকা শেষমেশ আদায় করা হয় রোগীর ‘গলায় পাড়া দিয়ে’।

বিদ্রোহ করে কমিশন বৃদ্ধি

ইকো কালার ডপলার। হৃদরোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে এটি একটি। চট্টগ্রামের প্রথম সারির ডায়াগনস্টিক সেন্টার এপিক হেলথকেয়ার ও পপুলার ডায়াগনস্টিকের চট্টগ্রাম শাখায় এই পরীক্ষার খরচ ৩ হাজার টাকা। চিকিৎসকের উপস্থিতিতে ইকো পরীক্ষা করার নিয়ম আছে। পরীক্ষাটি করতে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময় লাগে। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ইকো পরীক্ষার মূল্যের ৪০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ‘কনসালট্যান্ট ফি’ হিসেবে দিতে চট্টগ্রামের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে চিঠি দেয় হৃদরোগের ডাক্তারদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম সোসাইটি অব ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি (সিএসআইসি)’। অর্থ্যাৎ কালার ইকো পরীক্ষার জন্য রোগী ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে যে ৩ হাজার টাকা দেবেন, তার ৪০ শতাংশ হিসেবে ১ হাজার ২০০ টাকা চিকিৎসককে দিতে বলা হয়।

কিন্তু কিছু ল্যাব ওই ৪০ শতাংশের দাবি মানছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই গত ২৮ নভেম্বর হৃদরোগ চিকিৎসকদের কাছে একটি চিঠি পাঠান সিএসআইসির সভাপতি ডা. আশীষ দে ও সাধারণ সম্পাদক ডা. আনিসুল আউয়াল। ‘বিশেষজ্ঞ চিকিংসকদের কনসালট্যান্ট ফি ল্যাব মূল্যের আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি প্রসঙ্গে’ শিরোনামের ওই চিঠিতে বলা হয়, “কার্ডিওলজির সকল নন ইনভেসিভ পরীক্ষার মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সোসাইটি অব ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, অক্টোবর ২০২২ হতে সকল নন ইনভেসিভ পরীক্ষা (ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ইটিটি, হল্টার মনিটরিং, এবিপিএম) এর জন্য সম্মানিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের জন্য ল্যাব কর্তৃক ধার্যকৃত মূল্যের ৪০ শতাংশ ‘কনসালটেন্ট ফি’ হিসাবে প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু কতিপয় ল্যাব এই নির্ধারিত ফি এখনো কার্যকর না করায় সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এই ল্যাবগুলোতে কোনো প্রকার কার্ডিয়াক প্রসিডিউর না করার জন্য আপনাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হলো। উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছি।”

এই চিঠির পর দেখা যায় কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হৃদরোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ডাক্তারদের ‘কনসালট্যান্ট ফি’ হিসেবে ৪০ শতাংশ করে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো প্রতিটি পরীক্ষা বাবদ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা ‘রেফারেল ফি’ হিসেবে রোগীর প্রেসক্রিপশন লেখা ডাক্তারকে কমিশন দিচ্ছে। রেফারেল ফি সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ (৬০০ টাকা) ধরলেও এক ইকো পরীক্ষার ধার্য করা মূল্যের ৬০ শতাংশ বা ১ হাজার ৮০০ টাকা চলে যাচ্ছে দুই ডাক্তারের পকেটে। বাকি থাকে ৪০ শতাংশ (১ হাজার ২০০ টাকা) বা আরও কম; এই টাকাটাই মূলত একটি ইকো পরীক্ষা বাবদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পাচ্ছে।

ইকোর মতো হৃদরোগের অন্যান্য পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও কার্যত তা অনেক সময় হয় না। চিকিৎসক শুধু পরীক্ষার রিপোর্টটা দেখে সই করে দেন।

পপুলার ডায়াগনস্টিকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পপুলারের ঢাকার শান্তিনগর শাখায় ইকো কালার ডপলার পরীক্ষার জন্য ধার্য করা দাম ২ হাজার ৬০০ টাকা। এরমধ্যে কিছু ছাড়ও দেওয়া হয়। কিন্তু একই পরীক্ষার জন্য পপুলারের চট্টগ্রাম শাখার ধার্য করা দাম ৩ হাজার টাকা। দাম বাড়তি হলেও আমরা তেমন ছাড় দিতে পারি না। কারণ এই তিন হাজার টাকার মধ্যে কনসালটেন্ট ফি’র পাশাপাশি রেফারেল ফি দিতে হয়।’

হৃদরোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করানো ডাক্তারদের ‘কনসালট্যান্ট ফি’ ৪০ শতাংশ করে দিতে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিএসআইসি’র সভাপতি ডা. আশীষ দে বলেন, ‘হ্যাঁ, ৪০ শতাংশ করে দেওয়ার জন্য আমরা বলেছি।’ ঢাকায় ১০ শতাংশ ‘কনসালটেন্ট ফি’ নেওয়া হচ্ছে, চট্টগ্রামে ফি আরও কমানো গেলে রোগনির্ণয় ব্যয় কমবে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘১০ শতাংশ কোথাও নেই।’ আবার পরক্ষণে বলেন, ‘ঢাকায় কত শতাংশ, সিলেটে কত শতাংশ, আমি জানি না।’ কনসালটেন্ট ফি ৪০ শতাংশ করার ক্ষেত্রে নিজেদের পথিকৃৎ দাবি করে ডা. আশীষ বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা (৪০ শতাংশ) করার পর আমাদের দেখাদেখি সারা দেশে কার্ডিয়াক সোসাইটি এটা করার চেষ্টা করতেছে।’

ওই চিঠির প্রসঙ্গে এপিক হেলথকেয়ারের নির্বাহী পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) টি এম হান্নান বলেন, ‘এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য বারডেন (বোঝা)। ওটা যখন বাড়বে, পরীক্ষার দামও বাড়বে। দিন শেষে রোগীকেই বাড়তি খরচ গুনতে হবে।’

তবে চট্টগ্রাম বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ম্যাক্স হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান বলছেন, এভাবে ৪০ শতাংশ কনসালটেন্ট ফি নেওয়া অযৌক্তিক। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মিটিং করবো। দেখি কী করা যায়।’

আইডি খুলে কমিশন জমা

ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রেফারেল ফি’র নামে চিকিৎসকদের কী পরিমাণ কমিশন দেয়, তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে, ওষুধ কোম্পানি হেলথকেয়ার ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ইস্যু করা একটি অফার লেটার থেকে। ২০২১ সালের ১১ আগস্ট হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এরিয়া ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সই করা ওই অফার লেটারটি দেওয়া হয় রাজধানীর মিরপুরের নাসির হেলথকেয়ার ও ফিজিওথেরাপি সেন্টারের চেয়ারম্যানকে।

এতে বলা হয়, নাসির হেলথকেয়ার ও ফিজিওথেরাপি সেন্টারের চেয়ারম্যানের রোগীদের জন্য সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার (যেমন রক্ত, প্রস্রাব ও মল) জন্য ৫০ শতাংশ, ব্লাড কালচার পরীক্ষার জন্য ১৫ শতাংশ, এনসিভি, ইএমজি, বিএমডি, ইইজি, ইটিটি পরীক্ষার জন্য ২৫ শতাংশ, ভিটামিন-ডি, বি-১২, বিএনপি, প্রো-বিএনপি পরীক্ষার জন্য ৩০ শতাংশ, হল্টার মনিটরিং পরীক্ষার জন্য ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে। এছাড়া ইমেজিংয়ের (যেমন এক্স-রে, ইউএসজি, ইকো) উপর ২৫ শতাংশ ছাড়, সিটি স্ক্যানে (ব্রেন, চেস্ট, নেক, এইচআর সিটি) ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে (কেইউবি, পুরো পেট, সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাম) ৩ হাজার টাকা, এমআরআইয়ে (যেমন ব্রেন ব্রেন, মেরুদণ্ড) ৩ হাজার টাকা, এমআরআইয়ে (যেমন পুরো পেট, যেকোনো জয়েন্ট) ৪ হাজার টাকা, এমআরআই পুরো শরীর পরীক্ষায় ১০ হাজার টাকা ছাড় দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এরিয়া ম্যানেজার (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে আমরা এরকম অফার লেটার দিয়ে থাকি। ডাক্তার লিখে দিলে রোগীরা এই ছাড় পায়।’

নাসির হেলথকেয়ার ও ফিজিওথেরাপি সেন্টারের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমার রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক। আমি রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ছাড়ের বিষয়টি লিখে দিই। সে হিসেবে তারা সর্বোচ্চ ছাড় পেয়ে যান। ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আমি কোনো কমিশন নিই না। আমাকে যতটুকু ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সবটুকু আমি দিয়ে দিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসকদের অফার লেটার দিয়ে জানিয়ে দেয়, কোন পরীক্ষায় কত ছাড় দেওয়া হবে। ডাক্তার চাইলে নিজের জন্য বরাদ্দ করা পুরোটাই রোগীকে ছাড় দিয়ে দিতে পারেন। এখন কে পুরোপুরি ছাড় দেন, আর কে নিজের জন্য কিছু বা পুরোটা রাখার ব্যবস্থা করেন, সেটা তো আমি জানি না।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে হৃদরোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা ইকোকার্ডিওগ্রাফি (সাদা-কালো) করানোর খরচ ২০০ টাকা। একই পরীক্ষা করাতে চমেকের প্রধান ফটকে অবস্থিত বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এপিক হেলথকেয়ারে লাগছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। ইকো কালার ডপলার করতে এপিকে লাগছে ৩ হাজার টাকা। চমেকের প্রধান ফটকে থাকা পপুলার ডায়াগনস্টিকেও ইকো কালার ডপলার পরীক্ষার খরচ ৩ হাজার টাকা। কোথাও কোথাও আরও বেশি খরচ পড়ছে ইকো পরীক্ষা করতে। শুধু ইকো পরীক্ষা নয়, আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালগুলোর তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের খরচ অনেক বেশি। এর বড় কারণ অনেক চিকিৎসক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নেন। আর ওই কমিশনের টাকা উসুল করা হচ্ছে রোগীদেরই পকেট থেকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি রোগ নির্ণয়ের জন্য এপিক হেলথকেয়ারে যান মো. ওমর ফারুক নামে এক রোগী। সেদিন এমআরআইসহ রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য তার বিল আসে ১২ হাজার ৮৩৫ টাকা; ভাউচার নাম্বার ই২৩০২২৭৪০২৫৯। এর মধ্যে ৩ হাজার ২০০ টাকা ডিসকাউন্ট দিয়ে এপিক হেলথকেয়ার নেয় ৯ হাজার ৬৩৫ টাকা। ওমর ফারুকের রোগ নির্ণয় বাবদ তার প্রেসক্রিপশনে থাকা চিকিৎসকের কমিশন (রেফারেল ফি) ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ টাকা। কমিশনের এই টাকা জমা হয়েছে ডা. বিমলেন্দু চন্দ বিমলের আইডিতে। এক সময় আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্পের (ইউপিএইচসিপি) অধীনে চট্টগ্রাম সিটিতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। এখন চট্টগ্রাম নগরের জুবিলি রোডের এখলাস কমপ্লেক্সে একটি চেম্বার খুলে নিয়মিত রোগী দেখেন।

ডা. বিমলেন্দুর আরেক রোগী রাবেয়া আকতার গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রোগ নির্ণয়ের জন্য গিয়েছিলেন এপিক হেলথকেয়ারে। বিভিন্ন পরীক্ষা বাবদ সেদিন তার বিল আসে ৭ হাজার ৮৩৫ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫০ টাকা ডিসকাউন্ট দিয়ে এপিক নেয় ৫ হাজার ৮৮৫ টাকা। রাবেয়ার রোগ নির্ণয় বাবদ ডা. বিমলেন্দুর কমিশন ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা।

শুধু এই দুইজন নয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডা. বিমলেন্দুর ২০ জন রোগী এপিক হেলথকেয়ারে রোগ নির্ণয় করতে যান। তাদের বিল থেকে ১৪ হাজার ৮৪৫ টাকা কমিশন যুক্ত হয়েছে ডা. বিমলেন্দুর আইডিতে। এসব বিষয় উল্লেখ করে বক্তব্য জানতে চাইলে ডা. বিমলেন্দু চন্দ বিমল কিছু বলতে রাজি হননি। ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

এপিক হেলথকেয়ার থেকে ডাক্তার বিমলেন্দুর ১৬শ’ টাকা কমিশন গ্রহণের বিষয়টি জানালে তাঁর রোগী রাবেয়া আকতার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি একজন ডায়াবেটিসের রোগী। আরও নানা রোগ আছে। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারি না, ওষুধ কিনতে পারি না। ২০০ টাকা ফি নেওয়ায় ডাক্তার বিমলেন্দুর কাছে গিয়েছিলাম। ওনাকে তো আমি ফি দিয়েছি, তারপরও কমিশন কেন নেবে? নিলে আল্লাহ যেন বিচার করেন।’

শুধু যে ডাক্তাররা কমিশন নেন তা নয়, ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করা কিছু ব্যক্তি ও দালালরাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে কমিশন পান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের কম মূল্যে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করে দেওয়ার প্রলোভন দেখান মো. সোহরাব হোসেন। তার রেফারেন্সে ২০২১ সালের ২৩ জুন থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ২৪ জন রোগী এপিক হেলথকেয়ারে রোগ নির্ণয় করতে যান। তাদের মোট বিল আসে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪৭০ টাকা ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। বাকি ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৩০ টাকা ২৪ জন রোগীর কাছ থেকে আদায় করেছে এপিক হেলথকেয়ার। এই বিল থেকে ২৫ হাজার ৮৫৮ টাকা কমিশন যুক্ত হয় সোহরাবের আইডিতে। এ সংক্রান্ত রেফারেল ডিটেইলস রিপোর্ট আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এপিক হেলথকেয়ার থেকে কমিশন গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করেন সোহরাব হোসেন, তবে এখন নিষ্ক্রিয় বলে জানান তিনি। সোহরাব বলেন, ‘দুই-তিন মাস আগে কমিশন নিয়েছিলাম। এপিকের ইলিয়াছ আমার সাথে যোগাযোগ রাখে।’ এপিক হেলথকেয়ারে প্যাথলজি পরীক্ষায় ৩৫ শতাংশ ও ইমেজিংয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন পাওয়া যায় বলে স্বীকার করেন সোহরাব।

এপিক হেলথকেয়ারের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘কার রেফারেন্সে কোন মাসে কতজন রোগী এসেছেন, সব আমাদের সফটওয়্যারে সংরক্ষিত থাকে। ডাক্তারদের নামে আইডি করা থাকে। রেফারেল ফি বা কমিশন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের আইডিতে যুক্ত হয়। মাস শেষে সফটওয়্যার থেকে রেফারেল ডিটেইলস রিপোর্ট বের করে কমিশনের টাকাসহ হাতেহাতে আমরা দিয়ে আসি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ডাক্তার আছেন এতটাই লোভী, রেফারেল ডিটেইলস রিপোর্ট নিয়ে হইচই শুরু করে দেন, বলে বসেন ওই রোগীকে তো আমি এত ডিসকাউন্ট দিইনি। আপনারা দিলেন কেন? আবার দেখা যায়, তৃতীয় পক্ষ বা দালালরা রোগী নিয়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসকদের কমিশন কাটা যায়। আবার একেক পরীক্ষার জন্য একেক কমিশন। কিছু পরীক্ষায় ২০ শতাংশ, কিছু পরীক্ষায় ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পান ডাক্তাররা। এই কমিশন কম হলে বা কাটা গেলেও অনেক ডাক্তার বকাঝকা করেন। আমরা সামান্য চাকরি করি, কী আর বলবো? গালি শুনে চলে আসি।’

জানতে চাইলে এপিক হেলথকেয়ারের নির্বাহী পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) টি এম হান্নান বলেন, ‘আমরা কোনো দালালকে এপিকে পারমিট করি না। তবে ডাক্তারদের রেফারেল ফি’র যে কথাটি বলছেন, এটা শুধু এপিকে না, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে আছে। রেফারেল ফি আমাদের ইন্ড্রাস্টিতে ঢুকে গেছে। আমরা এখান থেকে বের হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেছি। এটা যদি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে করা হয়, অবশ্যই রোগীরা উপকৃত হবেন; আমরাও লাভবান হবো।’

চমেক হাসপাতালের প্রধান ফটকের পাশে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চট্টগ্রাম শাখা। এরাও চিকিৎসক ও দালালদের নিয়মিত রেফারেল ফি (কমিশন) দিয়ে আসছে। তাদের কমিশন দেওয়ার একটি নথি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ৯ জন দালাল নিজের নাম, মোবাইল নাম্বার দিয়ে সই করে বিভিন্ন অংকের কমিশন নিয়েছেন। পপুলারের স্টাফও এতে সই করেছেন।

গত ৬ মে মো. সিরাজ নামের একজন দালালকে ২০৯১৫৭ নাম্বার আইডির (একজন রোগীর আইডি নাম্বার) বিপরীতে ১ হাজার ২২০ টাকা কমিশন দিয়েছে পপুলারের চট্টগ্রাম শাখা। জানতে চাইলে সিরাজ বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘এগুলো তো ইন্টারনাল বিষয়। এসব কাগজপত্র আপনার কাছে কীভাবে গেল?’ এক প্রশ্নের জবাবে সিরাজ বলেন, ‘পপুলার প্যাথলজিতে ৩৫ শতাংশ ও ইমেজিংয়ে ২৫ শতাংশ কমিশন দেয় আমাকে। আমি সরাসরি পপুলারের ম্যানেজার ওয়ালী আশরাফ স্যারের সাথে ডিল করি।’

কমিশন বাণিজ্যের নানা তথ্য ফাঁস করে মো. সিরাজ বলেন, ‘পপুলারে ডাক্তার ছাড়া কাউকে আইডি বা কোড দেওয়া হচ্ছে না। এই আইডিতে সমস্ত কমিশন জমা হয়। আইডি থাকলে মাস শেষে এক সাথে সব কমিশন দেওয়া হয়, এর বিস্তারিত প্রিন্টও দেওয়া হয়। পপুলারে আমার আইডি না থাকায় যেদিন রোগী নিয়ে যাই, সেদিন কমিশন যা আসে তা আমাকে দেওয়া হয়। তবে এপিক হেলথকেয়ার ও শেভরণে আমাদেরকে আইডি দেওয়া হয়। ফলে খুচরা নেওয়া লাগে না, প্রিন্টেড কপিসহ মাসিক একটা অ্যামাউন্ট পাওয়া যায়। এভাবে রাউন্ড ফিগার হলে আমাদের জন্য সুবিধা। আমি পপুলারের ম্যানেজার স্যারকে বলেছিলাম আইডির কথা। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা অফিস দিতে না করেছে।’

শেভরণ নামের ডায়াগনস্টিক সেন্টার দালালদের প্যাথলজি পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ ও ইমেজিংয়ে ৩০ শতাংশ কমিশন দেয় বলে জানান সিরাজ। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রোগীকে ২০ শতাংশ ছাড় দিই আমরা। বাকি ১৫ বা ২০ শতাংশ আমি নিই। রোগীকেও তো সন্তুষ্ট করা লাগে।’

জানতে চাইলে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চট্টগ্রাম শাখার ম্যানেজার ওয়ালি আশরাফ খান সরাসরি অস্বীকার বসেন; বলেন, ‘আমরা কোনো রেফারেল ফি দিই না।’

‘আমাদের কাছে প্রমাণ আছে’— এটা বলার পর তার সুর পাল্টে যায়। তিনি আমতা আমতা করে বলেন, ‘এমন কিছু হয় কি না আমি জানি না। পরে ফোন দিয়েন’; বলেই কল কেটে দেন ওয়ালি আশরাফ।

তবে চিকিৎসকদের রেফারেল ফি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারস্থ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ‘ডা. মাহফুজুর রহমান’স ল্যাবের স্বত্বাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রেফারেল ফি’র ব্যাপারে আমি যে নীতিবান, সৎ এ কথা আমি দাবি করতে পারব না। চিকিৎসকদের রেফারেল ফি প্রদানের কাগজে আমাকেও সই করতে হয়। খামে করে রেফারেল ফি পাঠাতে হয়। রেফারেল ফি না দিয়ে উপায় নেই।’

কমিশনেই লালে লাল ডাক্তার

রেফারেল ফি থেকে চিকিৎসকদের আয় নিয়ে ধারণা দিয়েছেন চট্টগ্রামের আরেকটি বড় রোগ নির্ণয় কেন্দ্র শেভরণের একজন মালিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে অনেক নামিদামি চিকিৎসক চেম্বার করেন। ধরুন, সেরকম একজন ডাক্তার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৪০ জন রোগী দেখেন। গড়ে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা বিল আসে রোগীপ্রতি। চল্লিশকে ৫ হাজার দিয়ে গুণ করলে ২ লাখ টাকা আসে। গড়ে ৪০ শতাংশ ডাক্তারের নামে জমা হলে হয় ৮০ হাজার। কোনো কোনো বিশেষ রোগীর ক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো ২০-২৫-৩০ শতাংশ ডিসকাউন্টের কথা প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন। এভাবে কিছু কমলেও কমপক্ষে তাঁর ৬০ হাজার টাকা থাকে। মাসে ২৫ দিন চেম্বার করলে ওই ডাক্তার শুধু রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখেই আয় করছেন ৬০,০০০ গুনন ২৫ = ১৫ লাখ টাকা, প্রতি মাসে। এর সঙ্গে তাঁর রোগী দেখার ফি, ওষুধ কোম্পানি থেকে টাকা-গিফট তো আছেই!’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ডাক্তার মুখেই বলে দেন কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করতে হবে। আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেন না। কারণ শহরের যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই রোগী যাক না কেন, কমিশন ঠিকই ডাক্তারের কাছে পৌঁছে যাবে। বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারদের আইডি করা থাকে। ওই আইডিতে কমিশন জমা হয়। মাস শেষে কমিশনের টাকা তাঁরা পেয়ে যান।’

শেভরণের ওই মালিকের কথার সঙ্গে একমত এপিক হেলথকেয়ারের মার্কেটিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘এপিক থেকে মাসে আড়াই লাখ টাকা বা তারও বেশি পান, এমন অনেক ডাক্তার আছেন। এক ডাক্তারের সব রোগী তো এপিকে আসবেন না। এখানে শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে; যার যেখানে সুবিধা, আস্থা সেখানে যান। সে হিসেবে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একজন ডাক্তারের মাসে ১৫ লাখ টাকা পাওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘কমিশনের টাকা সরাসরি ডাক্তারদের হাতে দিয়ে আসা হয়। বিকাশ নাম্বারে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু লেনদেনের প্রমাণ না রাখতে তারা নগদ নিতে চান।’

প্রকৃত খরচ কত?

রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, থাইরয়েড হরমোন টিএসএইচ পরীক্ষার ক্ষেত্রে ৬০ টাকার রিএজেন্ট, ৫০ টাকার সহায়ক ম্যাটেরিয়াল, জনবল ও লজিস্টিক বাবদ ৫০ টাকাসহ সর্বোচ্চ খরচ হয় ১৬০ টাকা। একইভাবে লিপিড প্রোফাইলে ২৭৭ টাকা এবং হেপাটাইটিস নির্ণয়ে খরচ ১৯০ টাকা। অথচ এসব পরীক্ষায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারভেদে টিএসএইচ পরীক্ষায় ১৬০ টাকার বিপরীতে ৬০০-১১০০ টাকা, লিপিড প্রোফাইলে ৭৫০-১২০০ টাকা এবং হেপাটাইটিসে ৪৫০-১২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এভাবে একেকটি রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগীদের দিতে হচ্ছে প্রকৃত ল্যাব খরচের চেয়ে পাঁচ থেকে দশগুণ বেশি টাকা।

চমেক হাসপাতালে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মূল্য ৩০০ টাকা, ইউরিক এসিড পরীক্ষার দাম ১০০ টাকা। অন্যদিকে এপিক হেলথকেয়ার ও পপুলারে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা। ইবনে সিনায় তা ৭৫০ টাকা। একইভাবে ইউরিক এসিড পরীক্ষায় এপিক হেলথকেয়ার ও পপুলারে যেখানে ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে, সেখানে একই পরীক্ষায় ইবনে সিনায় নেওয়া হচ্ছে ২২৫ টাকা। অর্থাৎ প্রায় একই মানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগনির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার দামের পার্থক্যও বড়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পপুলার ডায়াগনস্টিকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একেক প্রতিষ্ঠানে একেক দাম হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণের একটি, রেফারেল ফি। এটা কেউ বেশি দেয়, কেউ কম দেয়। আমাদের এখানে বেশি রোগী আসে চুক্তিবদ্ধ চিকিৎসকদের মাধ্যমে। বাইরের চিকিৎসকদের রোগীও আসে। ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল সব চিকিৎসককেই রেফারেল ফি দিতে হয়। পরীক্ষা ভেদে রেফারেল ফিও ভিন্ন হয়। যেসব পরীক্ষায় রেফারেল ফি বেশি, চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবে সেগুলোই রোগীর প্রেসক্রিপশনে দেওয়ার চেষ্টা করেন; অনেক সময় যা অপ্রয়োজনীয়। চিকিৎসকদের কমিশনের লোভের কারণে রোগীর খরচ বেড়ে যায়।’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না অনেক চিকিৎসক। একজন চিকিৎসক বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষে সন্ধ্যায় আমি নিজের চেম্বারে বসি। দৈনিক ২০-২৫ জন রোগী দেখি। আমি রোগীকে বলি না, ওখান থেকেই পরীক্ষা করতে হবে। শুধু বলি ভালো ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করতে। এখন মাস শেষে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বিকাশে অল্প অল্প টাকা চলে আসে। এই টাকাটা আমি না নিলেও তো তারা রোগীর কাছ থেকে নিয়ে ফেলছে। তাদের টাকাগুলো আমি গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে ফেলি।’ এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অনেক ডাক্তার প্রথমবার তাদের কাছে আসা রোগীদের বেশ কয়েকটি প্যাথলজিকাল পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। অনেক সময় সাত-আটটি পরীক্ষা পর্যন্ত দেন। পরে দেখা গেল, স্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া গেছে। স্বাভাবিকভাবেই রোগীরা মনে করবেন যে, এই পরীক্ষাগুলো অপ্রয়োজনীয় ছিল। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নেন। এমন কিছু চিকিৎসক আছেন যারা এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত নন, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন না নেওয়ার জন্য বিএমএ’র পক্ষ থেকে নির্দেশনা দিয়েছিলাম। এটা করায় আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়েছে। তবুও এ নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে আমরা বসবো। এগুলো পত্রিকায় এলে দেশের ১ লাখ ২০ হাজার ডাক্তারের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।’

চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যোগসাজশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনেক মেশিন অকেজো করে রাখছে। একটা এমআরআই মেশিনের দাম ১৫-১৬ কোটি টাকা। ডেসলার মেশিন আছে, সেটা ১০ কোটি টাকা। এমআরআই পরীক্ষা একটা করতে ৮-১০ হাজার টাকা লাগে বেসরকারিতে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে লাগে ৩ হাজার টাকা। কিন্তু এমআরআই মেশিন তারা নষ্ট করে রেখেছে। এটা ঠিক করা হলে সর্বোচ্চ দুই মাস ঠিক থাকে। আবার নষ্ট করে ফেলে। কোবাল সিক্সটিন মেশিনও প্রায় সময় নষ্ট থাকে। আজকে কেউ কেমোথেরাপির জন্য গেলে সময় দেবে ৪-৫ মাস পর, ততদিনে অনেক মানুষ মরেও যাবে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ইকো করার জন্য মেশিন আছে মাত্র দুটি। তারমধ্যে একটিতে ঝাপসা আসে। বিনিয়োগ করতে হবে সেখানে। তাহলে বেশি মানুষ উপকৃত হবেন।’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকদের কমিশন গ্রহণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণগুলো আমাকে পাঠান। আমি ব্যবস্থা নেব।’

পার্শ্ব প্রতিবেদন : ‘ডাক্তারদের ঘুষ-কমিশন খাওয়া বন্ধে আইন চাই’