চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে খুনের ঘটনায় জড়িতদের শণাক্তের কথা জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
এই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় সাত-আটজনের বিরুদ্ধে সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ বিশ্বাস মামলা করলেও পুলিশ সূত্র বলছে, ঘটনায় জড়িত অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘খুনের মূল ঘটনায় ও সহযোগি হিসেবে অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। এদের বেশ কয়েকজনকে আমরা স্পষ্ট শণাক্ত করতে পেরেছি।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা অারও বলেন, ‘খুনি শণাক্ত, এখন শুধু গ্রেফতারের অপেক্ষায় আছি আমরা।’
চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারীরা সুদীপ্ত হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। হত্যাকাণ্ডে সাত-আটজন সরাসরি অংশ নিলেও ঘটনাস্থলের অদূরে নিউমার্কেট মোড় ও কালীবাড়ি মন্দির মোড়ে আরও ৩০-৩৫ জন ছিলেন বলে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে।
মামলার তদন্তে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মো. তানভীর বলেন, সন্দেহভাজন কয়েকজন আসামির বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তারা সে সময় বাসায় ছিল না। ধারণা করছি, পলাতক ব্যক্তিরাই সুদীপ্তকে খুন করেছে।
এদিকে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারি হলেন সুজন। আর খুন হওয়া সুদীপ্ত বিশ্বাস ছিলেন এই পক্ষের অনুসারী। এছাড়া সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমিনের অনুসারী একটি পক্ষ সক্রিয় আছে সিটি কলেজে; এই পক্ষটি নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুম।
সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১২ সালে। কোন্দলের কারণে কমিটি গঠন হয়নি এতদিন। সম্প্রতি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা ও একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কমিটিতে নিজেদের লোক আনতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এসব বিষয় নিয়ে ফেসবুকে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয় সাম্প্রতিক সময়ে।
এদিকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্তের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা গেছে, ৬ সেপ্টেম্বর সুদীপ্ত লিখেছেন, ‘প্রিয় নেতৃবৃন্দ, সিটি কলেজ ছাত্রসংসদ কমিটিটা খুব দরকার। আমার কোনো স্বার্থ নেই কিন্তু।’ ৪ অক্টোবর আরেক পোস্টে লিখেন, ‘প্রজা ছাড়া রাজার দাম যেমন নেই তেমনি কর্মী ছাড়া নেতারও দাম নেই। কর্মীদের বিদ্রোহ দরকার নতুন কিছু প্রাপ্তির জন্য।’ তার আগের দিন আরেক পোস্টে লিখেন ‘ওয়ান ইলেভেনে অনেককেই দেখি নাই রাজপথে.. ও সরি এটা বললে আবার অন্যায়…।’
২৮ সেপ্টেম্বর আরেক পোস্টে লিখেন ‘কলেজের বারান্দায় হাঁটেনি এমন পাবলিকও আজকাল মিছিল পরবর্তী সমাবেশের মঞ্চে উঠে। নোংরামি আর কতো?’ ১ অক্টোবর আরেক পোস্টে লিখেন- ‘রাজনীতি বড়ই জটিল জিনিস… একসময়কার কথিত ডাস্টবিন এখন ফুলের বাগানের সৌরভ ছড়াচ্ছে!’ আর ২৪ আগস্টের এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘২০১৭, আর কতো অকাল মৃত্যু চাও’। কাকতালীভাবে এই পোস্টের ৪৪ দিন পর সুদীপ্তও অকালে ‘দুর্বত্তের’ হাতে প্রাণ হারান। আর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে লিখেন, ‘অপেক্ষায় রইলাম’। এর ঠিক ছয় থেকে সাত ঘন্টা পর খুন হতে হয় তাকে।
সুদীপ্তদের বাসা চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকায়। গত শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দুই যুবক বাসায় এসে সুদীপ্তকে জানান, তার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। খবরটি শুনেই তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যান তিনি। এর ১০ মিনিট পর চিৎকার শুনে তার মা টিনের ঘরের বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মুখে যান। বাসা থেকে ওই পথের দূরত্ব প্রায় ১০০ ফুট। সেখানে ছেলেকে রাস্তার পাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে বেলা সাড়ে ১১টায় তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার সময় সুদীপ্তের হাত বেধে ফেলেছিল দুর্বৃত্তরা। এরপর হাত-পা ভেঙে ফেলে। তার মাথার পেছনে আঘাতের ফলে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। তবে মাথার বাইরে তেমন ফেটে যায়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে তার অবস্থা গুরুতর হিসেবেও মনে হয়নি স্বজনদের কাছে। মারধর করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত মারা গেছে এমনটা ধারণা করা হচ্ছে। কারণ তার শরীরে ছুরিকাঘাতের কোন চিহ্ন নেই। মেরে ফেলার উদ্দেশ্য থাকলে ছুরিকাঘাত অথবা গুলি করতো। মাথার স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাতের পর চিকিৎসা পেতে দেরী হয়েছে তার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয় সাড়ে ১০টার দিকে। সাড়ে ১১টার দিকে সুদীপ্ত মারা যাওয়ার আরও আধাঘন্টা পর মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ি থেকে সদরঘাট থানায় খবরটি জানানো হয়।
জানতে চাইলে সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘সুদীপ্তকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আঘাত করা হয়েছে- আমার কাছেও এমন মনে হচ্ছে না। তারা গুলি-ছুরি ব্যবহার করেনি। খুন করতে হলে এক-দুইজন আসতো পালানোর সুবিধার্তে। কিন্তু এসেছে ৭ থেকে ৮ জন। হকিস্টিক, লাটি এসব দিয়ে ‘সাইজ’ করতে গিয়ে হয়তো মারা গেছে।’
ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্তর বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস ওরফে বাবুল বিশ্বাস। মা আন্না বিশ্বাস গৃহিণী। দুই মাস আগে নগরের দেওয়ানবাজার এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন সুদীপ্ত। তার ছোট ভাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ নিয়ে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে।
