শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ‘ছাই’, বিপন্ন পরিবেশ

প্রকাশিতঃ ৩১ মার্চ ২০২৪ | ৩:০৮ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বক্তারপাড়ায় বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে ইস্পাত কারখানার পরিত্যক্ত বর্জ্য (জিংক এ্যাশ বা এক ধরনের ছাই) পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করছে অল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ওই এলাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি গত ১৯ মার্চ পরিদর্শন করে দূষণের প্রমাণ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট মামলা দায়েরের কথা জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কেমিক্যালযুক্ত ছাই পোড়ানোর ফলে এলাকার মানুষকে প্রতিনিয়ত উৎকট দুর্গন্ধ সইতে হচ্ছে। সেই সাথে মানুষের শরীরে দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। আশেপাশের গাছপালা, সবজি ও শস্যক্ষেতেও কারখানাটির পরিবেশ দূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দ্রুত কারখানাটি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।

জানা যায়, পরিবেশের ক্ষতি কমাতে ইস্পাত কারখানাগুলোতে এপিসিএস (Air Pollution Control System) স্থাপনের মাধ্যমে কারখানার চুল্লি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া সংগ্রহ করে তা এক ধরণের ছাইয়ে রূপান্তর করা হয়। এই ছাইকে বলা হয় ‘জিংক এ্যাশ’।

বিভিন্ন ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসব জিংক এ্যাশ সরাসরি রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে থাকে। চট্টগ্রামের বিএসআরএম তার মধ্যে অন্যতম। তবে কিছু ইস্পাত কারখানা জিংক এ্যাশ রপ্তানি না করে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

আর সেসব জিংক এ্যাশ সংগ্রহ করে কেউ কেউ পুড়িয়ে জিংক এ্যাশের পরিমাণ বাড়িয়ে নেয় এবং এরপর বিদেশে রপ্তানি করে। একইভাবে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বক্তারপাড়া এলাকার সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠে অল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কারখানা।

অভিযোগ আছে, এই কারখানাতে সনাতন পদ্ধতিতে উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয় জিংক এ্যাশ। এতে জিংক এ্যাশে থাকা ক্ষতিকর বিভিন্ন ভারি ধাতু বাতাসে মিশে যাচ্ছে। যা ওই এলাকার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটি চালাচ্ছেন তৌহিদ আল কবির তুহিন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি।

রবিবার ২৪ মার্চ) দুপুরে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বক্তারপাড়া সমুদ্র উপকূলে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কারখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে উঁচু টিনশেড দিয়ে ঘেরা কারখানার ভেতরে স্তুপ করে রাখা হয়েছে জিংক এ্যাশ। কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যাবস্থা ছাড়াই সেইসব জিংক এ্যাশ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো হচ্ছে। ছোট ছোট স্তুপ করে তাতে দেওয়া হচ্ছে আগুন। সেখান থেকে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধযুক্ত ধোঁয়া। সেই ধোয়া টিনের চালার ফাঁক গলে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়। তবে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে কারখানার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ নাইম নামে এক কর্মকর্তা জানান, এভাবে পোড়ানোর ফলে ছাইয়ের রঙ কালো থেকে সাদা হয়ে যায়। এতে চীনে রপ্তানি করাটা সহজ হয়। কালো রঙের ছাই চীনা ক্রেতারা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এসময় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও কারখানার আইনি বৈধতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, তাদের কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র আছে এবং বৈধভাবেই তারা ‘জিংক এ্যাশ’ প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করছেন।

বক্তারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইফুল বলেন, প্রায় ৫-৬ বছর ধরে অল ট্রেড ইন্টারন্যশনাল নামে কারখানাটি কেমিক্যালযুক্ত ইস্পাত করাখানার বর্জ্য পুড়িয়ে এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করে আসছে। প্রতিদিনই সেখান থেকে নির্গত উৎকট গন্ধযুক্ত ঝাঁজালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হতে হয় মানুষজনকে। অবস্থা এমন যে ঘরে টেকা দায় হয়ে পড়ে। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নানা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছে। এই ধোয়ার প্রভাবে আশেপাশের সবজি ক্ষেতে উৎপাদনও কমে গেছে। অনেক গাছপালা মৃত প্রায় অবস্থা।

তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় কারখানার মালিক তুহিন অবৈধভাবে ছাই পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ করেও আমরা কোন প্রতিকার পাইনি। এর আগে সীতাকুণ্ড উপজেলার ইউএনও অভিযান পরিচালনা করে কারখানাটি সীলগালা করে দিলে অদৃশ্য কারণে কিছুদিন পর আবারও চালু হয়ে যায় কারখানাটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইস্পাত কারখানায় উচ্চ তাপমাত্রায় স্ক্র্যাপ লোহা গলানোর সময় জিংক, লেড, ম্যাংগানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, পটাসিয়ামসহ বিভিন্ন ভারি ধাতু বাষ্পীভূত হয়ে ধোঁয়ার সাথে বাতাসে মিশে যায়। সেই ধোয়াকে সংগ্রহ করে জিংক এ্যাশে রুপান্তরিত করা হয়। ফলে জিংক এ্যাশ পুড়িয়ে রিফাইন করার প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।

চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পরিবেশ কর্মী প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, জিংক এ্যাশ পোড়ানোর ফলে ভারি ধাতুগুলো ধোয়ার সাথে বাতাসে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন, জাহাজভাঙ্গাসহ নানা শিল্পের কারণে সীতাকুণ্ডের পরিবেশ এমনিতেই বেশ নাজুক। উন্মুক্তভাবে জিংক এ্যাশ পোড়ানো হলে তা ওই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ারা বলেন, অভিযোগ পেয়ে গত ১৯ মার্চ কারখানাটি পরিদর্শন করা হয়েছে। জিংক এ্যাশ পুড়িয়ে মেটাল জিংক সংগ্রহ করার জন্য তাদের কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পরিদর্শন রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কারখানার মালিক তৌহিদ আল কবির তুহিন প্রতিবেদকের প্রশ্ন শোনার পর বলেন, আমি এখন খুব অসুস্থ। আপনার সাথে পরে কথা বলব।