খ্যাতিমান চিকিৎসক আলমগীর চৌধুরী যে কারণে এমপি হতে চান


মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): অধ্যাপক ড. এম. আলমগীর চৌধুরী। গলার টিউমার অপসারণে রক্তপাত বিহীন অপারেশন করে দেশে-বিদেশে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। পেয়েছেন পুরস্কারও। নিজ জন্মস্থান বাঁশখালীতে বিনামূল্যে রোগী দেখে আসছেন। দরিদ্র রোগীদের ওষুধও দেন ফ্রী। এসব কিছুর জন্য এলাকায় রয়েছে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে তিনি হতে চান বাঁশখালীর এমপি। এ জন্য চান নৌকার মনোনয়ন।

আলমগীর চৌধুরী বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ তাঁতী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৮ নভেম্বর বাঁশখালীর বনেদি পরিবার জলদি মিয়ার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে আলমগীর চৌধুরী এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পিতার নাম হেছাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও মাতার নাম মাহফুজা খাতুন চৌধুরানী।

১৯৮৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএলও পাস করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে এমএস (ইএনটি) অর্জন করেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জেন্স অব গ্লাসগো থেকে এফআরসিএস পাস করেন। এরপর ২০২০ সালে আমেরিকান কলেজ অব সার্জন্স থেকে এফএসিএস পাস করেন।

দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে অধ্যাপক ড. আলমগীর চৌধুরীর অন্তত ৬০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্স, চেয়ারম্যান হিসেবে দেশ ও বিদেশে বৈজ্ঞানিক অধিবেশনে দায়িত্ব পালন করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের প্রতিদানরূপ আলমগীর চৌধুরীকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক ও আমেরিকান বায়ু গ্রাফিকাল ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।

১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে আলমগীর চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত একই কলেজে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮১ সালে নতুন কমিটি গঠিত হলে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

এছাড়াও আলমগীর চৌধুরী ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইন্টার্নি চিকিৎসক পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এই খ্যাতিমান চিকিৎসক। ১৯৯৪ সাল থেকে আজ অবধি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য হিসেবে আছেন তিনি। এছাড়াও অধ্যাপক আলমগীর চৌধুরী বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। তিনি বাঁশখালী সমিতি ঢাকা এর সভাপতি।

আলমগীর চৌধুরী ১৯৮৪ সালের মার্চে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। বিএনপি সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়ে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হয় আলমগীর চৌধুরীকে। পরবর্তীতে তিনি পিজি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল সফলতার সহিত কর্মজীবন পার করেন। বর্তমানে ড. এম. আলমগীর চৌধুরী রাজধানীর আনোয়ার খাঁন মডার্ণ মেডিকেল কলেজে ইএনটি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত মুমূর্ষু রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে অন্যান্য নজির স্থাপন করেন। প্রায় ৩০ জন ইএনটি সার্জনকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠান তিনি। আলমগীর চৌধুরীর পূর্ব পুরুষদের নামে বাঁশখালীতে ৪টি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— শেখ ওয়াজেদ আলী চৌধুরী সড়ক, শেখ ছমিউদ্দিন চৌধুরী সড়ক, শেখ মর্তুজা আলী চৌধুরী সড়ক ও অ্যাডভোকেট আলী হায়দার চৌধুরী সড়ক।

একুশে পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর আশা আকাঙ্খার কথা জানিয়েছেন আলমগীর চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি জলদি স্কুলে ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমার শরীরে রক্ত টগবগ করে। আমি যদি বড় হতাম মুক্তিযুদ্ধে চলে যেতাম। তখন আমার বয়স ১২ বছর। পড়তাম সপ্তম শ্রেণিতে। আমাদের বাড়ি থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করা হতো। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের স্কুলে ক্যাম্প করেছিল। আমিও ওখান থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তখন আমাকে একটা সার্টিফিকেট নিতে বলেছিল। কিন্তু আমি তখন সার্টিফিকেটের মর্ম বুঝতাম না। আমাদের বাড়ির অপজিট পাশে হিন্দু বাড়ি। ওরা আমার মায়ের কাছে স্বর্ণালংকার, জমির দলিল ও টাকাপয়সা গচ্ছিত রেখে ইন্ডিয়া চলে গেছে। স্বাধীনতার পর তারা দেশে ফিরলে আমার মা গচ্ছিত রাখা জিনিসপত্র ফেরত দেন।

তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। তখন ওখানে জাসদ ও জামায়াত ছাড়া কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। আমরাই প্রথম সেখানে ছাত্রলীগ গঠন করি এবং সেখানে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে মিটিং-মিছিল করি। ছাত্রলীগকে সংগঠিত করি। তখন বদরুজ্জামান ডাবলু কনভেনার ও সুভাষ মল্লিক সম্পাদক। সেন্ট্রাল কমিটি ছিল কাদের-চুন্নু পরিষদ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক বাহারুল মজনুন চুন্নু। যেটাকে আমরা বলতাম কাদের-চুন্নু পরিষদ। ওনি (ওবায়দুল কাদের) আজকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওনারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্সে আসলে চট্টগ্রাম মেডিকেল হোস্টেলে থাকতেন। ওবায়দুল কাদের সাহেব তিন বার আমার রুমে ছিলেন।

নিজ জন্মস্থান বাঁশখালীতে শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ঢাকায় থাকলেও ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষার্থীকে স্কলারশিপ দিয়ে আসছি। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের; যারা ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়। পুরো বাঁশখালীতে ২৬টি হাই স্কুল ও ১৪টি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী; যারা বেশি নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে আমি ৪ হাজার টাকা করে পুরস্কৃত করি প্রতি বছর। কিন্তু এসব কেউ জানে না। কারণ, আমি প্রচারবিমুখ বলে। আমার ঢোল আমি পিটাই না।

দূর্যোগে-দুর্বিপাকে গ্রামের মানুষের পাশে থাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় হলো তখন আমি কেন্দ্রীয় বিএমএ থেকে ১০ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী বাঁশখালীতে এনে বিতরণ করেছি। এছাড়াও দশটি মেডিকেল টিম এনেছি ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে যেখানে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা হয় সেখানে আমি ত্রাণ ও মেডিকেল টিম পাঠাই। প্রতি বছর শীতকালে উত্তরবঙ্গ পার্বত্য জেলায় শীতার্ত মানুষের জন্য কম্বল পাঠাই।
সম্প্রতি চাম্বল ও মনকিচরে আমি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুদান দিয়েছি। পুঁইছড়িতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করেছি।

তিনি বলেন, বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি ৫টি ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্প করেছি। রক্ত পরীক্ষা ও ইয়ারিং টেস্ট করেছি কানে না শোনা রোগীদের। সেখানে হাজার হাজার রোগীর ঢল নামে। আমার কাছে যখন বাঁশখালীর রোগী যায়, আমি ফ্রি-তে ট্রিটমেন্ট দিই। যতটুকু পারি হেল্প করি।

নিজেকে করোনাযোদ্ধা দাবি করে তিনি বলেন, আমি রক্তপাতবিহীন গলার টিউমার অপসারণ করি বলে আমেরিকা থেকে আমার কাছে রোগী এসেছিল। করোনার সময় সব চিকিৎসকরা যখন পালিয়ে গেছে, তখন আমি যাইনি। আমি সার্বক্ষণিক হাসপাতালে ছিলাম। করোনাকে ভয় পাইনি। আমি ডাক্তার-স্টাফদের মাস্ক ও পিপিই কিনে দিয়েছি। আমি এক হাজারের ওপরে করোনার রোগী দেখেছি। চট্টগ্রামের অনেক ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি আমার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন করোনার সময়। আমি করোনাকালীন সময়ে প্রথম দিন থেকে করোনা রোগীদের স্যাম্পল কালেকশন করেছি।

তিনি বলেন, আমি বাঁশখালী সমিতি ঢাকার উদ্যোগে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন ও ড. আবদুল করিমের স্মরণসভা করেছি। বাঁশখালী সমিতির যারা মারা গেছে, তাদের জন্য বিরাট মেজবান দিয়েছি ঢাকায়। বাঁশখালী থেকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, আমি তাদেরকে সংবর্ধনা দিয়েছি।

বাঁশখালীর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার বাঁশখালীতে গিয়ে ফ্রী-তে রোগী দেখি। কর্ণফুলী টানেল চালু হলে আমি প্রতি শুক্রবার বাঁশখালীতে গিয়ে ফ্রী রোগী দেখবো। এখন তো বাঁশখালীর রোগীদের চট্টগ্রাম ও ঢাকাতেই অপারেশন করতে হয়। আমার প্ল্যান আছে বাঁশখালীতেই সব অপারেশনের ব্যবস্থা করার।

নমিনেশন পাওয়ার ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা তো আল্লাহ জানে আর নেত্রী জানেন। আমার সব কর্মকাণ্ড নেত্রীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আমার কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। আমি তো বলবো শতভাগ কনফার্ম। আমরা জিয়াউর রহমান ও এরশাদের মার্শাল ভেঙেছি। ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছি, ধর্মঘট ডেকেছি। আমার রাজনৈতিক জীবনে কোনো ঘাটতি নেই।

এমপি নির্বাচিত হলে সব ধরনের অপারেশন বাঁশখালীতে করার ব্যবস্থা করবেন জানিয়ে আলমগীর চৌধুরী বলেন, বাঁশখালী থেকে এনে আমাদেরকে চট্টগ্রাম শহরে অপারেশন করতে হয়। আমি চাই সব ধরনের অপারেশন বাঁশখালীতেই হোক। নার্সিং ইনস্টিটিউট করবো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তি, সব খাতের উন্নয়ন, প্রধান সড়ক প্রশস্ত করণ, চার লেন না হলেও দুই লেন করাই আমার লক্ষ্য। বাঁশখালীতে বস্ত্র শিল্প এলাকা করবো।