পেলেই একশ কোটি টাকা!

tokkokএকুশে প্রতিবেদক, ঢাকা :

কেস স্টাডি ১
লক্ষ্মীপুরের দুলাল মিয়া। ঢাকার আগারগাঁওয়ে ছয়তলা বিল্ডিংয়ের মালিক। তক্ষক দিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগারের কথা তিনি আগেই শুনেছেন। একদিন এই দুলাল মিয়ার কাছেই হাজির তক্ষক ক্রেতার একটি গ্রুপ।

বলেন, ‘হাঁস পা’ ওয়ালা তক্ষক খোঁজেন। একশ’ থেকে দেড়শ’ গ্রাম হলে পাওয়া যাবে শত কোটি টাকা। শুধু ‘পকেট মানিই’ দেওয়া হবে কয়েক কোটি টাকা। দেশের যেখানেই পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিন, সেখানেই ‘বায়ার’ পৌঁছে যাবে। লেনদেন নিয়ে ভাববেন না। নগদ, চেক, ডলার-যাই চান সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যাবেন।

সঙ্গে সঙ্গে তক্ষকের খোঁজে নেমে গেলেন দুলাল মিয়া। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরসহ জেলায় জেলায় তক্ষকের খোঁজে দিনমান কাটে দুলালের। তক্ষক পাওয়ার খবর আসে, কিন্তু বেশিরভাগই ‘মুরগী পা’র এবং সাইজে ছোট। এরমধ্যেই তক্ষক খুঁজতে গিয়ে খরচ করে ফেলেছেন ২০ লাখ টাকার উপরে। তবু আশায় বুক বাঁধেন দুলাল মিয়া। ‘হাস পা’ এবং আড়াইশ গ্রাম উর্ধ্ব ওজনের ‘মুরগী পা’র তক্ষক মিলবেই। একবার মিললেই শত কোটি টাকা! তখন কে আর পায় তাকে।!

কেস স্টাডি ২
শেরেবাংলা নগরে একটি অফিসের চতর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মোহাম্মদ রুবেল। একদা তাকেও পেয়ে বসে তক্ষক সিন্ডিকেট। তাদের মনভোলানো কথায় নড়েচড়ে উঠে রুবেল। রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক হতে চট্টগ্রামের গ্রামের বাড়িতে লোক লাগানো হয়। বয়স্ক বাবা, গ্রামের কয়েক দিনমজুর রুবেলের কথায় অভিযান শুরু করে বনে-জঙ্গলে। ২০ টারও বেশি তক্ষক ধরা পড়েছে এপর্যন্ত, কিন্তু একটিও আশানুরূপ নয়। একশ গ্রাম ওজনের ‘হাস-পা’র তক্ষক ধরা পড়ার খবর আসে একবার। কিন্তু চট্টগ্রাম পৌঁছার আগেই মারা যায় সেই তক্ষক। শুধু তাই নয়, ১৮১৮ আর ১৮৩৯ সালের পয়সা, যেটি পানিতে ভাসে সেরকম একটি পয়সার জন্যও ২০-৩০ কোটি দেবে সিন্ডিকেটটি। তক্ষক আর এমন একটি পয়সার সন্ধানে রুবেলেরও খরচ হয়ে গেছে লাখ টাকা। কিন্তু মিলে না তক্ষক, মিলে না পয়সা।

শুধু দুলাল কিংবা রুবেল নন, অনেকেই তক্ষকের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে নিঃস্ব হতে বসেছেন। তবু তারা হতাশ নন; খুঁজেই চলছেন। যেখানে সন্ধান পাচ্ছেন, সেখানেই ছুটছেন।
তক্ষক ব্যবসায়ীদের মতে, এই প্রাণীর দুই ধরনের পা রয়েছে। কোনোটার ‘মুরগী পা’ আর কোনোটার ‘হাঁস পা’। ‘হাঁস পা’গুলোর দাম খুব বেশি। সর্বনি¤œ সাড়ে ৯ ইঞ্চি লম্বা ও ৫২ গ্রাম ওজনের ‘হাস পা’ চলে। এর কম ওজন বা লম্বায় সাড়ে ৯ ইঞ্চির ছোট হলে চলবে না। ‘মুরগি পা’গুলো ২৫৫ গ্রাম ওজন ও সাড়ে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। এ ছাড়া একটা আছে ‘বার্মিজ’। ‘বার্মিজটা’ ওজন সাড়ে তিনশ গ্রামের নিচে হলে বিক্রি হয় না।

তক্ষক দিয়ে কী করা হয় জানতে চাইলে কেউ বলেন, প্রাণীটা পুরো গলিয়ে অথবা শরীরে থাকা মার্বেল আকৃতির একটি বিশেষ অংশ দিয়ে ক্যান্সার, এইডসসহ দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরি করা হয়। এই প্রাণী কাউকে কামড় দেওয়ার পর তার ঘাঁ শুকিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির শরীওে কোনো ধরনের রোগ-জীবাণু থাকবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, এটার শরীরে থাকা দানা এক করে ড্রোন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই প্রাণী দিয়ে কী হয় তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।

প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে, ‘তক্ষক’ সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী। এরা নিশাচর। গাছের গর্তে বাস করে। বিভিন্ন পোকামাকড়, পাখির ডিম খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেকেই পোষা প্রাণীর মতো তক্ষক লালন করে বলে শোনা যায়। তারা মনে করেন, এই প্রাণী বাড়িতে থাকলে তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। নিঃসন্তানদের সন্তানাদি হয়।’
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।

বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ, চট্টগ্রামের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান মুকুল বলেন, তক্ষকের বিষয়টি আমরা এখনো পরিষ্কার হতে পারিনি। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মতে, পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে এই প্রাণী চড়ামূল্যে বিক্রি হয়। তক্ষকের ওষুধি গুণ রয়েছে বলে শোনা যায়। কোনো কোনো দেশে এ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে থাকতে পারে। আর মহামূল্যবান ওষুধ তৈরিতে ব্যবহারের কথা বলে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বসেছে তক্ষক বেচাকেনার হাট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রাণী বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-দাম হয় দুইভাবে। একটা থোক। আরেকটা স্ক্যান করে প্রাণীর শরীরে থাকা ‘দানা’ হিসেব করে। তবে বেশির ভাগ বিক্রেতা স্ক্যানের বিপক্ষে। তারা থোক দরদাম করেন।

‘হাঁস পা’র দাম বেশি শুনে কেউ কেউ আবার সার্জারি করে ‘হাঁস পা’ লাগিয়ে নেয়। জানা যায়, বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার জিহির নামের এক ব্যক্তি সার্জারিতে পারদর্শী। তিনি বাদুরের ডানা দিয়ে সার্জারি করেন। তাই প্রতারণার জন্য অনেকে তার কাছে ধর্ণা দেন। তবে বায়াররা সতর্ক। তারা এটা ধরে ফেলতে পারেন।

সারা দেশেই এখন এই প্রাণীটি বেচাকেনার সিন্ডিকেট আছে। ঢাকা থেকে যারা কিনতে চান, তারা প্রথমে জেলা শহরের সিন্ডিকেটের কাছে প্রাণীর ছবি বা ভিডিও চান। পাঠানো হয় সদ্য করা ভিডিও বা ছবি। এটা কোনো পত্রিকার ডেটলাইনের পাশে রেখে করতে হয়। এই ভিডিও বিশ্নেষণ করার পর ঢাকা থেকে লোক যায়।

এই প্রাণীর সন্ধানে ঘোরা মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন আরেক শ্রেণীর মানুষ। আবার ঢাকা থেকে গিয়ে তারাও প্রতারণার শিকার হন। কিনতে গিয়ে অনেকসময় ধরা খান। প্রথমে যেটা দেখানো হয়, বাক্সে দেওয়ার সময় আরেকটা দিয়ে দেয়। বাসায় এসে দেখেন যেটা দিয়েছে তা অনেক ছোট। এভাবে সর্বশান্ত হয়েছে এমন নজির ভুড়ি ভুড়ি। আবার বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিনতে গিয়ে স্থানীয় সিন্ডিকেটের লোকজনের কাছে মারধর খেয়ে টাকা পয়সা মোবাইল সব কিছু রেখে আসার ঘটনাও কম নয়।

গত বছরের শুরুতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ২২ ইঞ্চি লম্বা এক তক্ষক ধরা পড়ে। চা-বাগান থেকে চা-শ্রমিমকরা প্রাণীটা ধরেছে। পাঠানো ভিডিওতে দেখে ঢাকা থেকে সেই তক্ষক কিনতে যায় একদল লোক। হোটেলে অবস্থান করে দুইদিন। কিন্তু তারা কেউ কাউকে বিশ্বাস না করায় শেষপর্যন্ত আর বেচাকেনা হয়নি।

তক্ষকের পেছনে ছোটা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউ তক্ষক কিনতেও পারেননি, বিক্রিও করতে পারেননি। মূলত এই ব্যবসায় যারা জড়িত তারা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এ কারণেই কেনাবেচা হয় না। এক সময় হয় প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে, না হয় না খেতে পেরে প্রাণীটি মারা যায়।

তবু রাতারাতি বড় লোক হওয়ার অসম এক আশা নিয়ে ঘুরছে এই সিন্ডিকেটের লোকজন। কিন্তু কবে তাদের আশা পূরণ হবে তা কেউই জানে না।