বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঋণ না নিয়েও জনতা ব্যাংকে ঋণখেলাপি কৃষকেরা, নেপথ্যে কারা?

প্রকাশিতঃ ১৪ অগাস্ট ২০২৩ | ৬:৪৮ অপরাহ্ন


এম কে মনির : ইমাম হোসেন (৩৫)। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারীটোলা গ্রামের একজন হতদরিদ্র কৃষক। বলতে গেলে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তার। কিন্তু তার নামে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখা থেকে নেওয়া হয়েছে ৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার ঋণ। যার সবকটি এখন খেলাপি। গেল ৯ আগস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হলে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ তিনি যে ঋণ নেনি। তাহলে কারা নিলো এ ঋণ? এ নিয়ে ইমামের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

তবে মান্দারীটোলা গ্রামে কেবল ইমাম হোসেনই নয়, অর্ধশত নারী-পুরুষকে খেলাপি ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে নোটিশ দিয়েছে জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখা। ওই শাখার ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষ স্বাক্ষরিত এসব নোটিশে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ঋণের সমুদয় টাকা সুদসহ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

অভিযোগ, এভাবে ঋণ না নিয়েও একই দিনে লাখ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন মান্দারীটোলা গ্রামের অনেক মানুষ। তাদের প্রত্যেকের চেহারায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ। কীভাবে পরিশোধ করবেন এতো টাকার ঋণ? যেখানে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। কীভাবে তাদের নামে ঋণ হলো? ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা এখন কী করবেন? কিংবা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে আইনি ঝামেলায় পড়লে কী হতে পারে এমন ভয়েও ভুগছেন অনেকে।

তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে একুশে পত্রিকা। আর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেখানে এক গ্রামের একজন মাত্র ব্যক্তি তার গ্রামের অনেকজনকে দিয়ে ঋণ নিয়ে দিয়েছেন। তার সাথে আছে একটি প্রতারক ও ব্যাংক লুটেরা চক্র। যার প্রমাণ মিলেছে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে। আর চক্রের সঙ্গে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলেও অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়েছে।

সরেজমিনে সোমবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে মান্দারীটোলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নোটিশ পাওয়া নারী-পুরুষরা আহম্মেদুর রহমান নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ভিড় করেছেন। তারা সবাই আহম্মেদুর রহমানের কাছে ঋণের বিষয়ে জানতে চাইছেন। নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ, জনতা ব্যাংকের সাথে তাদের কোনো আর্থিক লেনদেন নেই। তবে ২ বছর আগে আহম্মেদুর রহমান তাদেরকে জনতা ব্যাংকের একটি একাউন্ট করলে ১ হাজার টাকা দেওয়া হবে, এমন আশ্বাসে প্রলুব্ধ করে ব্যাংকে নিয়ে যান। এরপর তাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে একাউন্ট খোলা হয় এবং ১ হাজার টাকা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে ব্যাংকে কখনো তাদের যাতায়াত ছিলো না। এখন ২ বছর পর তাদের নামে ঋণখেলাপির নোটিশ ইস্যু করেছে ব্যাংক।

মান্দারীটোলা গ্রামের ইমাম শরীফের বাড়ির মো. শাহ আলমের ছেলে করিম উদ্দিন একজন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ। ২০২১ সালের ১৯ জুন জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখা থেকে তিনি ১ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন জানিয়ে তাকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের ১৯ জুন ঋণের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সশরীরে ও ফোনে তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। আগামী ১৫ কার্যদিবসে যদি ঋণ পরিশোধ করা না হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে করিমের ভাষ্য, তিনি কোনো ঋণ নেননি। জনতা ব্যাংকের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

একই নোটিশ পেয়েছেন তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও মা হোসনে আরা বেগমও। তাদের নামে ঋণ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা। তবে করিম উদ্দিন ও তার মায়ের ঋণ গ্রহণের তারিখ ২০২১ সালের জুনে হলেও তার স্ত্রীর ঋণ গ্রহণের সময় দেখানো হয়েছে এক মাস পরে। ঐ গ্রামের একই বাড়ির শিরিনা আক্তার ও ঝর্ণা আক্তারও পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা ঋণখেলাপির নোটিশ। তাদের নামেও একই অঙ্কের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ আছে।

এছাড়াও দেড় লাখ টাকা ঋণখেলাপির নোটিশ পেয়েছেন ইমাম হোসেনের স্ত্রী নাছরিন আক্তার, মা ছালেহা বেগম,রবাবা মো. ফয়জুল্লাহ, একই গ্রামের বাসিন্দা নুর আলন, শাহানারা বেগম, তার মেয়ে শামসুন নাহার, কুলসুমা বেগম, মোছাম্মৎ মরিয়ম। ১ লাখ টাকার ঋণখেলাপির নোটিশ পেয়েছেন রেহেনা বেগম ও গুলজারা বেগম। তাদের প্রত্যেকের ঋণ গ্রহণের সময় দেখানো হয়েছে ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে নভেম্বরের মধ্যে। তবে নোটিশ পাওয়া ১৬ জনের সঙ্গে আমাদের কথা হলেও এ সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

ঋণ না নিয়েও গ্রামের সাধারণ কৃষকদের মাথায় ঋণের খড়গ। তারা কেউ মনেই করতে পারছেন কখন তারা ঋণ নিয়েছেন? শেষমেশ ২ বছর আগে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে জনতা ব্যাংকে নিয়ে যাওয়া আহম্মেদুর রহমানের বাড়িতে সোমবার সকালে ভিড় করে সবাই। সেখানে তারা হৈ-হুল্লোড় ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগের তীর আহম্মেদুর রহমানের দিকে। তাদের সবার ভাষ্য, করোনাকালে সরকার গরীব লোকদের টাকা দিচ্ছেন বলে আহম্মেদুর রহমান তাদেরকে ব্যাংকে নিয়ে গেছেন। এই কৌশলল তিনি সব ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা কোন ঋণ গ্রহণ করেননি, এমনকি ১ টাকাও তারা চোখে দেখেননি, হাত দিয়েও ধরেননি।

এসময় কীভাবে এতো ঋণ নিয়েছেন শতাধিক মানুষকে দিয়ে জানতে চাইলে আহম্মেদুর রহমান নিজেকে দৃষ্টিহীন এবং অসুস্থ বলে দাবি করেন৷ পরে জনরোষে পড়ে তিনি বলেন, আমি কাউকে দিয়ে ঋণ নিইনি। তারা সবাই মিথ্যা বলছে। এতো মানুষ কেন আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবে? আপনার সাথে তাদের কীসের শত্রুতা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি তা জানি না। তবে তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলছেন। তবে একপর্যায়ে নিজের নামে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখায় ৭ লাখ ঋণ রয়েছে এবং তার ব্যবসায়িক অংশীদার তাকে দিয়ে কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলেও স্বীকার করেন তিনি। একইসাথে নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিদের জনতা ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে হিসাব খোলার কথাও মুখ ফসকে বলে ফেলেন তিনি।

মান্দারীটোলা গ্রামের বাসিন্দা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক জাবের আল মাহমুদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার গ্রামের অর্ধশত মানুষকে জনতা ব্যাংক ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে। তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছে। সকাল নেই বিকাল নেই তারা আমার কাছে আহাজারি করছেন৷ এ নিয়ে কোনও কোনও পরিবারে বিরোধও দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জনতা ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াসি উদ্দিন বাবলা একুশে পত্রিকাকে বলেন, আহম্মেদুর রহমান একজন ব্যবসায়ী। তিনি এখন দেউলিয়া। তিনি সবাইকে দিয়ে ঋণ নিইয়েছেন জনতা ব্যাংক থেকে। যেখানে আমাদেরকে একটি ঋণ নিতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানে একজনই হয়েছেন অর্ধশতাধিক ঋণের জামিনদার। অথচ ঋণগ্রহীতাদের অনেকেরই কোনো জমিজমা কিংবা সম্পত্তি নেই। কীভাবে সম্ভব? ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছে কিনা সেটি যেমন খতিয়ে দেখা দরকার তেমনি অতি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান জরুরি। তা না হলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।

এদিকে একজন ব্যক্তি কীভাবে এতো টাকার ঋণ নিলেন, কীভাবে একজন ব্যক্তি অনেকের জামিনদার হলেন? জানতে চাইলে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষ বলেন, এসব বিষয়ে আমি জানি না। তখনকার সময় শাখা ব্যবস্থাপক ছিলেন ইমতিয়াজুল ইসলাম, এসব ব্যাপারে তিনিই ভালো জানবেন। আপনারা ওনার সাথে কথা বলুন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি ক্ষেত্রবিশেষে কয়েকজনের জামিনদার হতে পারেন। তবে আহম্মেদুর রহমানের কয়েকটি ঋণ খেলাপি হয়েছে। আবার তার নামে অনেক বড় অঙ্কের এফডিআরও জমা আছে আমাদের শাখায়। এমনকি নোটিশ দেওয়া ব্যক্তিদের অপরিশোধিত ঋণ অনিরাপদ নয় বলেও দাবি করেছেন তিনি।

কৃষি শস্যের জন্য ঋণ নিতে কী কী শর্তাবলী প্রযোজ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঋণ গ্রহণের জন্য একজন জামিনদারই যথেষ্ট। এর বাইরে স্থানীয় বাসিন্দা কিনা সেটি যাচাই করা হয়। কোন ধরণের বন্ধকী সম্পত্তি কিংবা দলিলের প্রয়োজন নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আহম্মেদুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশ আছে এমন অভিযোগ ওঠেছে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার সিনিয়র অফিসার মো. আবদুল্লাহর বিরুদ্বে। জানতে চাইলে তিনি নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তারা সবাই ঋণ নিয়েছেন। আমি ঋণের কাগজপত্র সম্পন্ন করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আহম্মেদুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এবং তিনি অনেক লোক নিয়ে ব্যাংকে ঋণ গ্রহণ করতে এসেছেন বলেও স্বীকার করেছেন। এমনকি আহম্মেদুর রহমানের ঋণ নেয়ার ব্যাপারেও তিনি অবগত ছিলেন।

এসময় ভুক্তভোগী ফয়জুল্লাহ ব্যাংকে এসে ক্ষোভ করে বলেন, তার পরিবারের ৪ জনকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ। দুই বছর আগে তিনি এক হাজার টাকার সই নিয়েছেন বলেছিলেন। কোনো ঋণের কথা তাকে জানানো হয়নি।

একই কথা বলেন করিম উদ্দিনও। তিন বলেন, আমার পরিবারের ৫ জনকে ঋণের বোঝা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এতগুলো ঋণ পরিশোধ করব? কেনইবা করব? আমি তো কোন ঋণ নিইনি। আমাকে আহম্মেদুর রহমান ও ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ বলেছিলেন সঞ্চয়ী হিসাব খুললে ভালো হয়, সাথে ১ হাজার টাকাও পাওয়া যাবে। এতে কোনো সমস্যা নেই।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, যারা বলছেন ঋণ নেননি। তারা ভুল বলছেন। কারণ ঋণের সব প্রক্রিয়া তারা সম্পন্ন করেছেন৷ আহম্মেদুর রহমানের অনেক টাকা এফডিআর জমা ছিল। তাই অনেকের ঋণে তাকে জামিনদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষি ঋণের জন্য জামিনদার হলেই চলে কোনো ধরণের সিকিউরিটির প্রয়োজন হয় না। এক পরিবারের একাধিক সদস্যকে একই সময়ে ঋণ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাগজপত্র না দেখলে বলতে পারব না। এসময় তিনি কৃষি ঋণের কর্মকর্তার উপর দায় চাপান৷

বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী বলেন, অবশ্যই এ ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহসহ আরও কয়েকজন জড়িত আছেন। তারা জড়িত না থাকলে এটি কখনো সম্ভব নয়। আহম্মেদুর রহমান সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে এসব করেছেন। তার সাথে বড় চক্র জড়িত। ঋণ গ্রহীতাদের ঋণের সব টাকা আহম্মেদুর রহমান এফডিআর করে রেখেছেন। তার নামে আগে কোনো এফডিআর ছিলো না। আমরা তার পরিবারের সাথে কথা বলেছি। দ্রুত তার এফডিআর ভেঙে সব ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। অন্যথায় আমার এলাকার মানুষ বিপদে পড়বে। যা আমি চাই না।

এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক রমজান বাহারকে কল করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।