রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরেজমিন চট্টগ্রাম মেডিকেল: রোগনির্ণয় পরীক্ষায় ঘুষ আর ভোগান্তি

প্রকাশিতঃ ২৮ অগাস্ট ২০২৩ | ৯:৪০ পূর্বাহ্ন


এম কে মনির : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগে রোগনির্ণয় পরীক্ষার রিপোর্ট ডেলিভারির দায়িত্বে থাকা কোরবান আলীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনদের।

অভিযোগ, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না রোগনির্ণয় পরীক্ষার রিপোর্ট। এতে আশঙ্কাজনক রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। অথচ নিয়মবহির্ভূতভাবে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আর তদবিরের মাধ্যমে কাউন্টারের ভেতরে লোক ঢুকিয়ে রিপোর্ট ডেলিভারি দিচ্ছেন দায়িত্বরত কোরবান আলী ও তার সহকর্মীরা। এতে দীর্ঘ সময় লাইনে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। অনেক সময় রিপোর্ট না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে।

রবিবার (২৭ আগস্ট) সকাল সাড়ে দশটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলার ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, রিপোর্ট গ্রহণ করতে রোগী ও রোগীর স্বজনেরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ পুরুষ ও নারীরা আলাদা লাইনে দাঁড়ালেও দুটি লাইন এতো দীর্ঘ যে তৃতীয় তলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত মানুষের সারি।

কিন্তু দীর্ঘ ২ ঘন্টায়ও লাইন এগুচ্ছে না। যে যেখানে দাঁড়িয়েছেন ২ ঘন্টা পরও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ খতিয়ে দেখতে ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সামনে গেলে চোখে পড়ে অনিয়ম, অসঙ্গতি আর স্বজনপ্রীতি।

এসময় দেখা যায়, কাউন্টারের ভেতরে ৩ জন লোক রিপোর্ট ডেলিভারির দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাদের জন্য তাদের কাজ চলছে একেবারেই শ্লথ গতিতে৷ কিন্তু কাউন্টারের উল্টোদিকে লোকজন ঢুকিয়ে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে আদায় করে রিপোর্ট ডেলিভারি দিচ্ছেন দায়িত্বরত কোরবান আলী। মূল লাইনে রিপোর্ট ডেলিভারির চেয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে তার বানানো লাইনেই রিপোর্ট ডেলিভারি দিতে ব্যস্ত তিনি।

এদের কেউ কোরবানকে নগদ টাকা দিচ্ছেন, আবার কেউ তার কাছের পরিচিত। তার এমন অনিয়ম দেখে কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু কোরবান আলী এসব কানে তুলছেন না।

এমন সময় কোরবান আলীকে অবৈধ সুবিধা দিতে দেখে ক্ষেপে উঠেন সামনের সারির ষাটোর্ধ একজন বৃদ্ধ। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ক্ষোভ উগরে দিয়ে অনৈতিক সুবিধাদাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের মতো লোকরাই এ দেশটাকে ধ্বংস করেছে। আপনাদের জন্যই এমন অধঃপতন, হাঁপিয়ে ওঠার সিস্টেম। আপনি ঘুষ দিচ্ছেন তাই তো সে (কোরবান আলী) নিচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ভোল পাল্টালেন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকারী রিপোর্ট ডেলিভারির দায়িত্বে থাকা কোরবান আলী। হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে এসে এক ধাক্কায় উল্টো দিকের সবাইকে ফেলে দিলেন। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, পেছনে কাউকেই দেব না, সবাই সরুন।

কোরবান আলীর ধাক্কায় বেশ কয়েকজন মেঝেতে পড়ে গিয়ে আহত হন। কিন্তু একটু পর আবারও একই হাল। টাকা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত রিপোর্ট ডেলিভারি শুরু করছেন তিনি। কাউন্টারের ভেতরে জিয়া নামে একজন আনসার সদস্য দায়িত্বে থাকলেও নিরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে।

এসময় কথা হয় বেশ কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। নুর ইসলাম (৫৬)। ৩ দিন ধরে পায়ের সমস্যা নিয়ে চমেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন তার ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে। চিকিৎসকরা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এক্স-রেসহ বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু বাইরে পরীক্ষা করানোর সাধ্য নেই তার। স্বল্প খরচে হাসপাতালেই করান ৫টি পরীক্ষা। কিন্তু পদে পদে তাকে পড়তে হয়েছে হয়রানি আর অনিয়মের কবলে।

নুর ইসলাম জানান, নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার পরও এক্স-রে রুমে ৩০ টাকা, স্যাম্পল সংগ্রহকারীকে ১০০ টাকা দিতে হয়েছে তাকে। একদিন পর রিপোর্ট গ্রহণ করতে এসে সকাল আটটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ুন আহমেদ বলেন, ‘আড়াই ঘন্টারও বেশি তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। বেলা এগারোটায়ও রিপোর্ট বুঝে পাননি। ভেতরের লোকেরা টাকা নিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে রিপোর্ট ডেলিভারি দিচ্ছেন। এতে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কিছুতেই এগুচ্ছে না৷’

একই কথা বলেন, সুজন হালদার। তিনি বলেন, ‘আমার রিপোর্ট গ্রহণের দিন ছিল শনিবার (২৬ আগস্ট)। অনিয়মের কারণে শনিবার নিতে পারিনি তাই আজ (রবিবার) এসেছি। কিন্তু আজও একই অবস্থা।’

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একজন রোগীর স্বজন বলেন, ‘স্যাম্পল কালেকশন করতে গিয়েও আমাদেরকে টাকা দিতে হয়েছে। অথচ আমরা পরীক্ষার ফি আগেই পরিশোধ করেছি নির্ধারিত নিয়মে।’

এসময় কাকে টাকা দিতে হয়েছে জানতে চাইলে, ওই স্বজন একটি মুঠোফোন নম্বর দেখান। নম্বরটি ট্রু কলারে ডায়াল করলে ‘রবিউল চট্টগ্রাম মেডিকেল’ লেখা আসে। যোগাযোগ করা হলে রবিউল হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তাদেরকে রশিদ দেওয়া হয়েছে। স্যাম্পল সংগ্রহ করলে টাকা দিতে হবে। এটাই নিয়ম।’

অথচ ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কাউন্টারে আগে জমা দেওয়া টাকার বিল ইনভয়েসটি চেয়ে নেওয়ার পর সেটি ছিঁড়ে অর্ধেক নিজে নিয়ে যান, বাকি অর্ধেক রোগীকে দিয়ে যান রবিউল।

অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোরবান আলী উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘কাজ করছি দেখছেন না।’

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ইনডোরের কিছু রোগীর রিপোর্ট ভেতরে দেওয়া হয়। ইনডোরের রোগীকে ভেতরে দেওয়ার সুযোগ আছে, এ ফাঁককে কাজে লাগিয়েই কোরবান আলী অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিষয়টি দেখছি। অভিযোগের সত্যতা পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। এক্স-রে রুমে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখব। যদিও এরকম একটি অভিযোগ আমি শনিবারও পেয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রধানকে বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’