মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকা ঘিরে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এক সময় বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের নিরাপদ রুট ছিল বাঁশখালী। এ নিয়ে সে সময় অনেক লেখালেখি ও মামলা মোকদ্দমাও হয়।
২০১৭ সালের দিকে বাঁশখালীর ছনুয়া উপকূল ও কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতির সময় ছনুয়া ইউনিয়নের ছেলবন এলাকায় স্থানীয় দালালসহ পুলিশ প্রায় ১৩৫ জনের বিশাল দলকে আটক করেছিল। বিষয়টি তখন দেশব্যাপী আলোচিত হয়। যা ওই সময়ে বাঁশখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মানবপাচার প্রচেষ্টা। যাত্রাপথে ওই চালান আটকের পর দীর্ঘ সময় বাঁশখালী হয়ে মানবপাচারের আর অভিযোগ শোনা যায়নি।
সম্প্রতি সাগরপথে মানবপাচার আবার বেড়েছে। ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মানবপাচারকারী চক্র। কাথরিয়ার দুবাই প্রবাসী রমিজ ওরফে দুবাই রমিজ, কাথরিয়ার ইব্রাহিম, গণ্ডামারার হেলাল ও মাদারীপুর জেলার কাজল চৌকিদারসহ বেশ কিছু দালাল নতুন করে এখন সাগরপথে মানবপাচারে জড়িত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লিবিয়ায় আটকে থাকা গণ্ডামারা, জলদী ও কাথরিয়ার ৯ প্রবাসী এই দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া যান বলে জানিয়েছেন প্রবাসী ও তাদের পরিবার। তবে নাম্বার বন্ধ থাকায় অভিযুক্তদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, বাঁশখালী থেকে বিগত দেড় ২ বছরে অর্ধশতাধিক মানুষকে সাগরপথে লিবিয়া পাচার করেছেন দালালরা। এরা অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা ও ভালো বেতনের লোভ দেখিয়ে লোকজনকে ফুসলিয়ে প্রবাসে যেতে উৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে লিবিয়া পৌঁছার পর ভালো বেতন ভাতা তো দূরের কথা তাদের কর্মসংস্থানের পর্যন্ত ব্যবস্থা করা হয়নি। আবার অনেককে বিক্রি করে দেওয়া হয় সে দেশের দালালদের কাছে। জনপ্রতি ১০-১২ লাখ টাকা আদায় করে তাদের প্রবাসে নিয়ে গিয়ে আবার বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা আদায় করে দালালরা। টাকা না দিলে আটকে রেখে নির্যাতনসহ বাড়িতে ভিকটিমদের দিয়ে ফোন করিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এভাবে প্রতিজন প্রবাসীর কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হলেও নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না হতভাগা প্রবাসীরা।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীর পরিবার সূত্র জানায়, বাঁশখালীর গণ্ডামারা, কাথরিয়া ও জলদী এলাকার এই ৯ প্রবাসী স্থানীয় মানবপাচারকারী দালাল কাথরিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড এলাকার নুরুল আমিনের ছেলে মোহাম্মদ রমিজ, একই এলাকার দুলা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম, গন্ডামারা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড এলাকার নুর হোসেনের ছেলে হেলাল ও মাদারীপুর জেলার কাজল চৌকিদারের মাধ্যমে নগদ ১০-১২ লাখ টাকা দিয়ে তারা প্রথমে লিবিয়া পৌছে। পরবর্তিতে এই দালালরা তাদের অন্য দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। দুবাই প্রবাসী কাথরিয়ার দালাল রমিজ তাদের সব গুরু হলেও কাথরিয়ার ইব্রাহিম, গন্ডামারার হেলাল ও মাদারীপুর জেলার কাজল চৌকিদার বাংলাদেশ থেকে প্রবাসীদের পরিবারের কাছ থেকে আবার টাকা আদায় করে তা দালাল রমিজের কাছে পৌছায়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বাঁশখালীর গন্ডামারা, জলদী ও কাথরিয়া এলাকার ৯ প্রবাসীকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন ও দফায় দফায় মুক্তিপণ হিসেবে টাকা আদায়ের ঘটনায় বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে অভিযোগ দায়ের ও পরিবারের পক্ষে প্রশাসনিক সহযোগিতা চাওয়ার পর বিষয়টি বর্তমানে টক অব দ্য উপজেলায় পরিনত হয়েছে।
উল্লেখ্য, জনপ্রতি ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে সাগরপথে লিবিয়া যেতে পারলেও তাদের ভাগ্যে জুটেনি কোনো কর্মসংস্থান। মা-বাবা ও পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে এখন উল্টো ওই ৯ প্রবাসী পরিবারের যন্ত্রণা এবং বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেশের প্রকৃত ভিসা, পাসপোর্ট না থাকায় দেশেও ফিরতে পারছে না এই হতভাগা প্রবাসীরা। ফলে লিবিয়ার পাহাড়ে পাহাড়ে অনেকটা অনিশ্চিত মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে প্রবাসে গিয়ে নানা নির্যাতন ও আটকে পড়া ৯ প্রবাসী হলেন, বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড এলাকার শহিদ উল্লাহ’র ছেলে রুকনুল ইসলাম আরিয়াত, একই এলাকার নুরুল আমিনের ছেলে মো. মোরশেদুল আলম, আহমদ কবিরের ছেলে মোহাম্মদ কাউছার মিয়া, আবদুল মোনাফের ছেলে আজগর হোসাইন, আবদুল মজিদের ছেলে গিয়াস উদ্দিন, মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আশেক ও তার ভাই ইব্রাহিম, বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদী ৫নং ওয়ার্ডের মৃত ওমর আলীর ছেলে আইয়ুব আলী ও কাথরিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড বাগমারা এলাকার আবু আহমদের ছেলে মোহাম্মদ করিম।
বর্তমানে তারা লিবিয়ায় বেনগাজি শেরা অ্যালবাম এলাকার পাহাড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানা গেছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে এই ৯ প্রবাসীর স্ব স্ব পরিবারের পক্ষে তাদের স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনিক সহযোগিতা ও সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়ে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে ভালো বেতনে চাকরি ও কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও স্থানীয় মানবপাচারকারী দালালরা তাদের সে দেশের মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। লিবিয়ায় স্থানীয় মাফিয়া ও সন্ত্রাসীরা তাদের বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে ওই ৯ প্রবাসীর মাধ্যমে দেশে স্বজনদের কাছে মোবাইলে মুক্তিপন দাবী করে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে দেশীয় দালালদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হলেও ওই ৯ প্রবাসীকে দেশে ফেরার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি তাদের লিবিয়াতেও কোন কাজকর্ম কিংবা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমতাবস্থায় দীর্ঘ এক দেড় বছর ধরে বাংলাদেশী ৯ প্রবাসী সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বজনরা ৯ প্রবাসীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দালালদের শাস্তি দাবি করেছেন।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা লিখিত আবেদন পেয়েছি। লিবিয়ায় আটকে পড়া ৯ প্রবাসীকে দেশে ফেরাতে সব রকমের সহযোগিতার পাশাপাশি মানবপাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’