শিশু…

মো. আব্দুল মান্নান : আজ ১ আশ্বিন ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। ঘুম থেকে জেগে উঠেই চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় তবে প্রাচীনতম ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকার উপর আমার নজর পড়লো। শিরোনামটি দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিছুটা পড়ার পর স্পষ্ট হলো।

একজন ভীতসন্ত্রস্ত হতভাগিনী রোহিঙ্গা মা তার মাত্র পঁয়ত্রিশ দিন বয়সের একটি পুত্র সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। শিশুটি মৃত না জীবিত প্রথমে বোঝার উপায় নেই। কারণ শিশুটি সদ্যমৃত।

প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশের সীমানার দিকে পালিয়ে আসা এ নারীর বুকেই ছিল শিশুটি। আতংকিত বিপদসংকুল পথে পথে ধাবমান মানুষের সহযাত্রী তিনি। কখন যে নিজের কোলেই শিশুটি মারা যায় অসহায় নারী তা জানেন না।

নাফ নদীর তীর ধরে হাজারো নারী-পুরুষ-শিশু তথা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে এক অজানা অচেনা গন্তব্যে যাত্রা করে। কেউ জানে না এর শেষ কোথায়, কোথায় গিয়ে তারা থামবে?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যব্যাপী চলমান সন্ত্রাস, ধ্বংসযজ্ঞ, অমানবিক গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। নিজ দেশ ছেড়ে নবজাতককে বুকে আগলে রেখে মা পালাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। হঠাৎ এই স্নেহময়ী জননী বুঝতে পারলো তার বুকের সন্তান বেঁচে নেই। তিনি সন্তানের নি:শ্বাস পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আর্তচিৎকার ও বিমূঢ় জিজ্ঞাসায় থমকে যায় নাফ নদীর সমস্ত জল। ভূমি কম্পের মতো কেপেঁ উঠে সমগ্র পৃথিবী।

বিছানায় বসেই মৃত শিশুটির ছবি আমি বারবার দেখছিলাম। আহা! কী সুন্দর শিশু। আমার চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। বাংলোয় সম্পূর্ণ একা আমি। এখানে আমার প্রথম রাত্রিযাপন। ঘুম ভাঙ্গতেই চোখের জলে সিক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠি।

ভাবছি এমন নির্মমতা, পাশবিকতা ও নিষ্ঠুরতা কী শুধু আমার দেশ, আমার সরকারই গভীর মানবিকতা দিয়ে উপলব্ধি করবে? পৃথিবী কেন কুম্ভকর্ণের ঘুমে নিথর হয়ে আছে?

প্রতিবেদনটির ভেতরে প্রবেশ করে জানতে পারলাম, এ করুণতম দৃশ্যটি প্রথমে ধারণ করেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বার্তা সংস্থা এপি’র একজন দক্ষ চিত্রগ্রাহক। জেনে অন্তত সামান্য আত্মতৃপ্তি হলো যে, এটি বিশ্বায়নের একটি উত্তম খোরাক এবং সভ্যতার একটি কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

কেননা এ শিশুর মর্মস্পর্শী মৃত ছবিই সহসা পৃথিবীর বিবেককে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কালে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয় ও তাণ্ডবের পর কবি সুকান্ত শিশুর বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা ভেবেই হয়তো বলেছিলেন, ‘যে শিশু ভুমিষ্ট হলো কাল রাতে, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’।

অসহায় রোহিঙ্গা এ নারী ও শিশুর কী অপরাধ? মা রাখাইনে জন্মগ্রহণকারী তার পূর্ব পুরুষের নামের সাথে মিলিয়ে বুকের ধন ছেলের নাম রেখেছিলেন আব্দুল মাসুদ।

প্রশ্ন জাগে, নরকসম এ পৃথিবীতে কেনই বা শিশুটির আগমন এবং এমন মহাপ্রয়ান? সে তো নিস্পাপ ফেরেশতাতুল্য মানব শিশু। তার এমন বিদায় কী সভ্য মানব জাতির কাম্য?

আমরা কী মনে রাখছি, এই সুন্দর পৃথিবী সকলের তবে সবার আগে শুধু শিশুদের। আমরা আর অশ্রু বিসর্জন করতে চাই না। চাই এর যথাযথ প্রতিকার। পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করার দায় এই গ্রহের সকলের।

মো. আব্দুল মান্নান : নবাগত বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম।