শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

পাহাড় ডিঙিয়ে ফুটবলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েরা

প্রকাশিতঃ ২০ নভেম্বর ২০২৩ | ৮:১৫ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ শাহজাহান : সারাদিনের দীর্ঘ ক্লাস শেষে বেজে উঠলো ছুটির ঘন্টা। শহরের স্কুলগুলোতে যখন ছেলেমেয়েরা ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে, তখনই পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক স্কুলের মেয়েরা ফুটবল প্রশিক্ষণ নিতে মাঠে নেমেছে। বিকেলে সূর্যের আলো পড়ে মাঠের ঘাসগুলো যেমন চিকচিক করে, ঠিক সেই আলোর ছটা যেন তখন ছোট ছোট পাহাড়ি মেয়েদের চোখেও জ্বলজ্বল করে। কারণ, এই ফুটবল খেলেই যে একদিন সফলতার চূড়ায় উঠতে চায় তারা। গল্পটি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালীর একটি স্কুলের।

উপজেলাটির ঘাগড়া ইউনিয়নের ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়কে বলা হয় নারী ফুটবলার তৈরির সূতিকাগার। যেখান থেকে উঠে এসেছে রুপনা, ঋতুপর্ণা, আনুচিং, মনিকা, আনাই’র মতো মেধাবী নারী ফুটবলার। বাংলাদেশ জাতীয় দলের বয়স ভিক্তিক বিভিন্ন দলেও আছে এই স্কুলের অনেক মেয়ে ফুটবলার। এই মাঠেই প্রতিদিন ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে তাদের উত্তরসূরি মাসাইং উ মার্মা, জলেখা চাকমা, নমনিতা চাকমা, মেন্টি চাকমা, মহিনা চাকমারা। তাদের চোখেও স্বপ্ন আগামীতে বয়সভত্তিক জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়ার। প্রত্যয়, একদিন রুপনা, মনিকা, ঋতুপর্ণাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার।

ঐশি চাকমা নামে এক ক্ষুদে ফুটবলার জানান তার স্বপ্ন। বলেন, আমাদের দিদিরা এ মাঠ থেকে ফুটবল খেলে এখন জাতীয় দলে খেলছে। তাঁদের মতো আমাদেরও স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলার।

সামাজিক বাধা ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশে নারী ফুটবলারদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, মেয়েদের ফুটবলে শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশ ভালো। দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা দলের ১১ সদস্যের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েরা।

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিন পার্বত্য জেলা থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েরা ফুটবলে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। আর তাই নারী ফুটবল দলে তাদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত। অথচ এই পাহাড়ি মেয়েদেরকেই দারিদ্রতার সাথে লড়াইয়ের পাশাপাশি শুনতে হয়েছে সমাজের নানা স্তরের মানুষের টিপ্পনি, সহ্য করতে হয়েছে নানা মানসিক নির্যাতন। তবুও তারাই দেশের হয়ে বয়ে এনেছেন শিরোপা জেতার সম্মান। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা গৌরবের সাথে উড়েছে এই পাহাড়ি মেয়েগুলোর হাত ধরেই।

রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান বলেন, আমাদের স্কুলে শিশু কাল থেকেই মেয়েদের ফুটবল খেলা শেখানো হয়। নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বয়স ভিক্তিক দল গুলোতে খেলানো হয়। খেলার সরঞ্জাম সংকটসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে হচ্ছে। মেয়েদের ফুটবল শেখানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পৃষ্টপোষক পাওয়া গেলে এই স্কুলের মেয়েরা দেশের জন্য আরো সম্মান বয়ে আনতে পারতো।

ফুটবল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ের মেয়ে হবার কারণে ওদের শারীরিক ফিটনেস ভালো থাকে এবং ওরা খেলাধুলায় অনেক আগ্রহী থাকে। এছাড়া তাদের মধ্যে ধারাবাহিকতা বেশি থাকে এবং ঝরে পড়ার হার তুলনামূলক কম থাকে।এসব কারণে মেয়েদের জাতীয় এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা ভালো করছে।

এছাড়া, যে ধরনের পোশাকে মেয়েদের ফুটবল খেলায় অংশ নিতে হয়, তা নিয়ে সমাজের রক্ষণশীলদের মধ্যে রয়েছে দ্বিধা এবং বাধা। যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমাজে অনেক কম। এ বিষয়গুলো সেখানকার পরিবার থেকে মেয়েদের বেশি খেলতে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখছে।

মেয়ে ফুটবলাররা অনেক পরিশ্রম আর সামাজিক বাধা-নিষেধের বিপক্ষে লড়াই করে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এখন এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন। মেয়েরা ফুটবলে সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। মেয়ে ফুটবলাররা পুরুষশাসিত ক্রীড়াঙ্গনে চান সমাজ ও দেশের কাছে ‘নিরাপদ পরিবেশ’ তাদের সাধারণ প্রতিভা বিকাশের জন্য।